সায়ীদ আলমগীর, কক্সবাজার : অতিপ্রবল রূপ নেয়া ঘূর্ণিঝড় মোখার আঘাতে উখিয়া-টেকনাফের আশ্রিত রোহিঙ্গা বসতি ও কক্সবাজারের পাহাড়ি এলাকায় ধসের আশংকা করা হচ্ছে। মোখা সেন্টমার্টিন, কুতুবদিয়া, মহেশখালীর সোনাদিয়া, ধলঘাটা, মাতারবাড়ি, কক্সবাজার সদরের চৌফলদন্ডী, খুরুশকুল, ঈদগাঁওর গোমাতলী, পোকখালীতে স্মরণকালের ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাস ঘটাতে পারে বলে ধারণা করছেন বোদ্ধামহল। পাহাড় ধ্বস ও জলোচ্ছ্বাসে প্রাণহানিসহ ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্ভাবনাও এড়িয়ে যাচ্ছেন না অতীতে ভুক্তভোগীরা। শনিবার দুপুর থেকে কক্সবাজারে ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে।
ইতিমধ্যেই ঘুর্ণিঝড় মোখার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে টেকনাফসহ সেন্টমাটিন ও উপকূলীয় এলাকায়। শুক্রবার রাত থেকে গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টিপাত হচ্ছে। মোখায় সম্ভাব্য ক্ষতি ও পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সবধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে বলে জানিয়েছেন অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) মো. আবু সুফিয়ান ও টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মো. কামরুজ্জামান।

সেন্টমার্টিনের বাসিন্দা নুর মোহাম্মদ জানান, শুক্রবার সন্ধ্যা হতে দ্বীপের আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হয়ে আছে। সাগরে বেড়েছে জোয়ারের পানি। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির সাথে হালকা বাতাস বইছে। যারা ১৯৯১ সালের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস দেখেছে তারা মোখার ভয়বহতা নিয়ে দ্বীপবাসির মাঝে আগাম প্রচারণা চালাচ্ছে। যে কারণে দ্বীপবাসীর মাঝে আতঙ্ক বিরাজ করছে। দ্বীপে বড় কোন দুর্ঘটনা হলে আশ্রয় নেওয়ার কোন উপায় থাকবেনা। চতুর্দিকে সাগর। তবে সাইক্লোন শেল্টার থাকাতে আপাতত আমরা নিরাপদ বোধ করছি।
বাহারছড়া উপকূলের বাসিন্দা মো. জুবায়ের জানান, সাগর থেকে সব ইঞ্জিনচালিত ট্রলার ও নৌযানগুলো ঘাটে ফিরে নোঙ্গর করেছে। আমাদের গ্রামে পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসকারী বাসিন্দারা পাহাড় ধসের আশংকায় রয়েছে। তবে উপজেলা প্রশসানের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে সবাইকে সর্তক থাকার পরামর্শ দিয়েছে।
হোয়াইক্যংয়ের বাসিন্দা মো. সাইফুল ইসলাম জানান, বিগত ঘূর্ণিঝড়ে আমাদের এলাকায় পাহাড় ধসে অনেক লোক মারা গেছেন। এবারের ঘূর্ণিঝড়ের ভয়াবহতা শুনে আমরা খুব আতংকে আছি। বিশেষ করে পাহাড়ে থাকা মানুষগুলো অনিরাপদ। তাই এখানে পাহাড় ধসে পড়ার শঙ্কাটা বেশি। প্রশাসনের পক্ষ থেকে রেড ক্রিসেন্ট সদস্যরা মাইকিং করে সবাইকে সতর্ক করছে।

উনচিপ্রাং ক্যাম্পের মাঝি কামাল হোসাইন জানান, ক্যাম্পের পাহাড়ের পাশে অথবা পাহাড়ের উপরের থাকা রোহিঙ্গারা এক ধরনের আতংকে সময় কাটাচ্ছে। ভারী বৃষ্টি হলেও এখানে পাহাড় ধস হয়। কিন্তু ধেয়ে আসা ঘুর্ণিঝড় মোখার ভয়াবহতা শুনে আমরা খুব ভয়ে আছি। তবে, এনজিও সংস্থার ভলেন্টিয়ার ও সিআইসি অফিসের সদস্যরা রোহিঙ্গাদের সর্তক থাকতে পরামর্শ দিচ্ছেন।
সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান জানান, ঘূর্ণিঝড় মোখায় দূর্যোগ মোকাবেলায় আমরা দ্বীপবাসিকে সর্তক করেছি। বিভিন্ন সচেতনামূলক প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছি। মানুষকে নিরাপদে রাখতে স্কুল-মাদ্রাসা ও সাইক্লোন শেল্টার প্রস্তুত রেখেছি। আতংকিত না হয়ে ধৈর্য সহকারে পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য সবার প্রতি অনুরোধ রইলো।
তার মতে, অতীতেও দ্বীপবাসি বিভিন্ন ঘুর্ণিঝড় মোকাবিলা করেছে। তবে ক্ষয়ক্ষতিও হয়েছে। এবারে ঘূর্ণিঝড়ের গতিবেগ বেশি হওয়ার কথা প্রচার পাওয়ায় সাধারণ মানুষ আতংকিত হচ্ছে। ধীরে ধীরে জোয়ারের পানি বাড়ছে। হালকা বৃষ্টি হচ্ছে, সাথে হালকা বাতাসও বাড়ছে।
হোয়াইক্যং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুর আহমদ আনোয়ারী জানান, সিপিসি’র সদস্যসহ আমরা পাহাড়ি এলাকাসহ সবখানে মাইকিং করে পাহাড় ও ঝুঁকিপূর্ণ জায়গা থেকে নিরাপদে মানুষদের সরে আসতে অনুরোধ করছি। ঘুর্ণিঝড় মোকাবেলায় সব প্রস্তুতি সম্পন্ন রেয়েছে। উপজেলা প্রশাসনের নির্দেশনায় সব পরিস্থিতির খোঁজ খবর নিয়ে মানুষকে সচেতন করে যাচ্ছি।
