২৮ অক্টোবর ২০২৫

গাড়ীর হাইড্রোলিক হর্ণে আতঙ্ক

মাকসুদ আহম্মদ, বিশেষ প্রতিবেদক»

পথচারীরা নীরবতায় পথ চলতে গিয়ে অনেকটা আতঙ্কেই থাকেন সবসময়। রাস্তায় চলতে গেলে কানে তুলো গুঁজিয়ে বা আঙ্গুল চেপে হেঁটে চলা সম্ভব নয়। স্বাভাবিক ভাবেও হাঁটা যাচ্ছে না। কানে মোবাইলের হেডফোন লাগিয়ে হাঁটাও বিপদজ্জনক। কিন্তু মাত্রতিরিক্ত শব্দদূষণের কারনে এখন পরিবহনেও চলা দায়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল ও উপাসনালয়ের সামনে ‘নো হর্ণ’ চিহ্নিত সাইনবোর্ড থাকলেও কেউ মানছেনা। বিশেষ করে ধণাঢ্য পরিবারের আলালের ঘরের দুলালেরাই এখন রাস্তায় শব্দ দূষণের অন্যতম কারন হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ এদের সঙ্গে থাকা হাইস্পীড মোটরসাইকেল আর মোডিফাইড মোটর গাড়ীর মধ্যে ইনস্টল করা হাইড্রোলিক হর্ণের বিকট শব্দ। তাও আবার পথচারেিদর টার্গেট করে একেবারে গা ঘেঁষেই হর্ণ বাজিয়েই চম্পট হয়ে যায়। তবে এ ধরনের বিকট শব্দ প্রতিনিয়ত জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করছে। যা আইন বিরোধী হলেও আইনি প্রক্রিয়া যেন চুপসে আছে। আইন প্রয়োগকারীরাও থমকে দাঁড়িয়েছে। হাইস্পীড মোটর সাইকেলের লাটভাইদের পাকড়াও করতে যেন চরম অনীহা।

প্রধানমন্ত্রী ও বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা পরিবেশ রক্ষায় যে স্লোগান দিয়েছেন তাতে যেন মনে হয় অতুক্তি রয়েছে শব্দ দূষণ রক্ষাকারীদের।ফলে পরিবেশ অধিদফতরের মেট্রো ও জেলার দায়িত্বশীলরা হাত-পা গুটে বসে আছেন। নেই কোন অভিযান নেই কোন দমন। কিন্তু শব্দদূষন নিয়ন্ত্রন বিধিমালা ২০০৬ যেন অনেকটা অকার্যকর। আইনানুযায়ী শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে আইনরে প্রয়োগ কেন হচ্ছে না তা এখন প্রশ্নবিদ্ধ। অথচ শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রনের জন্য আবাসিক এলাকার আশপাশে কোন ধরনের উচ্চস্বরে মাইক বাজানো বা সাউন্ড সিস্টেম ব্যবহার সমপূর্ণ নিষিদ্ধ। বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের আশপাশ এলাকায় এখন আর শব্দোর মাণমাত্রা অতিক্রম করা যাবে না। কিন্তু কলকারখানা আর শিল্পপ্রতিষ্ঠানের বিকট শব্দ জনজীবনে প্রভাব ফেলছে সবচেয়ে বেশিমাত্রায়। বিশেষ করে পার্শ্ববর্তী আবাসিক এলাকার উপর যেমন প্রভাব ফেলছে তেমনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোও রক্ষা পাচ্ছে না শব্দদূষণ থেকে।

চট্টগ্রামস্থ পরিবেশ অধিদফতরের গবেষণাগারের তথ্যে প্রকাশ পেয়েছে নিরব এলাকায় শব্দের সর্Ÿোচ্চ মানমাত্রা অতিক্রম করেছে। তবে গাড়ী বা মোটরসাইকেলে শব্দের সর্বোচ্চ মানমাত্রা ব্যবহার আইনত দন্ডনীয় অপরাধ। শুদু তাই নয় সকল প্রকার মোটরযান, নৌযানসহ সড়ক ও জলপথের সকল প্রকার যানেই উচ্চশব্দের হর্ণ বা সংকেত ব্যবহার আইনের পরিপন্থী। এমনকি রোগীবহনকারী এ্যাম্বুলেন্স পর্যন্ত শুধুমাত্র ফাঁকা জায়গায় সাইরেন বাজানোর অনুমতি রয়েছে । শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও হাসপাতাল এলাকা এমনকি ধর্মীয় উপাসনালয়ের সামনেও এ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন বাজানো নিষেধ। কিন্তু কে শোনে কার কথা।

