বাংলাধারা প্রতিবেদন »
চট্টগ্রাম নগরীর সদরঘাট থেকে বাকলিয়া চর পর্যন্ত এলাকার মোট ৮টি খাল দিয়ে দীর্ঘদিন দরে বর্জ্য ও আবর্জনা কর্ণফুলী নদীতে পতিত হয়ে বৃহৎ চর সৃষ্টি এবং বিভিন্ন দখল বাণিজ্যের কারণে নদীর প্রশস্ততা ৮০০ মিটার থেকে ৪০০ মিটারে পৌঁছেছিল। ফলে জেগে ওঠা চরে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছিল। সমস্যা নিরসনে ২০০৯ সালে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ এলাকাটিতে ক্যাপিটাল ড্রেজিং কার্যক্রমের উদ্যোগ নেয়।
২০১১ সালে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ মালয়েশিয়ান মেরিটাইম অ্যান্ড ড্রেজিং করপোরেশন নামে একটি প্রতিষ্ঠানের সাথে নদীতে ক্যাপিটাল ড্রেজিং প্রকল্পের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়। কিন্তু শুরু মাত্র দুই বছরের মধ্যে তারা কাজ বন্ধ করে চলে যায়।
জানা যায়, মালয়েশিয়ান মেরিটাইম অ্যান্ড ড্রেজিং করপোরেশন কাজ শেষ করতে ব্যর্থ হওয়ায় মূল ঠিকাদার স্থানীয় এক এজেন্টকে প্রকল্পের সাব-কন্ট্রাক্টর নিয়োগ করে। কিন্তু তাদের কাজে দক্ষতা না থাকার কারণে ২০১৩ সালে বন্দর কর্তৃপক্ষ মালয়েশিয়ান মেরিটাইম এর সঙ্গে চুক্তি বাতিল করতে বাধ্য হয়। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার অভিযোগ তুলে প্রতিষ্ঠানটি আদালতে মামলা দায়ের করে। ফলে আইনি জটিলতায় বন্ধ হয়ে যায় ক্যাপিটাল ড্রেজিং প্রকল্পের কাজ। এমনকি বিশ্ববিখ্যাত চীনা কোম্পানি চায়না হারবার ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড থেকে ৩২ ইঞ্চি ব্যাসের শক্তিশালি কাটার সাকশন ড্রেজার এনেও পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করতে পারেনি। পরে চায়না হারবারও তাদের অপরাগতা মেনে নিয়ে প্রকল্প থেকে চলে যায়।
প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশ নৌবাহিনীর সঙ্গে ২০১৮ সালের মে মাসে কর্ণফুলীর ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের পরিকল্পনা গ্রহণ করে ১৭ অক্টোবর কাজ শুরু করে। প্রকল্প বাস্তবায়নের মেয়াদ ছিল ২০২২ সালের মে মাস পর্যন্ত। প্রকল্পের পরিকল্পনা গ্রহণের সময় নদী তলদেশ থেকে পলিমাটি উত্তোলনের কথা ছিল ৪২ লাখ ঘনমিটার। কিন্তু প্রকল্পটি সংশোধনের পর পলিমাটি তোলা হচ্ছে ৫১ লাখ ঘনমিটার। ফলে ব্যয়ে বেড়ে ২৫৮ কোটি থেকে ২৯৫ কোটিতে দাঁড়িয়েছে।
বন্দর কর্মকর্তারা জানান, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ প্রকল্পের নাম পরিবর্তন করে পুনরায় ড্রেজিং শুরু করার সিদ্ধান্ত নেয়। বর্তমানে ‘সদরঘাট টু বাকলিয়ার চর ড্রেজিং প্রকল্প’ নামে ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে।
অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে নৌবাহিনীর তত্ত্বাবধানে সেই কাজ শেষ সম্পন্ন করতে যাচ্ছে দেশীয় কোম্পানি সাইফ পাওয়ারটেক লিমিটেডের সিস্টার কনসার্ন ই-ইঞ্জিনিয়ারিং।
জানা যায়, করোনা পরিস্থিতি ও জ্বালানি তেলের অস্বভাবিক মূল্যবৃদ্ধিতে ই-ইঞ্জিনিয়ারিং কাজ চলমান রেখেছে।
আরও জানা যায়, বুয়েটের সমীক্ষায় কর্ণফুলী নদীর তলদেশে ১৩ ফুট পর্যন্ত পলিথিন থাকার ধারণা নিয়ে প্রকল্পের কাজ শুরু হলেও পলিথিনের স্তর মিলেছে ২১ ফুট পর্যন্ত। এজন্য ২০১৯ সালের মার্চে চীন থেকে ৩২ ইঞ্চি ব্যাসের শক্তিশালি সাকশন ড্রেজার এনেও কাজ চলমান রাখা যায়নি। পরে দেশিয় গ্র্যাব ড্রেজার দিয়ে খনন কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়।
সরেজমিনে দেখা যায়, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাজ সম্পন্ন করতে প্রতিষ্ঠানটি বিশ্বসেরা আইএইসসি ব্র্যান্ডের তিনটি কাটার সাকশান ড্রেজারসহ লংবুম এক্সকেভেটর, শর্ট-বুম এক্সকেভেটর, ভাসমান বার্যসহ সাব ড্রেজার এবং এস্ফিবিয়ান ড্রেজার দিয়ে কাজ চলমান রেখেছে প্রতিষ্ঠানটি।
বন্দর কর্তৃপক্ষ জানায়, কর্ণফুলী নদীর ক্যাপিটাল ড্রেজিং প্রকল্পের কাজ প্রায় শেষ হওয়ায় সদরঘাট থেকে বাকলিয়া নদীর এই অংশে ৪ মিটার গভীরতা বেড়েছে। এর সুফল পাবে বন্দর। জেটিতে ভিড়তে পারবে বড় জাহাজ, লাইটার জাহাজ বেশি পরিমাণে নদীতে নোঙর করতে পারবে এবং নদীর তীরে সদরঘাট এলাকায় চালু হবে ৪টি লাইটার জেটি। ফলে বহির্নোঙর থেকে পণ্য জেটিতে নামানো সহজ হবে। খরচও কমবে পণ্য খালাসে। এছাড়া নদীর নাব্যতা বৃদ্ধি পেলে লাইটারেজ জাহাজ চলাচল এবং বন্দরের অন্যান্য কার্যক্রমে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসবে।
এদিকে কর্ণফুলী নদীর ক্যাপিটাল ড্রেজিং হওয়ায় নদীর পানি ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে এবং বর্ষায় শহরে জলাবদ্ধতা কমে আসবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
চট্টগ্রাম বন্দরের চিফ হাইড্রোগ্রাফার ও প্রকল্প পরিচালক কমান্ডার মোহাম্মদ আরিফুর রহমান বলেন, ক্যাপিটাল ড্রেজিং প্রকল্পের কাজ চূড়ান্ত হস্তান্তর করার জন্য বুয়েটের তত্ত্বাবধানে জরিপ কার্যক্রম চলছে। ইতিমধ্যে প্রকল্পের কাজ প্রায় ৯৫ শতাংশ শেষ হয়েছে। এই প্রকল্পের অধীনে ৫১ লাখ ঘনমিটার মাটি উত্তোলন করা হয়েছে। এর মধ্যে ৫০ শতাংশ পলিথিনের আবর্জনা রয়েছে। ড্রেজিংয়ের ফলে সদরঘাট থেকে বাকলিয়া নদীর এই অংশে ৪ মিটার গভীরতা বেড়েছে। নদীর এই গভীরতা ধরে রাখতে ড্রেজিং কার্যক্রম চলমান থাকবে।
শহরের ময়লা আসা বন্ধ না হলে এক বছর পরই আগের অবস্থায় ফিরে যাবে কর্ণফুলী নদী। তাই নদীতে যেন ময়লা না আসে সেজন্য সিডিএ ও সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্টদের সতর্ক থাকতে হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।













