২৮ অক্টোবর ২০২৫

কাট্টলী সৈকতে পর্যটনের অপার সম্ভাবনা

মাকসুদ আহম্মদ, বিশেষ প্রতিবেদক »

কার মন না চায় সমূদ্রের বিশালতায় নিজেকে হারিয়ে দিতে। জোয়ারের পানিতে গা ভিজিয়ে বালিয়াড়ীতে হেঁটে চলা যেন অনাবিল প্রশান্তি। ইট পাথরের এই শহুরে পরিকল্পনায় পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতে প্রাকৃতিক ঐতিহ্য হারালেও কাট্টলী সমুদ্র সৈকত প্রকৃতির সাজে সজ্জিত। চট্টগ্রামের কাট্টলী এলাকায় পর্যটনের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। কাট্টলী সমুদ্র সৈকত এক সময় কেউ না চিনলেও বর্তমানে প্রেক্ষাপট পাল্টে গেছে। কিন্তু সরকারি হস্তক্ষেপের অভাবে সমুদ্র উপকূলীয় এ এলাকাটি অবহেলিত হয়ে পড়ে রয়েছে।

সাগরিকা সমুদ্র পাড় তথা জেলে পাড়া থেকে শুরু করে দক্ষিণ হালিশহর পর্যন্ত পুরো এলাকা জুড়ে এখন দর্শনার্থীদের ভিড় জমে পড়ন্ত বিকেলে। তবে নিরাপত্তাহীনতার কারণে পর্যটকরা অনেকটা আতঙ্কের মধ্য দিয়ে সমুদ্রের বিশালতায় যেতে হয়। আবার সূর্যাস্তের অনেকটা আগেই বাসায় ফিরতে হয়।

কাট্টলী সমুদ্র সৈকত পাহাড়তলী এলাকার খুবই কাছে। সাগরিকা সড়ক দিয়ে মাত্র ২/৩ কিলো পাড়ি দিলেই পৌঁছে যাওয়া যায়। যেখানে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বারুনিস্নান হয় প্রতিবছর। একই সাথে অগোছালো পরিবেশে রয়েছে বঙ্গোপসাগর। সমুদ্রের জোয়ার ভাটার খেলা দেখা যায় খুব সহজে। এক কথায় জোয়ারের পানি চলে আসে মানুষের ঘরের ভিটেতে। আর ভাটা হলে পানি চলে যায় কয়েক কিলো দূরে।

জোয়ার ভাটার এই পরিবর্তন দেখে পর্যটকরা অবাক হয়। কারণ জোয়ারের পানিতে যখন পুরো এলাকা ছেঁয়ে যায় তখন নবাগতরা মনে করেন এ এলাকায় বন্যা চলছে। অথচ মাত্র কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে পানি যখন ভাটার টানে নেমে যায় তখন অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, মাটি হয়ে যায় অনেকটা পানিবিহীন নিস্প্রাণ। আবার সতেজতা ফিরে আসে জোয়ারে। ফিরে যায় ভাটায়।

পাহাড়তলীর জিরো পয়েন্ট অলংকার মোড় থেকে রিক্সায় যাওয়া যায় সাগরিকা হয়ে কাট্টলীর জেলে পাড়া এলাকায়। সেখান থেকে পায়ে হেঁটেই যেতে হয় কাট্টলী সমুদ্র সৈকতে। অপরিচ্ছন্ন পরিবেশের মধ্য দিয়ে হলেও প্রকৃতিকে ছুঁয়ে দেখতে এলাকার সাধারণ মানুষরা যেমন পড়ন্ত বিকেলের সময়টুকু কাটাতে সেখানে ভিড় জমান। তেমনি আশপাশের এলাকা থেকেও দূরত্ব কম হওয়ার কারণে ক্লান্তির অবসর সময়টুকু কাটাতে চলে যান কাট্টলী সমুদ্র সৈকতে।

পাহাড়তলী, হালিশহর ও পতেঙ্গা থানা কেন্দ্রিক এ সমুদ্র সৈকত কিছুটা পাহাড়তলী এলাকায় আবার কিছু অংশ হালিশহর এলাকায় এবং সবচেয়ে বৃহদাংশ পড়েছে পতেঙ্গা থানা এলাকায়। তবে পতেঙ্গার অংশটুকু পরিপাটি হলেও অযত্নে অবহেলায় পড়ে রয়েছে পাহাড়তলী ও হালিশহর থানার উপকূলীয় অংশটুকু। তবে নিরাপত্তাহীনতায় থাকে আগতরা।

তিন থানা মিলে ১৫ কিলোমিটার এলাকায় পুলিশের নজরদারি তেমন একটা চোখে পড়ে না। তবে পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতকে ঘিরে দুয়েকটিম টহল পুলিশ অস্ত্র নিয়ে ঘোরাঘুরি করে। অস্ত্রগুলো কার্যকর রয়েছে কিনা এ নিয়েও সন্দেহ রয়েছে পর্যটকদের মাঝে।

বাঁধের পরেই অনেক দূর উঁচু নিচুতে হেঁটে পানির নাগাল পাওয়া যায় কাট্টলী সমুদ্র সৈকতে। পতেঙ্গা এলাকায় সৈকত বালুকমায় হলেও কাট্টলী সমুদ্র সৈকত কিন্তু কর্দমাক্ত। জোয়ারের পানিতেই বেড়িবাঁধ থেকে সমুদ্রের পানির ধারা পর্যন্ত ছোট ছোট গর্তে পরিণত হয়েছে। জোয়ারের পর ভাটা নেমে আসলে এসব গর্তে খুঁজে পাওয়া যায় কাঁকড়া আর সামুদ্রিক ছোট বড় মাছ।