শব্দদূষণের কারণ নির্ণয় করতে গিয়ে প্রত্যক্ষভাবে দেখা গেছে, যানবাহনে অতিমাত্রার হাইড্রোলিক হর্ণের ব্যবাহার অব্যাহত রেখেছে পরিবহন ব্যবহারকারীারা। শিল্প-কারখানায় ও ওয়ার্কসপে উৎপাদনের উচ্চশব্দ মানুষের মারাত্মক ক্ষতি করছে। বিভিন্ন প্রচারনার কাজে ব্যবহৃত মাইক ও লাউড স্পীকার এবং সাউন্ড সিস্টেম শব্দদুষণ করছে। বিভ্ন্নি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে লাউড স্পীকারের ব্যবহার ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। রাজনৈতিক সভা বা সেমিনার ও সিম্ফুজিয়ামে ব্যবহৃত সাউন্ড সিস্টেম যেন শব্দের নিয়ন্ত্রণ মানতে চাচ্ছে না। পাশাপাশি রাস্তার উপর নির্মাণ সামগ্রী রেখে ব্যবহার ও বিশেষ করে রড সোজা করা ও কংকর ভাঙ্গা বন্ধ করা না গেলে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। এদিকে মানুষের উচ্চস্বরের কারনেও শব্দদূষণ হচ্ছে। মোবাইল ব্যবহারকারীারা গণ পরিবহনে লাউড স্পীকার ব্যবহার করা অন্যান্য যাত্রীদের জন্য ক্ষতিকর।

চিকিৎসকদের সঙ্গে আলাপ করে দেখা গেছে, শব্দদূষণের ফলে কানে কম শোনাসহ বধিরতা দেখা দিতে পারে। শব্দদুষণের কারণে উদ্ভিদের ও বিভিন্ন খাদ্য শস্যের উৎপাদন হ্রাস পায়। মানবদেহে উচ্চ রক্তচাপসহ হৃদ যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়েও অক্কা পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সারাদিন যারা রাস্তায় চলাফেরা করেন তারা গাড়ী বা মানুষের উচ্চস্বরের কারনে অনিদ্রা ও কোন কিছুতে মনযোগে ব্যাঘাত ঘটতে পারে। এতে মানসিক সমস্যা দেখা যাওয়াসহ গর্ববতী মায়েদের বাচ্চা নষ্ট ও বিকলাঙ্গ হওয়ার অন্যতম কারন শব্দদূষণ। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আতশবাজীর কারনে পাখি ও জলজ প্রাণীর মৃত্যু হতে পারে।

এ ব্যাপারে পরিবেশ অধিদফতরের গবেষণাগারের পরিচালক ইশরাত রেজা বাংলা ধারা প্রতিবেদককে বলেন, আমরা বিভিন্ন স্থানে বিশেষ করে হাসপাতাল, স্কুল কলেজ, মাদ্রাসাসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সামনে শব্দদূষনের মাত্রা অনেক বেশী। এছাড়া বাণিজ্যিক ও আবাসিক এলাকায় শব্দদূষণ এখন মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। এসব স্থানে আমরা প্রতিমাসেই শব্দের মাণমাত্রা নিয়ন্ত্রনে পরীক্ষা নিরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছি। শব্দদূষণের ফলে হৃদযন্ত্রেে ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাওয়াসহ উচ্চরক্তচাপ প্রাণহানীর কারন হয়ে দাঁড়াতে পারে। এছাড়া বিভিন্ন স্থানে বা রাস্তার মোড়ে আকস্মিক চেকপোস্ট বসিয়ে গাড়ী ও মোটরসাইকেল থেকে হাইড্রোলিক হর্ণ খুলে নিয়ে তা ধ্বংস কার হচ্ছে।

শব্দ দূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা, ২০০৬ অনুযায়ী শব্দের সুনির্দিষ্ট মানমাত্রা নির্ধারিত রয়েছে। নীরব এলাকার তথা হাসপাতাল, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও গ্রন্থাগারের জন্যে দিনে ৪৫ ও রাতে ৩৫ ডেসিবল মানমাত্রা নির্ধারিত। কিন্তু তা রক্ষা করা যাচ্ছে না। ফলে কানে কম শোনা থেকে শুরু করে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হওয়ার উপক্রম। , আবাসিক এলাকার ক্ষেত্রে দিনে ৫০ ও রাতে ৪০ ডেসিবল মানমাত্র অতিক্রম করলেই মানবদেহে উচ্ছ রক্তচাপের প্রভাব পড়তে পারে। এদিকে মিশ্র এলাকার ক্ষেত্রে দিনে ৬০ ও রাতে ৫০ ডেসিবল মানমাত্রা নিদর্ংষ্ট করা আছে চিকিৎসকদের মতে। কিন্তু কোথায় শব্দদূষণ রক্ষা হচ্ছে। বাণিজ্যিক এলাকার ক্ষেত্রে দিনে ৭০ ও রাতে ৬০ ডেসিবল এবং শিল্প এলাকার জন্য দিনে ৭৫ ও রাতে ৭০ ডেসিবল হলেও এর কোনোটিই মানা হচ্ছে না। এলাকা ভিত্তিক শব্দের মানমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না।

