২৪ অক্টোবর ২০২৫

ক্যাম্প জুড়েই অস্ত্রের ছড়াছড়ি, খুনাখুনি : দু’বছরে দুটি অস্ত্র কারখানার সন্ধান

সায়ীদ আলমগীর, কক্সবাজার»

মিয়ানমারে নৃশংস নিপীড়নের শিকার হয়ে প্রাণ বাঁচাতে সীমান্ত পেরিয়ে ২০১৭ সালে বাংলাদেশে প্রবেশ করে লাখো রোহিঙ্গা। ক্ষত-বিক্ষত ও বিপর্যস্ত রোহিঙ্গাকে স্থানীয়দের বদান্যতায় মানবিক সহায়তা দেয় বাংলাদেশ সরকার। উখিয়া-টেকনাফে ৩৪টি ক্যাম্প স্থাপন করে বিশ^সহায়তায় যোগানো হচ্ছে আহার। সেই সহায়তার ৪ বছরের মাথায় বিভীষিকাময় পরিস্থিতি উপহার দিচ্ছে আশ্রিত রোহিঙ্গারা।

ক্যাম্পের একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তারে রোহিঙ্গারা রাতের আঁধারে অস্ত্র হাতে মহড়া চালাচ্ছে নিয়মিত। দিন দিন অপরাধে জড়ানো রোহিঙ্গাদের অস্ত্রের চাহিদা বাড়তে থাকায় ক্যাম্পের পাহাড়ি এলাকায় অবৈধ অস্ত্র তৈরির কারখানা স্থাপন করে তৈরী করছে আগ্নেয়াস্ত্র। সোমবার (৮ নভেম্বর) ও গত বছরের ৫ অক্টোবর অস্ত্রের পৃথক দুটি কারখানা আবিস্কার করেছে এলিট ফোর্স র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন  (র‌্যাব-১৫)। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে নজরদারি বাড়িয়ে কারখানা দুটির সন্ধান, অস্ত্র এবং অস্ত্র তৈরীর সরঞ্জাম উদ্ধার করেছে শৃংখলা বাহিনী। এসময় অস্ত্র তৈরীর ৫ কারিগরও গ্রেফতার হন।

এসব ছাড়াও রোহিঙ্গা আসার পর ক্যাম্পসহ রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকায় (২০১৯ থেকে ২০২১ সালের ৮ নভেম্বর পর্যন্ত) প্রায় ২ শতাধিক দেশি-বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করে র‌্যাব। এসময় গোলাবারুদ পাওয়া গেছে ছয় শতাধিক। আর গত অক্টোবর এবং চলতি মাসের ৮ নভেম্বর পর্যন্ত ক্যাম্পে কর্মরত এপিবিএন পুলিশ সদস্যরা উখিয়া-টেকনাফের বিভিন্ন ক্যাম্পসহ পাহাড়ি এলাকায় অভিযান চালিয়ে ১১টি আগ্নেয়াস্ত্র, ৪৮টি দেশি অস্ত্র উদ্ধার করেছে। এসময় ৮২ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। উদ্ধার করা হয়েছে গোলাবারুদ, মামলা হয়েছে ৫৮টি।

অপরদিকে, ২০১৯ সালসহ চলতি বছরের ১০ মাসে অস্ত্র মামলা হয়েছে ৭০টি। এ সময়ের মধ্যে রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে ১৭টি দেশি পিস্তল, ৫৫টি এলজি, ৪টি বিদেশি পিস্তল, ৪০টি একনলা বন্দুক, ৩০টি দেশি বন্দুক, ৭টি পাইপগানসহ বেশক’টি ধারালো অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে।

র‌্যাব সূত্র জানায়, কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবিরের এক্স-৪ ক্যাম্প সংলগ্ন পাহাড়ে সোমবার ভোরে সন্ধান পাওয়া অস্ত্র কারখানা থেকে ১০টি অস্ত্র ও অস্ত্র তৈরির সরঞ্জামসহ তিনজনকে আটক করা হয়েছে। আটকরা হলেন, কুতুপালং ক্যাম্প সি-১ জি বøকের মৃত আজিজুর রহমানের ছেলে বাইতুল্লাহ (১৯), তার ভাই হাবিব উল্লাহ (৩২) ও একই ক্যাম্পের জি বøকের জাহিদ হোসেনের ছেলে মোহাম্মদ হাছান (২৪)। এছাড়াও গত বছরের ৫ অক্টোবর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আরো একটি অস্ত্র তৈরির কারখানার খোঁজ পেয়েছিল র‌্যাবা। সেখান থেকে দুই অস্ত্র কারিগর মহেশখালী উপজেলার বাসিন্দা আনোয়ার (৫০) ও এখলাস (৩২)কে গ্রেফতারের পাশাপাশি ৩টি দেশি অস্ত্র, ২ রাউন্ড গুলি ও বিপুল পরিমাণ অস্ত্র তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার হয়।

