মাকসুদ আহম্মদ, বিশেষ প্রতিবেদক»
বসত ঘরের একপাশে মাঁচা করে লাউয়ের চাষ করা যায়। তেমনি পুকুর অথবা চলাচল পথের দু’ধারেও । তবে সবজি হিসেবে খাবারের চাহিদা মেটাতে উচ্চ ফলনশীল লাউয়ের চাষ করা যায়। খুব কম খরচে নিজেদের চাহিদা মেটাতে ছোট আঙ্গিকে লাউয়ের চাষ সম্ভব। তবে বাণিজ্যিকভাবে কৃষকরা লাউয়ের ফলন বাড়াতে গবেষণা করে যাচ্ছে। চট্টগ্রামের পাহাড়তলীস্থ বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কেন্দ্র (বারি) ২০০৭ সাল থেকে গবেষণা করে কয়েক প্রজাতির বারি লাউ উদ্ভাবন করেছে। ২০১৪ সাল থেকে এ জাতের লাউ এর ফলন আশানুরূপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এখানে পাওয়া যায় বারি প্রজাতির লাউয়ের বীজ ও চারা।

গাজীপুরের জয়দেবপুরস্থ বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের সবজি বিভাগ ও উদ্যান তত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্র ২০০৭ সালে, বারি লাউ-১ ও বারি লাউ-২ উদ্ভাবন করে ব্যাপক প্রচারের মাধ্যমে কৃষকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। ফলপ্রসূতা এসেছে ঐ অঞ্চলের কৃষকদের মাঝে। ফলে দেশজ উৎপাদন চাহিদা মেটাতে ঐ গবেষণা কেন্দ্র থেকে বীজ সংগ্রহের মাধ্যমে বারি লাউয়ের ফলন বাড়িয়েছে কৃষকরা।
২০০৮ সালে পাহাড়তলীস্থ বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কেন্দ্র বারি লাউ-৪ এর উদ্ভাবন করে। সে থেকে বারি লাউ নিয়ে এখনও গবেষণা চলছে নতুন আরেক প্রজাতির লাউয়ের উদ্ভাবন করতে। বারি লাউয়ের বিভিন্ন প্রজাতি গবেষণার মাধ্যমে ক্রমশ উৎপাদন বাড়ানোর বিভিন্ন প্রকল্পও হাতে নেয়া হয়েছে। এ ধরনের গবেষণায় ২০১৩ সালের ১৯ নবেম্বর বারি লাউ-৪ এর উপর সার প্রয়োগের গবেষণা করা হয়। এরমধ্যে হেক্টর প্রতি কেমিক্যাল ফার্টিলাইজার, ভার্মি কম্পোষ্ট, কিচেন ওয়েস্ট কম্পোষ্ট ও সার বিহীনভাবে বারি লাউ-৪ এর উপর উৎপাদন বৃদ্ধি ও হ্রাসজনিত গবেষণা করা হয়।

ওই গবেষণায় দেখা গেছে, গৃহস্থালির রান্না ঘরের বর্জ্য থেকে তৈরি সার উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়ক। যদিও শহরাঞ্চলে এসব বর্জ্য রাস্তার পাশে ডাস্টবিনে ফেলে দেয়া হয়। কিন্তু পাহাড়তলীস্থ এই কৃষি গবেষণা কেন্দ্র এসব বর্জ্য শুধু গৃহস্থালী থেকেই নয়, নগরীর বিভিন্ন বাজার থেকে সংগ্রহের মাধ্যমে ‘কিচেন ওয়েস্ট কমপোস্ট’ সার তৈরি করছে।
এ ব্যাপারে ঐ গবেষণা কেন্দ্রের কয়েক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বাজারের সার ফসল উৎপাদনে সহায়ক নয়। জৈব সার পাওয়া না গেলে কিচেন ওয়েস্ট কমপোস্ট সার প্রয়োগের মাধ্যমে ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি সম্ভব। এসব সারের উপাদান সংগ্রহে গবেষণা ইনস্টিটিউটের ভেতরে থাকা প্রত্যেক পরিবারকে তিনটি করে ডাস্টবিন দেয়া হয়েছে। যাতে যত্রতত্র রান্না ঘরের বর্জ্য ফেলা না হয়। এছাড়াও এ দফতর সংলগ্ন ঝাউতলা কাঁচা বাজার ও মাছের বাজার থেকে বর্জ্য সংগ্রহের মাধ্যমে প্রক্রিয়া অনুযায়ী ধাপে ধাপে সার তৈরি করা হচ্ছে। এসব সারই বিভিন্ন ফসলের বীজ গবেষণার মাধ্যমে উৎপাদনে ব্যবহার করা হচ্ছে।

