২৩ অক্টোবর ২০২৫

চট্টগ্রাম মহানগরীর চার আসনে বিএনপির ভেতরেই লড়াই, মাঠে তৎপর জামায়াত

চারটি নির্বাচনী আসন নিয়ে গঠিত চট্টগ্রাম মহানগর। আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে মহানগরীর এসব আসন নিজেদের করে নিতে রাজনৈতিক দলের নেতারা ইতোমধ্যে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন।

যদিও ঐতিহ্যগতভাবে এসব আসনে বিএনপির প্রভাব বেশি, তবে মাঠ পর্যায়ে প্রচার-প্রচারণায় এগিয়ে রয়েছে জামায়াতে ইসলামি। দলটি ইতোমধ্যে একক প্রার্থী ঘোষণা করে গণসংযোগ, সভা-সমাবেশ ও নানা কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে।

অন্যদিকে, বিএনপির একাধিক মনোনয়নপ্রত্যাশী নিজেদের মধ্যে কোন্দলে জড়িয়ে পড়েছেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চট্টগ্রাম মহানগরীর চারটি আসনে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থীরা দলের হাইকমান্ডের নিকট দেনদরবার শুরু করেছেন। কেউ কেউ নিজ নিজ এলাকায় মিছিল-মিটিং করে অনুসারীদের চাঙ্গা রাখার চেষ্টাও চালিয়ে যাচ্ছেন।

দীর্ঘ ১৬ বছর পর জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিতে যাচ্ছে দলটি। এ কারণে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশীর সংখ্যা বেড়ে গেছে, যার ফলে বাড়ছে অভ্যন্তরীণ বিরোধও। যদিও নেতারা বলছেন, দীর্ঘদিন নির্বাচন আমেজ থেকে দূরে থাকায় কর্মীরা এবার বেশ উচ্ছ্বসিত। নির্বাচনের দিনক্ষণ চূড়ান্ত হলে তারা সব ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে দলীয় প্রার্থীর পক্ষে ঐক্যবদ্ধভাবে মাঠে কাজ করবেন বলে দাবি করছেন বিএনপি নেতারা।

চট্টগ্রাম আসন

চান্দগাঁও, বোয়ালখালী এবং পাঁচলাইশ এলাকার আংশিক অংশ নিয়ে গঠিত চট্টগ্রাম-৮ আসন। আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে এ আসনে তৎপর হয়ে উঠেছেন বিএনপির তিনজন মনোনয়নপ্রত্যাশী। তাঁদের মধ্যে দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক আবু সুফিয়ান এবং মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক এরশাদ উল্লাহকে সবচেয়ে শক্তিশালী প্রার্থী হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।

উল্লেখ্য, আবু সুফিয়ান এর আগে ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং পরবর্তীতে একটি উপনির্বাচনে বিএনপির মনোনীত প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন।

চট্টগ্রাম-৮ আসনের অন্যতম প্রধান সমস্যা হলো যাতায়াত ব্যবস্থা এবং জলাবদ্ধতা। দীর্ঘদিন ধরে কালুরঘাট সেতু না থাকায় বোয়ালখালীবাসী প্রতিদিন চরম দুর্ভোগের মুখে পড়ছেন। অপরদিকে, চান্দগাঁও ও পাঁচলাইশ এলাকার বড় অংশে বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধতা এখন নিয়মিত সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রতিটি নির্বাচনের সময় প্রার্থীরা এসব সমস্যার সমাধানের আশ্বাস দিলেও নির্বাচনের পর আর তাঁদের দেখা মেলে না। তবে ভোটারদের মাঝে এবার আশার সঞ্চার করেছে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সাম্প্রতিক চট্টগ্রাম সফর। তিনি কালুরঘাট সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর উদ্বোধন করেন, যা বোয়ালখালীবাসীর দীর্ঘদিনের প্রত্যাশার প্রতীক।

স্থানীয় ভোটারদের প্রত্যাশা, এবার এমন একজন জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হবেন, যিনি জলাবদ্ধতা নিরসনে বাস্তব পদক্ষেপ নেবেন এবং কালুরঘাট সেতুর কাজ বাস্তবায়নের পাশাপাশি স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নেও অগ্রণী ভূমিকা রাখবেন।

চট্টগ্রাম-৯ আসন

চট্টগ্রাম মহানগরীর গুরুত্বপূর্ণ আসন  হিসেবে পরিচিত কোতোয়ালী ও বাকলিয়া এলাকা নিয়ে গঠিত চট্টগ্রাম-৯ সংসদীয় আসন। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে এই আসনেও সরব বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশীরা। বর্তমানে আসনটি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র ডা. শাহাদাৎ হোসেনের ‘ঘাঁটি’ হিসেবে পরিচিত। ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে তিনি এখান থেকেই বিএনপির মনোনয়নে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন।

তবে এবার মনোনয়ন দৌড়ে তার পাশাপাশি রয়েছেন দলের কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান ও সাবেক মন্ত্রী মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দিন এবং মহানগর বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশেম বকর। এর মধ্যে বকর মাঠপর্যায়ে শুরু থেকেই বেশ সক্রিয়। এ ছাড়া প্রচারণায় যুক্ত হয়েছেন শিল্পপতি ও বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য শামসুল আলমও।

