বিশেষ প্রতিবেদক »
পানিতে পড়ে শিশু মৃত্যুর দিক থেকে চট্টগ্রাম বিভাগের অবস্থান তৃতীয়। সারাদেশে প্রতিদিন গড়ে ৪০ জন শিশু (১৮ বছর বা এর কম বয়সী) পানিতে ডুবে মারা যায়। এ শিশুদের মধ্যে প্রায় ৬০ ভাগ শিশুরই বয়স চার বছরের কম।
পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যু নিয়ে গবেষণাকারী বেসরকারি সংস্থা সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন এন্ড রির্চাস বাংলাদেশ (সিআইপিআরবি) এর সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা যায়, প্রতি বছর শুধু পানিতে ডুবে চার বছরের কম বয়সী শিশু মারা যায় প্রায় ১০ হাজার। দৈনিক হিসেবে গড়ে এ সংখ্যা ৩০ জন। বাড়ির ২০ গজ দূরত্বের মধ্যে কোনো ডোবা, পুকুর, খাল, বিল এমনকি শহরে পরিবেশে বাথরুমে রাখা বালতির পানিতে মর্মান্তিক এ মৃত্যু হয়েছে। গবেষণায় আরও দেখা যায়, শিশুদের বেশির ভাগেরই পানিতে ডুবে মৃত্যু হয়েছে সকাল ৮-২টার মধ্যে।
(সিআইপিআরবি)’র পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সচেতনতামূলক তিন পদক্ষেপ গ্রহণ করলেই পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুহার ৮২ ভাগ কমিয়ে আনা সম্ভব। সংস্থাটি শিশু মৃত্যুর পরিসংখ্যান দেয়ার পাশাপাশি এর প্রতিকারে পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য মাঠ পর্যায়ে কাজও করছে।
সিআইপিআরবি পরিচালক ড. আমিনুর রহমান বলেন, ‘জলে ডুবে শিশু মৃত্যু বাংলাদেশে আর নয়’ প্রতিরোধে আমরা নয় বছর ধরে সারাদেশে কাজ করছি। পানিতে পড়ে শিশু মৃত্যুর হার কমাতে আমরা দেশের সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ উপজেলায়, শেরপুর সদর, নরসিংদীর মনোহরদী, চাঁদপুরের মতলব উত্তর-দক্ষিণ, কুমিল্লার দাউদ কান্দি, পটুয়াখালীর কলাপাড়া ও বরগুনা জেলার বিভিন্ন স্থানে আড়াই হাজার ডে- কেয়ার সেন্টারে চার বছরের কম বয়সী ৫০ হাজার শিশু ও ৬-১০ বছর বয়সের সাড়ে ছয় লাখ শিশুকে সাঁতার প্রশিক্ষণ দিয়েছি। এছাড়া এসব ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় সাধারণ মানুষদের সিপিআর ট্রেনিং (পানিতে পড়া শিশুদের প্রাথমিক চিকিৎসা) দেয়া হয়েছে। এখনো পর্যন্ত আমরা ৩ হাজার মানুষকে এ ট্রেনিং দিয়েছি। পাশাপাশি জন সচেতনতামূলক তথ্য প্রচার ও জনপ্রতিনিধিদের এ বিষয়ে আমরা সংযুক্ত করছি।
কোন জেলায় কত মৃত্যু : বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত নিউজের উদ্ধৃতি দিয়ে এডভোকেসি ব্লুমবার্গ ফিলানথ্রোপিক’র সহযোগি প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল হেলথ ইনকুবেটরের সংগৃহীত তথ্যে দেখা যায়, ২০২১ সালে চট্টগ্রাম জেলায় জানুয়ারি- মার্চ এ তিন মাসে ২৫ শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়। এছাড়া শুধু চট্টগ্রাম বিভাগে ২০২০ সালের জানুয়ারি মাস থেকে ২০২১ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত ১৮৪ জন শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়। জরিপে আরো দেখা যায় খুলনা বিভাগে এক বছরে ৭২২ জন, ঢাকায় ২১১ জন, রংপুরে ১৪৩ জন, রাজশাহীতে ১২১ জন, ময়মনসিংহে ১০৬ জন, বরিশালে ৮৩ জন ও সিলেটে ৪৮ জন শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়। এছাড়া শুধু জেলাভিত্তিক নেত্রকোনা সর্বাধিক ৫১ জন শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়। পানিতে পড়ে শিশু মৃত্যুর দিক থেকে চট্টগ্রামের অবস্থান তৃতীয়। সারাদেশে এক বছরে পানিতে ডুবে মৃত্যু ছাড়া নৌকা দুর্ঘটনায় ১১৮ জন ও বন্যার পানিতে মারা যায় ৫৫ জন শিশু। এরমধ্যে সকালে ৩৯৪ জন, বিকেলে ৩৮৮ জন, সন্ধ্যায় ১৫৪ জন এবং রাতে ২০ জন শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়। তথ্যে আরো দেখা যায়, পানিতে ডুবে মৃত্যদের মধ্যে চার বছরের কম ৩৪৮ জন শিশু, ৫-৯ বছরে ৩০৮ জন, ৯-১০ বছরে ১২০ জন, ১৫-১৮ বছরে ৩২ জন এবং ১৮ বছরের বেশি ১৬০ জন মানুষ মারা যায়।
গ্লোবাল হেলথ ইনকুবেটরের যোগাযোগ ব্যবস্থাপক মো. সারোয়ার ই আলম জানান, ডুব মৃত্যুর ঘটনাগুলো ঘটে থাকে সকাল আটটা থেকে দুপুর ২টার মধ্যে। যে সময় বাবাসহ বয়োজ্যেষ্ঠ পুরুষ সদস্যরা বাড়ির বাইরে থাকে, বড় ভাইবোনেরা স্কুল-কলেজে যায় এবং মা’কে ব্যস্ত থাকতে হয় রান্না করা, কাপড় ধোয়া, পানি সংগ্রহ থেকে শুরু করে অন্যান্য কাজে। এ সময় পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুটি অনেকটাই অরক্ষিত থাকে। ফলে অল্প সময়ের অসাবধানতায় ঘটে যায় দুর্ঘটনা। মূলতঃ যথাযথ তদারকির অভাবেই পানিতে পড়ে মৃত্যুর ঘটনা ঘটে।
সারোয়ার ই আলম জানান, জরিপে আমরা আরো দেখাতে পেয়েছি- বয়স বাড়ার সাথে সাথে শিশুদের দক্ষতা ও বিবেচনাবোধ তৈরি হয়। ৬ বছর থেকে স্কুলে যায়, এছাড়াও অনেক শিশু সাঁতার শিখতে শুরু করে। ফলে বয়স বাড়ার সাথে সাথে ডুব মৃত্যুর সংখ্যা কমতে থাকে।
মৃত্যুর কারণ : বাংলাদেশে পানিতে পড়ে শিশু মৃত্যুর কারণ হিসেবে সংস্থাটি আরো চিহ্নিত করেছে- বাংলাদেশে গ্রামীণ জনপদে বাড়িঘর তৈরি হয়েছে জল-জলাশয়কে কেন্দ্র করে। বসতভিটা উঁচু করা হয়েছে বন্যায় পানি থেকে বাঁচতে। কৃষিকাজ, রাস্তাঘাট উন্নয়নের জন্য খুঁড়তে হচ্ছে প্রতিদিন। এমনটি করতে গিয়ে খোড়া হয়েছে ডোবা। বাড়ির পাশের এসব উম্মুক্ত জলাশয়ে নেই কোনো নিরাপত্তায় বেষ্টনি। একপ্রকার বলা চলে, এখনো পর্যন্ত উম্মুক্ত জলাশয় যে শিশুদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ, কেউ তা বিবেচনায় নিচ্ছে না। এছাড়া ঈদসহ বিভিন্ন ছুটিতে শহরের বাসিন্দারা গ্রামে বেড়াতে যায়। তখন শিশুরা পানিতে পড়ে মৃত্যু সংখ্যা বাড়ে।
মৃত্যুহার কমাতে করণীয় : সিআইপিআরবি’র গবেষকরা বলেন, কমিউনিটি থেকে শুরু করে নীতি-নির্ধারণী মহলে কোনো সচেতনতা না থাকায় পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর হার প্রতিদিনই বাড়ছে। ৬-১০ বছরের শিশুদের সাঁতার শেখানো হলে এ মৃত্যু ৯৬ ভাগ কমিয়ে আনা সম্ভব।
এছাড়াও, ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের জন্য কমিউনিটিভিত্তিক শিশু যতœকেন্দ্রে তৈরি করা। বাড়ির আশপাশে পুকুর-জলাশয় থাকলে এরমধ্যে নিরাপদ বেস্টনি তৈরি করা। ৬ বছরের বেশি বয়সী শিশুদের নিরাপদ সাঁতার শেখার ব্যবস্থা করলে মর্মান্তিক এমন মৃত্যু ঠেকানো সম্ভব।
বাংলাধারা/এফএস/এআর