র‌্যাব-১৫ কক্সবাজার ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল খায়রুল ইসলাম বলেন, গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে ক্যাম্পে অস্ত্র কারখানার সন্ধান পাওয়া গেছে। এ কারখানা থেকেই রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের কাছে অস্ত্র সরবরাহ করা হচ্ছিল বলে খবর আসে। নিশ্চিত হবার পর সোমবার ভোরে অভিযান চালানো হয়। এসময় র‌্যাবকে লক্ষ্য করে তারা গুলি চালায়। র‌্যাবও পাল্টা গুলি চালিয়ে কারখানাটি নিয়ন্ত্রণে নেয়। পরে সেখান থেকে পাঁচটি পিস্তল, পাঁচটি বন্দুক ও বিপুল পরিমাণ অস্ত্র তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়। রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকায় মাদক আর অস্ত্র একই সূত্রে গাঁথা। সিন্ডিকেটের মূল হোতাদের গ্রেফতারের প্রচেষ্টা অব্যহত রয়েছে।

কুতুপালং শিবিরের এআরএসপিএইচ কার্যালয়ে ২৯ সেপ্টেম্বর মুহিবুল্লাহ এবং বালুখালীর দারুল উলুম নাদওয়াতুল ওলামা আল-ইসলামিয়াহ মাদ্রাসায় ছয়জনকে হত্যার ঘটনায় ক্যাম্পজুড়ে অস্থিরতা দেখা দেয়। এর নেপথ্যে নিহতের স্বজনরা রোহিঙ্গা জঙ্গি সংগঠন আরসাকে দায়ী করলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে বরাবরই বলা হচ্ছে, বাংলাদেশের আরসার অস্তিত্ব নেই।
গত শুক্রবার (৫ নভেম্বর) সকালে মুহিবুল্লাহ ও ছয়জন নিহতের ঘটনাস্থল ঘুরে দেখেন র‌্যাবের মহাপরিচালক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন। এসময় কক্সবাজার জেলার ভারপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার (এএসপি) মো. রফিকুল ইসলাম, ৮ এপিবিএনের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার কামরান হোসাইন, রবিউল ইসলাম ও উখিয়া-টেকনাফ সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শাকিল আহমেদ। এসময় কর্মকর্তাদের ক্যাম্পের সার্বিক পরিস্থিতি শান্ত রাখতে বিভিন্ন নির্দেশনা দেন র‌্যাবের ডিজি।

৮ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার কামরান হোসাইন জানান, গত অক্টোবর ও চলতিমাসের ৮ নভেম্বর পর্যন্ত এপিবিএন সদস্যরা উখিয়া-টেকনাফের বিভিন্ন ক্যাম্পসহ পাহাড়ি এলাকায় অভিযান চালিয়ে ১১টি আগ্নেয়াস্ত্র, ৪৮টি দেশি অস্ত্র উদ্ধার এবং ৮১ জনকে গ্রেফতার করেছে। উদ্ধার করা হয়েছে গোলাবারুদ, মামলা হয়েছে ৫৮টি। তালিকা অনুযায়ী সব অপরাধীকে গ্রেফতারে অভিযান চলছে।

জেলা পুলিশের তথ্য বলছে, ২০১৯ সালে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে টেকনাফ ও উখিয়া থানায় অস্ত্র মামলা হয়েছে ১৭টি। ২০২০ সালে হয়েছে ২৭টি। চলতি বছরের ১০ মাসে অস্ত্র মামলা হয়েছে ২৫টি। এ সময়ের মধ্যে রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে ১৭টি দেশি পিস্তল, ৫৫টি এলজি, ৪টি বিদেশি পিস্তল, ৪০টি একনলা বন্দুক, ৩০টি দেশি বন্দুক, ৭টি পাইপগানসহ বেশক’টি ধারালো অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে।

কক্সবাজারের পুলিশ সুপার (ভারপ্রাপ্ত) মো. রফিকুল ইসলাম জানান, ক্যাম্পগুলো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। অস্ত্রধারীদের ধরতে অভিযান চলছে।

কক্সবাজার সিভিল সোসাইটির সভাপতি আবু মোরশেদ চৌধুরী জবলেন, ক্যাম্পে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের অস্ত্রের মহড়ায় পরিস্থিতি খুবই ভয়াবহ। এখনই চেপে না ধরলে স্থানীয়দের একটি সংখ্যালঘু হিসেবে গণ্য করা হবে। ক্যাম্পসহ গোটা জেলার মানুষই আতঙ্কে আছে।