নগরবাসীর মতে, চট্টগ্রাম শহরের প্রাণকেন্দ্র এই চট্টগ্রাম-৯ আসন নানা নাগরিক সমস্যায় জর্জরিত। কোতোয়ালীর পুরোনো এলাকা ও ঘনবসতিপূর্ণ বাকলিয়ায় জলাবদ্ধতা ও ড্রেনেজ ব্যবস্থার বেহাল দশা বছরের পর বছর ধরে রয়ে গেছে। অপরদিকে ট্র্যাফিক জট, অপরাধ বৃদ্ধি, ছিনতাই ও ফুটপাত দখল এখন এই আসনের বাসিন্দাদের নিত্যদিনের ভোগান্তির কারণ। অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা ভবন ও সড়ক দখল জনজীবনকে করে তুলেছে দুর্বিষহ।

ভোটারদের প্রত্যাশা, এবার এমন একজন প্রার্থী আসবেন, যিনি হবেন কর্মঠ, সৎ ও স্বচ্ছ ভাবমূর্তির অধিকারী । যিনি দলীয় পরিচয়ের বাইরে গিয়ে সাধারণ মানুষের নাগরিক সুবিধা, আইনশৃঙ্খলা এবং একটি বাসযোগ্য শহর নিশ্চিতে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে পারবেন।

চট্টগ্রাম-১০ আসন

ডবলমুরিং, পাহাড়তলী, হালিশহর ও খুলশী এলাকা নিয়ে গঠিত চট্টগ্রাম-১০ আসনটি বিএনপির প্রয়াত ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল নোমানের দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। তাঁর মৃত্যুর পর আসনটির নেতৃত্বে আসার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন ছেলে সাঈদ আল নোমান। ইতোমধ্যে তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে বাবার অনুসারীদের সঙ্গে মাঠে নেমে পড়েছেন। পাশাপাশি, একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে শিক্ষিত, মার্জিত ভাবমূর্তিতে ভোটারদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন তিনি।

তবে আসনটি ঘিরে বিএনপির ভেতরে অন্য এক সমীকরণও তৈরি হয়েছে। চট্টগ্রাম-১১ আসনের সাবেক এমপি ও দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী নিজেই চট্টগ্রাম-১০ আসন থেকে নির্বাচন করার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। একইসঙ্গে তাঁর ছেলে ইসরাফিল খসরুও সক্রিয় হয়েছেন রাজনীতির মাঠে। কর্মীদের একাংশের ধারণা, শেষ পর্যন্ত আমীর খসরু মনোনয়ন না নিয়ে পিতার ছায়াতলে গড়ে ওঠা রাজনৈতিক কাঠামোর সুবিধা কাজে লাগিয়ে ইসরাফিল খসরুকে সাঈদ আল নোমানের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দাঁড় করাতে পারেন।

এই আসনের ভোটারদের বড় অংশ গার্মেন্টস শ্রমিক, নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও ভাসমান জনগোষ্ঠী। তাদের দাবি ন্যায্য মজুরি, নিরাপদ আবাসন এবং সর্বনিম্ন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা।

চট্টগ্রাম-১১ আসন

বন্দর, পতেঙ্গা, ইপিজেড ও সদরঘাট নিয়ে গঠিত চট্টগ্রাম-১১ আসনটি চট্টগ্রাম নগরের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি এলাকা। বিএনপির পক্ষ থেকে এই আসনে একক প্রার্থী হিসেবে বিবেচিত হচ্ছেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ও জাতীয় রাজনীতির অভিজ্ঞ মুখ আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। যদিও তিনি চট্টগ্রাম-১০ আসনেও সক্রিয় রয়েছেন, তবে নেতা-কর্মীদের মতে, শেষ পর্যন্ত চট্টগ্রাম-১১ আসন থেকেই তিনি নির্বাচন করবেন।

এই আস্থার কারণে এখন পর্যন্ত এ আসনে বিকল্প কোনো নেতা মনোনয়নপ্রত্যাশা প্রকাশ করেননি। বিএনপির স্থানীয় সংগঠনের একাধিক দায়িত্বশীল নেতা জানিয়েছেন, কেন্দ্রীয় নেতাদের নির্দেশনার অপেক্ষায় রয়েছেন তাঁরা।

আসনটির প্রধান জনদুর্ভোগগুলোর মধ্যে রয়েছে অবৈধ দখলে গড়ে ওঠা বসতি, বিশুদ্ধ পানির সংকট এবং হালিশহরের জনবহুল এলাকায় গ্যাস ও বিদ্যুৎ সমস্যার প্রকটতা। ভোটারদের অভিযোগ, আওয়ামী লীগ সরকারের সময় এই আসনের এমপি এম এ লতিফ এলাকার মানুষের চেয়ে চট্টগ্রাম চেম্বার-ভিত্তিক রাজনীতিতেই বেশি মনোযোগী ছিলেন। জনসাধারণের পাশে তাঁর ভূমিকা দৃশ্যমান ছিল না বলেই অভিযোগ অনেকের।

স্থানীয় ভোটারদের প্রত্যাশা, এবারের নির্বাচনে এমন একজন জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হবেন, যিনি পাহাড় রক্ষা, অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ, নাগরিক সেবা নিশ্চিতকরণ এবং পরিবেশবান্ধব নগর গঠনে কার্যকর ভূমিকা রাখবেন।

চট্টগ্রাম আন্ঞ্চলিক নির্বাচন অফিসের সর্বশেষ তথ্যনুযায়ী মহানগরীর চারটি আসনে ভোটার সংখ্যা প্রায় সংখ্যা ২০ লাখের বেশি।

এআরই/বাংলাধারা

আরও পড়ুন