২৫ অক্টোবর ২০২৫

কর্ণফুলী নদীর গর্ভে বিলীন হচ্ছে বসতবাড়ি ও ফসলি-জমি

আশিক এলাহী,রাঙ্গুনিয়া»

রাঙ্গুনিয়া উপজেলার বেতাগী ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের মির্জাখীল এলাকার মৃত আবুল কাশেমের ছেলে শুক্কুর ও মনছুর। পরিবার-পরিজন নিয়ে বাপের রেখে যাওয়া বসতিঘরে সুখেই কাটাচ্ছিলেন দিন। কিন্তু হঠাৎ-ই সুখের সংসার যেন দুমড়ে মুচড়ে যায়, দুঃখের পরশে ব্যথিত হয় তাদের সংসার জীবন। নিমিষেই একদিন কর্ণফুলী নদীর গর্ভে বিলীন হয়ে যায় তাদের বসতবাড়ি । বর্তমানে একটি ভাড়া বাসায় জীবন যাপন করছেন তারা ।

বেতাগী এলাকার স্থানীয় এক কৃষক জানান, বেতাগী ৪ নম্বর ওয়ার্ড অংশে কর্ণফুলী নদী ঘেঁষে ২ একর ফসলি জমি ছিল তার। ফসলি জমির সাথে ঘেঁষে একটি বিশাল দিঘী ছিল। কিন্তু গত ৩০ বছরে দিঘী ও ফসলি জমি নদীর গর্ভে বিলীন হয়ে যায়। নদীর তীরবর্তী এলাকা মানুষের চরম এই নিয়তি মুছতে চট্টগ্রামের কর্ণফুলীর রাঙ্গুনিয়া অংশে নদী ভাঙন রোধে তথ্যমন্ত্রীর বদান্যতায় সরকারের তরফ থেকে দফায় দফায় কাজ করা হলেও নদী ভাঙন অব্যাহত রয়েছে। নদী ভাঙনে উপজেলার বেতাগী, সরফভাটা, শিলক, মরিয়মনগর এবং পৌরসভার দুইটি ওয়ার্ডের বসতবাড়ি ও ফসলি জমি ভেঙে নদীর গর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে।

ভাঙন কবলিত এলাকার স্থানীয়রা দাবি করে বলেন, অপরিকল্পিত বালু উত্তোলন করার কারণেই নদীর তীরবর্তী এলাকার বসতবাড়ি দ্রুত ভেঙে যাচ্ছে। প্রশাসন মাঝেমধ্যে অভিযান চালিয়ে ড্রেজার মেশিন, পাইপ নষ্ট ও আগুনে পুড়িয়ে দিলেও মূলত বালু খেকোরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বালু উত্তোলন চালিয়ে যাচ্ছে বীরদর্পে।

জানা যায়, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ এমপি ২০০৮ সালে ক্ষমতা আসার পর ইছামতি, শিলক ও কর্ণফুলী নদীর রাঙ্গুনিয়া অংশে ৫০ কোটি টাকার ব্লক বসানো হয়। এছাড়া নদী ভাঙন রোধে তথ্যমন্ত্রীর উদ্যোগে ব্লক স্থাপনের প্রকল্প নেয় পানি উন্নয়ন বোর্ড। ৩৯৮ কোটি টাকার এ প্রকল্পে পানি উন্নয়ন বোর্ড রাঙ্গুনিয়াসহ, বোয়ালখালী ও কাপ্তাই উপজেলা যুক্ত করে ব্লক স্থাপনের কাজ করলে নদীর তীরবর্তী এলাকার মানুষ স্বস্তি প্রকাশ করেন। কিন্তু পরবর্তীতে নদী ভাঙন তীব্র হওয়ায় বালু উত্তোলনকেই দায়ী করছেন স্থানীয়রা।

এ বিষয়ে রাঙ্গুনিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইফতেখার ইউনুস জানান, অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের খবর পেলে ব্যবস্থা নেবো। কিন্তু ইজারা নেওয়া হলে বালু উত্তোলন বন্ধ করার এখতিয়ার আমাদের নেই। এটা জেলা প্রশাসকের কাজ। তবে রাঙ্গুনিয়ায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের একটি প্রকল্পের কাজ চলমান আছে।

