২৪ অক্টোবর ২০২৫

জজের পরিবারের জমিদখলে ‘মুজিবনগর’ নামে রাতারাতি আশ্রয়ণ

সায়ীদ আলমগীর  »

বৃটিশ আমলে বন্দোবস্তি পাওয়া এক সহকারি জজের পরিবারের চাষী জমি দখল করতে ‘মুজিবনগর’ নাম দিয়ে ‘ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারের আশ্রয়ন’ উল্লেখে ব্যানার টানিয়ে ঝুপড়ি ঘর তুলেছেন এক ইউপি মেম্বার ও তার বড়ভাই। দখল সহজতর করতে ব্যানারে দেয়া হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্র সজিব ওয়াজেদ জয়, কক্সবাজার সদর আসনের সাংসদ সাইমুম সরওয়ার কমল ও জেলা আওয়ামীলীগ সাধারণ সম্পাদক পৌর মেয়র মুজিবুর রহমানের ছবি। লেখা হয়েছে- মুজিবর্ষের অঙ্গীকার, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপহার। আশ্রয়নের উদ্যোক্তা ও সৌজন্যে কামাল উদ্দিন কামাল লিখে চাটানো হয়েছে নিজের ছবিও। কক্সবাজার সদরের খুরুশকুল ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ডের তেতৈয়া ‘রফিকের ঘোনা’ নামক এলাকায় এ ঘটনাটি ঘটেছে। এতে সদর উপজেলা সহকারি কমিশনারের (এসি-ল্যান্ড) ইন্দন থাকার অভিযোগ উঠায় এ নিয়ে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে।

দখলপ্রচেষ্টা চলা জমির বন্দোবস্তি মালিক খুরুশকুল তেতৈয়া এলাকার বাসিন্দা মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও তৎকালীন বৃটিশ-ভারতের ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের ফৌজ আর্মি সদস্য মৃত আবুল হোসেন। উত্তরাধিকার সূত্রে এ জমির বর্তমান মালিক চট্টগ্রাম আদালতে কর্মরত সিনিয়র সহকারি জজ কামাল উদ্দিন, হাইকোর্টের আইনজীবী বোরহান উদ্দিন রব্বানীদের পাঁচ পরিবার। তাদেরকে জামায়াত-বিএনপি পরিবার বলে প্রচার করছেন দখলকাররা।

সিনিয়র সহকারি জজ কামাল উদ্দিনের বাবা স্থানীয় ওয়ার্ড আওয়ামীলীগ সভাপতি রফিকুল ইসলাম (৭০) জানান, বৃটিশ আমল থেকে খুরুশকুল মৌজার বি.এস ৩৯৮নং খতিয়ানের বি.এস ৪৪৬৬ দাগের ৩ একর ৪৪ শতক জমি আমার বাবার নামে বন্দোবস্তি। তখন থেকে সন সন খাজনা দিয়ে সেই জমির অর্ধেকে আমন-বোরো চাষ আর অর্ধেকে মৌসুমী নানা শস্য ফলিয়ে পরিবারের খোরাক যোগানো হয়ে আসছে। ‘রফিকের ঘোনা’ বলে পরিচিত এসব জমির আশপাশের পাহাড়ে করা হয়েছে বনবিভাগের সামাজিক বনায়ন। কিন্তু সম্প্রতি সেই সামাজিক বনায়ন স্থলে কক্সবাজার বিমানবন্দর এলাকা হতে উচ্ছেদে পড়া জলবায়ু উদ্বাস্তু শতাধিক পরিবারকে পুনর্বাসন করার জন্য স্থান নির্ধারণ করা হয়। রফিকের ঘোনার সামাজিক বনায়ন ও পাহাড়ি জমি রক্ষায় বনায়নের উপকারভোগীদের পক্ষে মিজানুর রহমান নামে একজন হাইকোর্টে রিট পিটিশন দায়ের করেন (পিটিশন নং-৪১৭০/২০২১)। তা গ্রহণ করে বনে আশ্রয়ণ প্রকল্পে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে উচ্চ আদালত।

তিনি আরো জানান, সেটি জানার পর স্থানীয় সাংসদ ও জেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদকের নাম ভাঙ্গিয়ে স্থানীয় ইউপি সদস্য শেখ কামাল ও তার বড়ভাই কামাল উদ্দিন কামালের নেতৃত্বে একটি চক্র ১১ এপ্রিল রাতের আধারে আমাদের সবজি ক্ষেতের জমিতে দু’ডজনাধিক ঝুপড়িঘর তৈরী করে। এসময় সশস্ত্র দুর্বৃত্তরা সবজি ক্ষেতের ফলনসহ নানা পণ্যের চারা উপড়ে ফেলে। বিষয়টা প্রশাসনকে অবগত করা হলেও এখনো কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।