জানা গেছে, নগরীতে বর্তমানে বাসের শব্দ ৯৫ ডেসিবল, মোটর সাইকেলের শব্দ ৮৭ থেকে ৯০ ডেসিবল এবং কলকারখানার মেশিনের শব্দ ৮০ থেকে ৯০ ডেসিবল। যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং বাংলাদেশ শব্দ দূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালার নির্ধারিত মানমাত্রার তুলনায় অনেকটাই বেশী।

সবশেষ ২০২১ সালে চট্টগ্রাম খুলশীস্থ পরিবেশ অধিদফতরের শব্দমাত্রা গবেষণার পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা গেছে, নগরীর ৩০টি স্থানে শব্দের মানমাত্রা পরিমাপ করা হয়েছে গত ১০ মাসে। জানুয়ারী থেকে অক্টোবর মাসের এই শব্দের মাত্রা গবেষণায় প্রায় প্রতিটি স্থানেই বেশী পাওয়া গেছে। ৩০টি স্থানের মধ্যে ১৫টি নীরব, ২টি মিশ্র, ৭টি আবাসিক এবং ৬টি বাণিজ্যিক এলাকায় শব্দমাত্রা পরিমাপ করা হয়।

প্রতিবেদনে নগরীর নীরব এলাকা হিসেবে উল্ল্যেখ করা হয়েছে, দামপাড়াস্থ বাংলাদেশ মহিলা সমিতি স্কুল এলাকা, জামালখানস্থ ডা. খাস্তগীর সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় এলাকা, চকবাজারস্থ চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ এলাকা, আগাবাদস্থ বহুতলা কলোনীর চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ, সিরাজউদৌলা রোডস্থ জেমিসন রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতাল এলাকা, আকবরশাহস্থ পাহাড়তলী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ মোড়, নাসিরাবাদস্থ ইস্পাহানী পাবলিক স্কুল ও কলেজ মোড়, ফয়’স লেকস্থ ইইনিভার্সিটি অব সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি চিটাগাং(ইউএসটিসি) , নাসিরাবাদস্থ চট্টগ্রাম সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় এলাকা, চকবাজারস্থ চট্টগ্রাম কলেজ এলাকা, সদরঘাটস্থ চট্টগ্রাম সিটি কলেজ এলাকা, লালখানবাজারস্থ মমতা ক্লিনিক এলাকা, ফিরোজশাহস্থ আল-আমিন হাসপাতাল এলাকা, পাঁচলাইশের সার্জিস্কোপ হাসপাতাল এলাকা ও সাদার্ন হাসপাতাল এলাকা।
মিশ্র এলাকা হিসেবে নির্ধারন করা হয়, পাঁচলাইশের একুশে হাসপাতাল ও মেহেদীবাগস্থ ম্যাক্স হাসপাতাল এলাকাকে। আবাসিক এলাকা হিসেবে কল্পলোক আ/এ, হিলভিউ আ/এ, কসমোপলিটন আ/এ, চান্দগাঁও আ/এ, আমিরবাগ আ/এ, হালিশহর কে ব্লক আ/এ, ও দক্ষিণ খুলশী আবাসিক এলাকাকে। শব্দদুষণে বাণিজ্যিক এলাকা হিসেবে এ.কে.খান মোড়, জিইসি মোড়, বহদ্দারহাট মোড়, আগ্রাবাদ মোড়, সিইপিজেড মোড় ও অক্সিজেন মোড় এলাকাকে নির্ধারন করা হয়।

অপরদিকে শব্দ দূষণ রোধে বাংলাদেশ সরকার শব্দ দূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা ২০০৬ প্রণয়ন করে তা আর কার্যকর করা হচ্ছে না। এছাড়াও শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রনে কতো আইন প্রণয়ন করা হয়েছে তা কাগজে কলমেই সীমাবদ্ধ। বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫, মোটরযান আইন ১৯৮৮,স্থানীয় সরকার (সিটি কর্পোরেশন) আইন ২০০৯, পর্যালোচনায় দেখা গেছে, পরিবেশ অধিদফতরের অভিযানে এ সকল আইন অমান্যকারী ব্যক্তিকে শাস্তির আওতায় আনা প্রয়োজন হলেও পরিবেশ অধিদফতরের মেট্রো ও জেলা দফতরের কোন ধরনের অভিযান চোখে পড়ছে না। ফলে আইন অমান্যকারীরাও থেমে নেই।

বাংলাধারা/এফএস/এফএস

আরও পড়ুন