২৪ অক্টোবর ২০২৫

চট্টগ্রামে কঠোর লকডাউনের পরিকল্পনা

তারেক মাহমুদ » 

বন্দর নগরী চট্টগ্রামে করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতির দিন দিন অবনতি হচ্ছে। রোগী বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চাপ বাড়ছে চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার ওপর। তবে বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসাবিহীন রোগী ফেরত পাঠানোর বিষয়টি বর্তমানে একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় পরিণত হয়েছে। তার সাথে যুক্ত হয়েছে অক্সিজেন সিলিন্ডার সংকট সৃষ্টি করে বাড়তি দাম আদায়ের মহোৎসব। ফলে বিনা চিকিৎসায় অকালে প্রাণ হারাচ্ছেন অনেকেই। লকডাউন শিথিল করার পর সরকার বেশকিছু স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার প্রয়োজনীয় শর্ত জুড়ে দিলেও তা মানছেন না অনেকেই। তাই পরিস্থিতি আরও অবনতি হবার আশঙ্কা প্রকাশ করছেন সংশ্লিষ্টরা। এদিকে করোনা প্রতিরোধে চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকা পর্যায়ক্রমে লকডাউন ঘোষণা করে তা কঠোরভাবে কার্যকর করার পরিকল্পনা নেয়া হচ্ছে। 

জানা যায়, এলাকাভিত্তিক সামাজিক সংক্রমণ পরিস্থিতি, আক্রান্তের হার, আক্রান্ত ও উপসর্গে মৃত্যুহার এবং সার্বিক উচ্চঝুঁকি ইত্যাদি বিষয় বিবেচনা করে লকডাউনে পড়বে নগর ও জেলার বিভিন্ন এলাকা। রোডম্যাপ অনুসারে নিয়ন্ত্রিত থাকবে লোক চলাচলসহ লকডাউন এলাকার জীবনযাত্রা।

চট্টগ্রাম নগর ও জেলার উপজেলাগুলোতে সর্বশেষ ২৪ ঘন্টায় ২২২ জনের শরীরে করোনা শনাক্ত হয়েছে। এ নিয়ে গত শুক্রবার পর্যন্ত চট্টগ্রামে মোট শনাক্ত রোগী ৪ হাজার ৫৯৩ জন। আক্রান্তদের মধ্যে ৭০ শতাংশ নগরের বাসিন্দা। গতকাল শুক্রবার পর্যন্ত করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে ১০৭ জন। তাদের অধিকাংশই নগরের বাসিন্দা। বর্তমানে আইসোলেশনে রয়েছেন ৩৪০ জন ও সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ৩১১ জন। সর্বাধিক শনাক্তের তালিকায় ঢাকা নগরের পর দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে চট্টগ্রাম।

বিশেষজ্ঞদের মতে, লকডাউন শিথিল করার পর থেকে চট্টগ্রামে যে হারে রোগী শনাক্ত হচ্ছে তাতে বোঝা যায় পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে পারে। তাঁরা বলছেন, এখন এলাকাভিত্তিক লকডাউন ঘোষণা করে তা কঠোর হস্তে বাস্তবায়ন করা সময়ের দাবি।

চট্টগ্রামের বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য), চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের দুজন সহকারী পরিচালক, বিআইটিআইডি ল্যাবের প্রধানসহ চট্টগ্রামে স্বাস্থ্য খাতের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, বেশ কিছু চিকিৎসক, নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মী আক্রান্ত হয়েছেন। কিছুদিন আগে এক নবজাতক শিশুরও করোনা ধরা পড়েছে। এ ছাড়া শিল্পপতি, ব্যবসায়ী, পুলিশ, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষও আক্রান্ত হয়েছেন।

এদিকে, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ও সাধারণ রোগীদের ফিরিয়ে দেয়ার একের পর এক অভিযোগ উঠছে। চট্টগ্রাম জেলার ২০টি বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকে মোট ৮২৫ শয্যা খালি, যা এসব প্রতিষ্ঠানের মোট ধারণক্ষমতার প্রায় অর্ধেক। আর আইসিইউ শয্যার খোঁজে রোগীর স্বজনরা হাসপাতালের দ্বারে দ্বারে ঘুরলেও এসব ক্লিনিকের আইসিইউতে চিকিৎসার সুযোগ পাচ্ছেন মাত্র ২৫ জন, যা সক্ষমতার চার ভাগের এক ভাগ। এ পরিস্থিতিতে চিকিৎসা দিতে অনাগ্রহী বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে অভিযান শুরু করতে যাচ্ছে সার্ভেইল্যান্স টিম। এজন্য গত বুধবার তিনজন ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে তিনটি দল গঠন করা হয়েছে। তারা ইতোমধ্যে অভিযান শুরু করে ব্যবস্থা নিচ্ছেন।