অভিযুক্ত ইউপি সদস্য শেখ কামাল বলেন, জায়গাটি ব্রিটিশ আমল থেকেই রফিকুল ইসলামের পরিবার ভোগ দখল করে আসছেন সেটা ঠিক। আমরা এতদিন জানতাম জায়গাটি জোত। কিন্তু সদর এসিল্যান্ড নিশ্চিত করেছেন জমিটি খাস খতিয়ান ভুক্ত। এটি জানার পরই স্থানীয় গৃহহীনদের ঘর করে দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। যারা ঘর করেছেন তাদের কারোরই নিজস্বঘর নেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা না বলা পর্যন্ত এরা কেউ দখল ছেড়ে যাবে না। জমিটি ‘বন্দোবস্তি’ প্রমাণ করতে পারলে সবাই উঠে যাবে।

সরেজমিন দেখা গেছে, চাষি জমিতে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আদলে ২৭টি ঝুপড়ি ঘর তোলা হয়েছে। কাজ চলছে আরো ২০-২৫টি ঘর তৈরীর। প্রশাসনিক বাধা রোধ করতে প্রথম ঘরটির বেড়ায় বঙ্গবন্ধু, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সজিব ওয়াজেদ জয়ের ছবির পাশাপাশি স্থানীয় সাংসদ কমল ও জেলা আওয়াগীলীগের সাধারণ সম্পাদক ও পৌর মেয়র মুজিবের ছবিসহ মুজিববর্ষের শ্লোগান সম্বলিত আশ্রয়ণ প্রকল্পের ব্যানার চাটানো হয়েছে। এর উদ্যোক্তা হিসেবে অভিযুক্ত কামাল উদ্দীন কামালের ছবিও এতে লাগানো রয়েছে। ঝুপড়ির মাঝখানেও টানানো হয়েছে আরেকটি ব্যানার। দখল বুঝাতে বসানো হয়েছে দুটি নলকূপ। রাতে আলোর জন্য তার টেনে দেয়া হয়েছে একাধিক লাইট।

জিজ্ঞাসাবাদে স্থানীয় অনেকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এখানে দখলে আসা অধিকাংশের বাড়ি ভিন্ন ওয়ার্ডে আর তাদের পূর্ব থেকে জমি-জমা ও ঘর রয়েছে। ভাড়াটিয়া ও নতুন করে ভিটা গড়তে উদ্যোক্তাদের টাকা দিয়ে অনেকে দখলে শরিক হয়েছেন। জমিতে সবজি ক্ষেত নষ্ট করার চিহ্ন স্পষ্ট।

অসমর্থিত অপর সূত্র জানায়, আশ্রয়ণ প্রকল্পে ঘর দেয়ার আশ্বাসে অনেকের কাছ থেকে ১০ থেকে ৪০ হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়েছে স্থানীয় ইউপি, তার বড়ভাইসহ একটি সংজ্ঞবদ্ধ চক্র। উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞার কারণে আশ্রয়ণ প্রকল্প আটকে যাওয়ায় বিপাকে পড়েন তারা। ফলে নিরুপায় হয়ে রফিকের ঘোনার সবজি ক্ষেতের জমি দখলের পায়তারা চালানো হয়।

স্বঘোষিত আশ্রয়ন উদ্যোক্তা দাবিদার কামাল উদ্দীন কামাল টাকা নেয়ার বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, আদালতের নিষেধাজ্ঞা বা কি আছে সেটি অবিবেচ্য। এ আশ্রয়ণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে জেল-ফাঁসি হলেও আমার কোন আপত্তি নেই।

খুরুশকুল ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান জসিম উদ্দীন বলেন, আমার পরিষদের এক নম্বর ওয়ার্ড সদস্য বিচারক কামাল উদ্দিন পরিবারের চাষিজমি জবরদখলের পায়তারার বিষয়টি জেনেছি। কামালের পূর্ব-পুরুষরা ইউনিয়নে আওয়ামীলীগের প্রতিষ্টাতা বলা চলে। তার বাবা রফিক বর্তমানে আওয়ামী লীগের ওয়ার্ড সভাপতি। তাদের জমি দখলের বিষয়টি সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে অবগত করেছিলাম।

জেলা আওয়ামীলীগ সাধারণ সম্পাদক ও পৌর মেয়র মুজিবুর রহমান বলেন, শেখ কামালকে পছন্দ করি বলে খেয়ে না খেয়ে সাহায্য সহযোগীতা করি। এটার মানে এই নয়, আমার নাম ব্যবহার করে অপরাধ করবে। কোন জমি দখলের সাথে আমি জড়িত নয়। বিষয়টা খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

নিজের ছবি টানিয়ে জমি দখলের বিষয়ে জানতে সাংসদ সাইমুম সরওয়ার কমলের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হয়। রিং হলেও ফোন না ধরায় অভিযোগের বিষয় উল্লেখ করে খুদেবার্তা পাঠানো হয়। কিন্তু তাতেও সাড়া দেননি এমপি।

কক্সবাজার সদর সহকারী কমিশনার (ভূমি) নু-এমং মারমার মং উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা অমান্যে দখলদারদের উস্কানির বিষয়টা অস্বীকার করে বলেন, মহামান্য হাইকোর্টের নির্দেশনার পর এ বিষয়ে আমি আর মাথা ঘামায়নি।

বাংলাধারা/এফএস/এআর

আরও পড়ুন