গবেষনা কেন্দ্রের তথ্য থেকে পাওয়া গেছে ২০১৪ সালের পর থেকে বারি-৪ লাউয়ের উৎপাদন অনেক বেশি। দেশীয় খাদ্যের চাহিদা মিটিয়ে বীজ সংগ্রহ খুব সহজ। যেখানে ৮ হাজার হেক্টর জমিতে সাধারণ লাউ ৬৮ হাজার টন উৎপাদন সম্ভব, বারি-৪ লাউ সেক্ষেত্রে তিন গুণেরও বেশি ফলন পাওয়া যাবে। মানব দেহের পুষ্টির জন্য এক কেজি লাউ থেকে শতকরা ৯৫ ভাগ পানি, আমিষ, ক্যালসিয়াম, লৌহ, প্রোটিনসহ সব ধরনের পুষ্টির উপাদান রয়েছে লাউয়ের মধ্যে।
প্রতি হেক্টর জমিতে ৮০ থেকে ৮৫ টন লাউ মাত্র দুই মাসের ব্যবধানে উৎপাদন সম্ভব। প্রতিটি গাছ থেকে ১৫ থেকে ২০টি লাউ পাওয়া যায়। মৌ মাছির মাধ্যমে প্রাকৃতিক পরাগায়ন ছাড়াও কৃত্রিমভাবে পরাগায়ন করলে উৎপাদন শতকরা ৩৫ ভাগ বেড়ে যাবে। পুরুষ ফুল দিয়ে স্ত্রী ফুলের উপর আলতোভাবে স্পর্শ করে পরাগায়ন করা হয়। ফলে হেক্টর প্রতি বীজ কালেকশন হবে সাড়ে ৭শ থেকে ৮শ কেজি। যার বাজার মূল্য প্রায় ৬ থেকে ৭ লাখ টাকা।

চাষ পদ্ধতি বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে গবেষকরা জানান, জৈব সার সমৃদ্ধ দোআঁশ বা এটেল দোআঁশ মাটি লাউ চাষের জন্য উত্তম। তবে বারি লাউয়ের ক্ষেত্রে গবেষকরা মওসুমের নির্ভরশীলতা এড়াতে পেরেছেন। শীতকালে এ লাউয়ের ফলন অনেক বেশি হলেও গ্রীষ্মকালে তা শতকরা ২৫ কমে আসতে পারে। তবে মেঘলা আবহাওয়া লাউয়ের ফলন উলেখযোগ্য হ্রাস করে। দিনে লাউয়ের ফলনের জন্য ২৫ থেকে ৮০ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রা প্রয়োজন।
এ গবেষণা কেন্দ্র থেকে লাউয়ের বীজ অথবা চারা সংগ্রহ করে বাণিজ্যিক কিংবা পারিবারিক চাহিদা মেটাতে লাউয়ের চাষ করা যায়। চারার প্রয়োজন অনুসারে পানি দিতে হবে। তবে চারার গায়ে যেন পানি না পড়ে সে দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। চারা থেকে একটু দূরে পানি দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। শুষ্ক মওসুমে লাউ গাছের সারিতে বা বেডে ৪/৫দিন অন্তর অন্তর সেচ দিতে হয়। মাচায় লাউয়ের ভর নিতে পারে এমন শক্ত খুটি সংযোজন করতে হবে। পোকার আক্রমণ থেকে বাঁচাতে যদি কীটনাশক ব্যবহার করা না হয় তাহলে প্রয়োজনে মশারি জাতীয় নেট ব্যবহার করা যেতে পারে।

বীজ সংগ্রহের জন্য যেসব লাউ সংরক্ষণ করা হয়েছে এসব লাউয়ের প্রত্যেকটির ওজন কমপক্ষে ১২ থেকে ১৫ কেজি। প্রতি বছরই শতাধিক লাউ এ পাহাড়তলীস্থ গবেষণা কেন্দ্রে বীজ হিসেবে সংরক্ষণের রাখা হয়। মাঁচা ভেঙ্গে পড়ে যাবার ভয়ে এসব লাউয়ের নিচে মাটির টবকে উল্টে দিয়ে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এছাড়াও লাউয়ের চারিধারে সূতলি দিয়ে খোলা ব্যাগ তৈরি করা হয়েছে। সর্বক্ষণ পরিচর্যার জন্য প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন বিভাগের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তারা প্রতিদিন পরিচর্যা করছেন।
বাংলাধারা/এফএস/এফএস