কে নিয়ন্ত্রণ করেন রোহিঙ্গা শিবির?
কক্সবাজারের ৩৪টি ক্যাম্পে ১১ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গার বাস। এর মধ্যে উখিয়ার ২৩টি ক্যাম্পে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা প্রায় আট লাখের বেশি রোহিঙ্গার বসতি। শুধু কুতুপালংয়ে আছে তিন লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা। আর ক্যাম্পগুলোতে আধিপত্য বিস্তার নিয়েই একের পর এক হত্যাকান্ড ঘটাচ্ছে এখানকার রোহিঙ্গা-সন্ত্রাসীরা।

গত চার বছরে ৮২ রোহিঙ্গাকে হত্যার অভিযোগে উখিয়া ও টেকনাফ থানায় ৮০টি মামলা হয়েছে। সেই সঙ্গে প্রত্যাবাসন নিয়ে কাজ করা আরও ১০ রোহিঙ্গা নেতাকে হত্যা করা হয়। প্রত্যাবাসন নিয়ে আলোচনা করলেই হত্যা করা হয়। এসব হত্যাকান্ডে কথিত বিতর্কিত সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মিকে (আরসা) দায়ী করেন নিহতের স্বজনরা।

রোহিঙ্গাদের দাবি, আরসাকে মদত দিচ্ছে মিয়ানমার। এজেন্ট হিসেবে প্রত্যাবাসন বিরোধিতায় কাজ করছে ওরা। ক্যাম্পের সাম্প্রতিক হত্যাকান্ড গুলোতে আরসার হাত আছে। প্রাসনের চোখের সামনে কীভাবে ঘটছে এ হত্যাকান্ড? ক্যাম্পগুলো কী প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণের বাইরে?

২৯ সেপ্টেম্বর রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহকে হত্যার মাস না যেতেই ২২ অক্টোবর বালুখালী ক্যাম্প-১৮-এর এইচ-৫২ বøকে মাদ্রাসায় সশস্ত্র হামলায় ছাত্র, শিক্ষক ও ভলানটিয়ারসহ ছয় রোহিঙ্গা নিহত হন। দুই ক্যাম্পের দূরত্ব পাঁচ কিলোমিটার। রোহিঙ্গাদের ভয়ভীতি দেখিয়ে মূলত ক্যাম্পের নিয়ন্ত্রণ নিতে চায় সন্ত্রাসীরা।

তবে, ৮ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) পুলিশ সুপার (অধিনায়ক) মো. শিহাব কায়সার খান বলেন, ক্যাম্পগুলো প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু এতো অকর্মন্য রোহিঙ্গার মাঝে দুই-একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটছে। ক্যাম্পগুলোতে অপরাধীদের হাতে যে অস্ত্র রয়েছে, সেগুলো দেশি। এসব দিয়ে ক্যাম্প নিয়ন্ত্রণের শক্তি রাখে না তারা। ছয়জন নিহত হলেও তাদের শরীরে গুলির চিহ্ন পাওয়া যায়নি। তবে অন্যদের ভয় দেখাতে তাদের নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে।

একাধিক রোহিঙ্গা জানান, সাধারণ শান্তিপ্রিয় রোহিঙ্গারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বিভিন্ন তথ্য দেয়। সন্ত্রাসীদের ধরতে পুলিশকে সহযোগিতা করে। এ জন্য তারা ক্ষুব্ধ। তারা হুমকি দিচ্ছে, সবাইকে শেষ করে দেবে। এ জন্যই আতঙ্কে আছি আমরা। এখানে সন্ত্রাসীদের এজেন্ট আছে। ক্যাম্পগুলো তাদেরই নিয়ন্ত্রণে বলা যায়।

পুলিশের পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে চলতি বছরের ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত টেকনাফ ও উখিয়া থানায় ৮২ রোহিঙ্গাকে হত্যার অভিযোগে ৮০টি মামলা হয়েছে। এর বাইরে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ শতাধিক রোহিঙ্গা নিহত হন। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে উখিয়া-টেকনাফ থনায় এক হাজার ৩৬৬টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় দুই হাজার ৩৪৮ জনকে আসামি করা হয়েছে। যাদের মধ্যে এক হাজার ৭৪৭ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দায়ের হয়েছে মাদক মামলা (৭০৬টি)। রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ হত্যাকান্ডের পর থেকে শরণার্থী ক্যাম্পগুলোতে চালানো বিশেষ অভিযানে ১১৪ রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীসহ ১৭২ জনকে গ্রেফতার করেছে এপিবিএন। ক্যাম্পগুলোতে ‘ব্লক রেইড’ অভিযান চলছে।

বাংলাধারা/এফএস/এফএস

আরও পড়ুন