সার্ভেইল্যান্স টিমের আহ্বায়ক চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (উন্নয়ন) মো. মিজানুর রহমান বলেন, রোগীদের চিকিৎসা ছাড়া যাতে ফিরিয়ে দেয়া না হয় সে বিষয়ে বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক মালিকদের বহুবার বলেছি। তাদের কেউ কেউ সেটা শুনছেন না। এখন আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। তিনজন ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে তিনটি টিম গঠন করা হয়েছে। তারা ইতোমধ্যেই মনিটরিং অভিযান শুরু করেছেন। রোগীদের চিকিৎসা না দিলে কঠোর ব্যবস্থা নিচ্ছি।

চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বি বাংলাধারাকে বলেন, ১০০ এর উপরে যেসব থানায় করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছে, সেসব থানাকে রেড জোনে রাখা হয়েছে। যেসব থানায় করোনা ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা ১০ থেকে ৯০ এর মধ্যে সেসব থানাকে ইউলো জোনে, ১ থেকে ১০ জনের মধ্যে থাকা এলাকা ব্লু জোনে এবং আক্রান্তের সংখ্যা শূন্য থাকা এলাকাকে গ্রিন জোনে রাখা হয়েছে। এলাকাভিত্তিক লকডাউন করা বড় কথা নয়, জনগণের কল্যানের স্বার্থে তা কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। আমরা বরাবরই দেখেছি, মানুষ স্বাস্হ্যবিধি মেনে চলাফেরা করছেন না। নিজে, নিজের পরিবারকে, প্রতিবেশীকে সুস্থ রাখতে হলে স্বাস্হ্যবিধি মেনে চলার কোন বিকল্প নেই।

চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের সিনিয়র কনসালট্যান্ট ডা. আব্দুর রব বাংলাধারাকে বলেন, এভাবে রোগী সংখ্যা বাড়লে তো হাসপাতালে জায়গা পাওয়াই কঠিন হয়ে যাবে। অলরেডি যেসব হাসপাতালে কোভিডের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে সেগুলো ভর্তি হয়ে গেছে। জায়গাই তো খালি নাই। তার চেয়েও জরুরি, রোগের সংক্রমণ যাতে কমে সে ব্যবস্থা নেওয়া। যে কোনোভাবেই রোগী সংখ্যা কম হোক এই প্রার্থনা করি। যেন হাসপাতালে যাওয়া না লাগে, যেন আইসিইউ না লাগে। এজন্য প্রতিকার, প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার প্রতি জোর দিতে হবে বেশি, যাতে সংক্রমণের হার কমে যায়।

চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসন মোহাম্মদ ইলিয়াছ হোসেন বাংলাধারাকে বলেন, আমরা জনগণের উদ্দেশে বলি, স্বাস্হ্যবিধি মেনে চলুন। কোনো রকম প্রাণে বেঁচে থাকলে চাকরি, ব্যবসা, দিনমজুরের কাজ সব করে ভবিষ্যৎ পার করা যাবে। করোনায় প্রাণ গেলে দেশময় বিপর্যয় নেমে আসবে। আপনি বাঁচুন, অন্যকেও বাঁচান। বাঁচান দেশ ও জাতিকে। মানুষকে সচেতন করার জন্য আমরা আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। সিভিল প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সেনাবাহিনীর দায়িত্বরতদের বিশ্রাম নেই, চোখে ঘুম নেই। অথচ দেশের মানুষ করোনার ভয়াবহতা বোঝার চেষ্টা করছে না। তাই এলাকাভিত্তিক লকডাউন বাস্তবায়নে এবার কঠোর সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।

সিএমপি কমিশনার মাহাবুবর রহমান বাংলাধারাকে বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কঠোর হস্তে সামাজিক ও নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে চলাচলের জন্য নগরবাসীকে উদ্বুদ্ধ করে যাচ্ছে। নগরীর কোনো কোনো অংশে মানুষ বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। প্রয়োজনে আমরা আরও কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করব।

বাংলাধারা/এফএস/টিএম

আরও পড়ুন