কাঁকড়া আর মাছকে ঘিরে সেখানে গড়ে উঠেছে জেলে পাড়া। স্থানীয়রা বিশেষ করে জেলে পাড়ার লোকজন এই সমুদ্র সৈকতে ঘিরে অনেকটা লাভবান হলেও পর্যটকদের জন্য অনেকটা ভোগান্তি চলাফেরায়। কারণ অনেকটা লাফিয়ে লাফিয়ে চলতে হয় এ এলাকায়। কোথাও উঁচু আর কোথাওবা নিচু। সমতলের দেখা মেলে না। ফলে হাতে হাত ধরে পর্যটকদের যেতে হয় পানির নাগালে।

কাট্টলী সমুদ্র সৈকত পর্যটকদের জন্য পরিপাটি করে গড়ে তোলা গেলে বিনোদনে আরেকটি স্পট পরিচ্ছন্নতায় তৈরি হবে। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে ও জাইকার অর্থায়নে এই এলাকার বেড়িবাঁধটি রিং রোডে পরিণত হবার কথা। কিন্তু এখনও পর্যন্ত আলোর মুখ দেখছে না নানা জরিপের কারণে। সম্ভাবনার এ দ্বারটি পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা গেলে পর্যটকের ভিড় যেমন সামলানো যাবে না তেমনি ভাসমান ব্যবসায়ীদের পদচারণাও বেড়ে যাবে। এক্ষেত্রে সরকারি উদ্যোগে বাঁধ নির্মাণের পর সরকারি ব্যবস্থাপনায় ব্যবসাকেন্দ্র তৈরি করা গেলে রাজস্ব আদায়ের প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে।

১৯৯১ সালে ঘূর্ণিঝড়ের পর উপকূলীয়দের রক্ষা করতে গিয়ে ফৌজদারহাট থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত  সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চলে উঁচু করে বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। তবে এ বেড়িবাঁধ নির্মাণের মূল উদ্দেশ্য ছিল ৯১’ এর জলোচ্ছ্বাসের পুনরাবৃত্তি ঘটলে যেন স্থানীয়রা রক্ষা পায়। কারণ বেড়িবাঁধের নামে যে বাজেট বরাদ্দ হয়েছিল তা কয়েক দফায় সাবাড় করেছে অসাধু সরকারি আমলারা। বাঁধ প্রত্যক্ষ করলে দেখা যায়, এ বাঁধ গাড়ি চলাচলের উদ্দেশ্যে তৈরি করা হলেও কার্যকর হচ্ছে না এখনও। তবে মানুষের হাঁটাচলার উপযুক্ত ছাড়া এ বাঁধ এখন ময়লা আবর্জনার স্তুপে ভরা। সরকারের এ উদ্যোগ দীর্ঘ ২৭  বছরেও বাস্তবায়ন হয়নি।

অবশেষে ২০১৭ সালে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা  ব্যয়ে এই বেড়িঁবাঁধের উপর চিটাগাং আউটার রিং রোড প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু করে। ফলে চট্টগ্রামমের হয়ে যাচ্ছে টার্ণিং পয়েন্ট। ২০২২ সালে এই সড়কটিই হবে চট্টগ্রামের মেরিনড্রাইভ। কারন কক্সবাজারের গাড়িগুলো ফৌজদারহাট দিয়ে ঢুকে পতেঙ্গার বঙ্গবন্ধু টানেল দিয়ে আনোয়ারা হয়ে পটিয়া বাইপাসে যুক্ত হবে। ফলে সময় সংকীর্ণ হবে আরো একঘন্টা সময়।   এদিকে, চট্টগ্রামের জিরো পয়েন্ট নিউ মার্কেট এলাকা থেকে পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতের দূরত্ব প্রায় ২২ কিলোমিটার। কিন্তু শহুরে চালচলনে আর মোটরযানের জ্যামে পড়ে পর্যটকরা পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতে যেতে অনেকটা বিড়ম্বনার শিকার হন। ফলে অনেকে এখন পতেঙ্গা সৈকত এলাকায় গিয়ে অবসর সময় কাটানোর চিন্তাভাবনা করছেন আউপার রিং রোড দিয়ে। তবুও এ সৈকতে পর্যটকদের ভিড়ে তিল ধারণার ক্ষমতা থাকে না সরকারি বন্ধের দিনগুলোতে। সন্ধ্যার পর নিরাপত্তাহীনতার কারণে সৈকত এলাকা ছেড়ে এলেও ভিড় জমে কর্ণফুলী মোহনা কেন্দ্রিক নেভাল ভিআইপি সড়কে। তবে এ সড়কটি একদিকে কর্ণফুলীর মোহনাকে যেমন চিহ্নিত করেছে তেমনি চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমান বন্দরও পড়েছে একই দিকে। তবে নিরাপত্তার চাদরে সৈকত ঢাকা থাকলে পর্যটকরা গভীর রাত পর্যন্ত নিজেদের বিলিয়ে দিতেন সমুদ্রের বিশালতায়।

বাংলাধারা/এফএস/এফএস

আরও পড়ুন