টেকনাফ উপজেলার নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মো. কামরুজ্জামান জানান, ঘুর্ণিঝড় মোখা মোকাবেলায় সব প্রস্তুতি নেয়া আছে। সেন্টমার্টিন দ্বীপে নৌবাহিনীর পাশাপাশি বিজিবি, পুলিশ, কোস্টগার্ড সদস্যরা সতর্ক অবস্থানে রয়েছেন। খোলা হয়েছে হটলাইন।
ইউএনও আরো বলেন, পাহাড়ের পাদদেশে থাকা বাসিন্দাদের সব বিষয়ে সর্তক থাকাসহ ঝুঁকিপূর্ণ স্থান থেকে সরে আসার জন্য বলা হয়েছে। নিজেদের জানমাল রক্ষায় বিপদ শুরু হবার আগেই সাইক্লোন শেল্টারে বা নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে সবার প্রতি অনুরোধ করেন তিনি। যারা ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে আছে তাদেরকে এখন থেকে সাইক্লোন শেল্টার অথবা নিরাপদ স্থানে চলে আসার জন্য বলা হচ্ছে।
কক্সবাজার শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (যুগ্ন সচিব) মোহাম্মদ মিজানুর রহমান জানান, ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’য় রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা নিশ্চিতসহ ঘূর্ণিঝড় পরিস্থিতি মোকাবেলায় ক্যাম্পগুলোতে স্বেচ্ছাসেবী প্রস্তুত রাখা হয়েছে। ক্যাম্পের স্কুল ও মসজিদ-মাদ্রাসাসহ মজবুত সেন্টারগুলো প্রস্তুত রাখা হয়েছে শেল্টার হিসেবে। ক্যাম্পে রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, রেডক্রস, মেডিক্যাল টিম, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, দমকল বাহিনী, বিভিন্ন দাতা সংস্থার কর্মীসহ রোহিঙ্গা স্বেচ্ছাসেবীরাও দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রস্তুত রয়েছে। দুর্যোগকালীন সময়ের জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে নগদ অর্থ ও শুকনো খাবার।
উল্লেখ্য, বিগত ঘূর্ণিঝড়গুলোতে টেকনাফসহ রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ২০ জনের অধিক লোক পাহাড় ধসের কারণে প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছিল। আর কক্সবাজারের অন্যস্থানে মারা গিয়েছিল অর্ধশতাধিক মানুষ। এবার পাহাড় ধসে মৃত্যুর সংখ্যা শূণ্য রাখতে জোর ততপরতা চালানো হচ্ছে বলে জানিয়েছেন কক্সবাজার জেলা প্রশাসক (ডিসি) মুহম্মদ শাহীন ইমরান।
অপরদিকে, বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’র প্রভাবে অতি ভারী বর্ষণের কারণে কক্সবাজার, বান্দরবান, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চলের কোথাও কোথাও ভূমিধসের সম্ভাবনা রয়েছে বলে আবহাওয়া অধিদপ্তরের দেওয়া ১৫ নম্বর বিশেষ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, শনিবার রাত থেকে চট্টগ্রাম ও বরিশাল বিভাগের উপকূলীয় এলাকায় ‘মোখা’র তাণ্ডব শুরু হতে পারে। এর প্রভাবে চট্টগ্রাম, সিলেট ও বরিশাল বিভাগে ভারী (৪৪ থেকে ৮৮ মিলিমিটার) থেকে অতিভারী (২৮৯ মিলিমিটার) বৃষ্টি হতে পারে। অতিভারী বৃষ্টির কারণে কক্সবাজার, বান্দরবান, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চলের কোথাও কোথাও ভূমিধস হতে পারে।
বিজ্ঞপ্তিতে আরও জানানো হয়, পূর্ব-মধ্য বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থানরত অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’ উত্তর-উত্তরপূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে একই এলাকায় অবস্থান করছে। ঘূর্ণিঝড়টি শনিবার বেলা ১২টায় চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে ৭০৫ কি.মি. দক্ষিণ-দক্ষিণ পশ্চিমে, কক্সবাজার সমুদ্রবন্দর থেকে ৬৩০ কি.মি. দক্ষিণ-দক্ষিণ পশ্চিমে, মোংলা সমুদ্রবন্দর থেকে ৬৯৫ কি.মি. দক্ষিণে এবং পায়রা সমুদ্রবন্দর থেকে ৬৪৫ কি.মি. দক্ষিণে অবস্থান করছিলো। এটি আরও উত্তর-উত্তর–পূর্ব দিকে অগ্রসর ও ঘনীভূত হয়ে রোববার (১৪ মে) সকাল ছয়টা থেকে সন্ধ্যা ছয়টার মধ্যে কক্সবাজার-উত্তর মিয়ানমার উপকূল অতিক্রম করতে পারে। আজ রাত থেকে চট্টগ্রাম ও বরিশাল বিভাগের উপকূলীয় এলাকায় অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড়ের অগ্রভাগের প্রভাব শুরু হতে পারে।