জলবায়ু পরিবর্তন ও ভাঙনজনিত কারণে স্থানচ্যুত জনগোষ্ঠীকে নিয়ে কাজ করে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ইপসা। সংস্থাটির এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, এ পর্যন্ত কর্ণফুলী নদীর রাঙ্গুনিয়া অংশে ৫ হাজারের অধিক পরিবার ভূমিহীন হয়েছেন। শত শত একর বসতবাড়ি, সড়ক, ফসলি জমি ও বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নদী গর্ভে বিলীন হয়েছে। এবং ৫০০ পরিবারের অধিক রয়েছে নদী ভাঙনের হুমকির মুখে।

সরেজমিন দেখা যায়, ইতোমধ্যে ভয়াবহ ভাঙনের মুখে বেতাগী ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের সুইস গেইট, ৩ নম্বর ওয়ার্ডের জাহাঙ্গীর হুজুরের ঘাট, ৪ নম্বর ওয়ার্ডের গোলাম ব্যাপারী হাটের পশ্চিম থেকে চিতা হোলার পূর্ব পর্যন্ত, ৫ ও ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সিকদার পাড়া, ৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউখালি ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডের মধ্যপাড়া এলাকার বসতবাড়ি ও ফসলি জমি।

বেতাগী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নুর কুতুবুল আলম জানান, বেতাগী ইউনিয়নে ৩০০ পরিবারের অধিক রয়েছে নদী ভাঙনের হুমকির মুখে। এছাড়া গোলাম ব্যাপারী জামে মসজিদ ও সড়কের কিছু অংশ নদী গর্ভে বিলীন হয়েছে।

দরবারে বেতাগী আস্তানা শরীফের শাহজাদা গোলামুর রহমান আশরাফ শাহ জানান, নদী ভাঙন রোধ করতে হলে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন বন্ধ করতে হবে। বালু উত্তোলনের কারনেই কর্ণফুলী নদী সর্বনাশা নদীতে পরিণত হচ্ছে।

সরফভাটা ইউনিয়নে দেখা যায় ৩ নম্বর ওয়ার্ডের পাইট্টিলিকূল সিকদার হাট খোলা ও কইল্যার জাহান এলাকায়ও নদীর তীর ভাঙন দেখা দিয়েছে। যেকোন সময় তলিয়ে যেতে পারে বসতবাড়ি ও ক্ষেতখামার । এছাড়া গোডাউন ব্রীজ সংলগ্ন অংশের ভাঙনে গোডাউন ব্রীজও ঝুঁকিপূর্ণ বলে জানান স্থানীয়রা।

মরিয়মনগর ইউনিয়নের ৬, ৭ ও ৮ নম্বর ওয়ার্ডের মাইঝপাড়া, ফরাশপাড়া ও কাটাখালি এলাকা নদীগর্ভে বিলীন হচ্ছে। এরিমধ্য কাটাখালি এলাকার ভাঙন দেখে স্থানীয়রা আতংকিত। এছাড়াও মাইঝপাড়া অংশ থেকে ফুলগাজী পাড়া ও সওদাগর পাড়া পর্যন্ত নদীর ভাঙন অব্যাহত রয়েছে।

শিলক ইউনিয়নের রাস্তামাথা, ফকিরাঘাট ও মহিলা কলেজ এলাকার আশপাশেও নদী ভাঙন দেখা যায়। এছাড়া পৌরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ড দক্ষিণ নোয়াগাঁও নদীর তীরবর্তী বসতবাড়ি ঝুঁকিতে রয়েছে। এরিমধ্যে জেলে পাড়া এলাকায় নদী ভাঙন অব্যাহত রয়েছে। পৌরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ডের ইছামতি এলাকাও কর্ণফুলী নদীর গর্ভে বিলীন হচ্ছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী (রাঙামাটি) মো, নুরুল ইসলাম জানান, পানি উন্নয়ন বোর্ডের একটি প্রকল্পে নদী ড্রেজিং ও নদী রক্ষার কাজ চলমান আছে। সেখান থেকে ভাঙনকবলিত এলাকায় ব্লক বসানো হবে।

রাঙ্গুনিয়া উপজেলা ভূমি কর্মকর্তা রাজীব চৌধুরী জানান, পরিবেশ ও নদীর তীরবর্তী এলাকার যাতে ক্ষতি না হয়, আইনিভাবে সবকিছু ঠিক রেখে কর্ণফুলী নদীতে ইজারা দেয়া হয়। প্রশাসন অভিযান চালিয়ে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনকারী ব্যক্তিদের শতাধিক ড্রেজার জব্দ করেছে। এবং বিভিন্ন মেয়াদে অপরাধীদের জরিমানা দেয়া হয়েছে। অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের কোনো সুযোগ নেই। এছাড়া আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

বাংলাধারা/এফএস/এফএস

আরও পড়ুন