২৯ অক্টোবর ২০২৫

জোরারগঞ্জে যত্রতত্র বর্জ্য, আবাদি জমিতে অপরিকল্পিত আবাসস্থল

মিরসরাই প্রতিনিধি »

মিরসরাই উপজেলার শিক্ষানগরী নামে খ্যাত জোরারগঞ্জে সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েই চলেছে আবাসন স্থল, দোকানপাট ও জনসংখ্যা। কিন্তু পরিকল্পিত নগরায়ন আর সচেতনার অভাবে প্রতিনিয়ত হুমকির মুখে পড়ছে এখানকার পরিবেশ।

জোরারগঞ্জ বাজারের উত্তর-পূর্বে ঢাকা-চট্টগ্রাম পুরাতন মহাসড়কের পাশে বয়ে গেছে বারোমাসি চরা নামে একটি খাল। যেটি মিলিত হয়েছে সরাসরি ফেনী নদীতে গিয়ে।প্রতিদিন খালটির দেড় কিলোমিটার প্রতিনিয়ত দূষিত হচ্ছে এখানে গড়ে ওঠা ভবনগুলোতে বসবাসরত বাসিন্দাদের ফেলা দেওয়া ময়লা আবর্জনায়।

শুধু তাই নয় এখানে খালের পাশে গড়ে ওঠেছে পশু জবাইয়ের স্থান। যেখানে প্রতিদিন জবাই হয় ৪ থেকে ৫টি গরু ও মহিষ। জবাইকৃত পশুর বর্জ্যের গন্ধে অতিষ্ট এলাকাবাসী। এছাড়া এখানে প্রকৃত পয়ঃনিষ্কাশনের কোনো ব্যবস্থা চোখে পড়েনি। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে এমন পরিবেশ দূষণ নেক্কারজনক বলে জানিয়েছেন এলাকাবাসী।

জোরারগঞ্জের স্থায়ী বাসিন্দা ফেনী সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী আল হাসান সাকিব জানান, গ্রীষ্মকালে বর্জ্যের গন্ধে বরাবরই অতিষ্ট হয়ে উঠি আমরা। প্রতিদিন এ সড়ক দিয়ে হাজার হাজার শিক্ষার্থী ও পথচারী চলাফেরার পাশাপাশি জোরারগঞ্জ ইউনিয়নে মধ্যম সোনাপাহাড় গ্রামের মানুষজন নিয়মিত চলাচল করে থাকেন।

এমতাবস্থায় সারাবছরই বর্জ্যের দুর্গন্ধে জনসাধারণের নাক চেপে চলাফেরা করতে হয়। শুধু তাই নয়, ঠিক তার ২০ ফুট উত্তরে ও পূর্বে গড়ে উঠেছে আবাসস্থল। সেখানকার বাসিন্দাদের প্রতিদিনকার আবর্জনাও গিলে নিতে হচ্ছে খালটিকে। বছরের পর বছর এ অবস্থায় অনেকটা অস্বাভাবিক হয়ে পড়েছে খালের পানির প্রবাহ।

এমনই চিত্র জোরারগঞ্জ বাজার থেকে উত্তর দিকের শেষ অংশের। এবার খালের প্রবাহ অনুসারে চলতে গেলে যেতে হবে জোরারগঞ্জ-বাংলা বাজার রোডে, যেখানে অবস্থিত বৈদ্য কমপ্লেক্সসহ আরো কয়েকটি বহুতল আবাস্থলের ঐদিকটায়। যেখানকার চিত্র আরো ভয়াবহ। খালের পাশে গড়ে উঠেছে অস্বাস্থ্যকর টয়লেট।

তাছাড়া এখানকার ভবনগুলোতে বাসিন্দাদের ফেলা আবর্জনা আর খালের পানি প্রায় একাকার হয়ে গেছে। তারপর সেই বারোমাসি খাল জোরারগঞ্জ টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার কলেজের ভিতর দিয়ে সেটি এসে জোরারগঞ্জ মুহুরী প্রজেক্ট রাস্তার পাশ ঘেঁষে বয়ে প্রায় ১ কিলোমিটার পর্যন্ত বয়ে চলেছে। সেখানকার অবস্থা আরো নাজেহাল। খালের দক্ষিণ পাশে গড়ে উঠেছে ফারুক মঞ্জিল, সুবেদার পার্ক ও উত্তর পাশে গড়ে উঠেছে ডিএইচ প্লেইসসহ আরো নাম না জানা বেশ কয়েকটি বহুতল ভবন।

এসব ভবনগুলোতে প্রায় শ’খানেক পরিবারের বসবাস। যাদের নিত্য অপ্রয়োজনীয় সব আবর্জনা প্রতিনিয়ত দূষিত করে নষ্ট করছে খালের পানির নাব্যতা। আর আবর্জনার দুর্গন্ধে দাঁড়ানোর যায় না। এ জোরারগঞ্জ-মুহুরী প্রজেক্ট সড়ক মুহুরী সেঁচ প্রকল্পে, পর্যটন শিল্পের অন্যতম ফেনী নদীর সুইচ গেইট যাওয়ার প্রধান সড়ক এবং মিরসরাই ইকোনোমিক জোনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সড়ক।

এছাড়া এ খালের উত্তর পাশে অবস্থিত ভগবতীপুর গ্রাম এবং দক্ষিণে পশ্চিম সোনাপাহাড়, গোপীনাথপুর, গোবিন্দপুর, ইছামতীসহ আরো কয়কটি এলাকা। এসব এলাকায় প্রায় দুই হাজার মানুষের বসবাস, যাদের প্রধান যোগাযোগ সংযোগ হিসেবে ব্যবহৃত এ রাস্তাটি। সড়কটির পাশে এমন দুর্গন্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন এলাকাবাসী, তারা অতিদ্রুত এসবের পরিত্রাণ চান।

জোরারগঞ্জ ইউনিয়নের ভগবতীপুর গ্রামের নিজামপুর সরকারি কলেজের অনার্স তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী সেফায়েত হোসেন জানান, আগে এ খালটিতে প্রচুর মাছ পাওয়া যেত এবং অনেকে এখানে জাল ফেলে মাছ ধরতো। বর্তমানে এখানে খালের পাশে আবাসস্থল গড়ে ওঠার ফলে দূষিত পানি এবং আবর্জনার দুর্গন্ধে রাস্তায় চলাফেলার এলাকাবাসীকে বেকায়দায় পড়তে হয়।

জোরারগঞ্জে স্কুল কলেজসহ ৯টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থাকায় এখানে দিন দিন অস্থায়ী বাসিন্দাদের চাহিদার প্রেক্ষিতে গড়ে উঠেছে প্রায় ২০০টির ও বেশি একতলা এবং বহুতল আবাস্থল। যার ফলে এসব আবাসস্থলে বসবাস করেন প্রায় হাজার খানেক পরিবার।

নাম প্রকাশ করতে অনিচ্ছুক এলাকার এক বাসার নিরপত্তাকর্মী জানান, জোরারগঞ্জ বাজারে অবস্থিত স্থায়ী এবং অস্থায়ী বিল্ডিংগুলোর বাসিন্দাদের আবর্জনাগুলো তাদের ফেলতে হয় খালের পানিতে। এখানে আর বিকল্প কোনো ব্যবস্থা নেই। নেই রিসাইকেলিং এবং আবর্জনা নিষ্কাশন ব্যবস্থা। আবার এসব আবাস্থলের অধিকাংশ গড়ে উঠেছে আবাদি জমিগুলোতে। যেখানে আগে বারো মাস চাষবাস হতো সেখানে এখন গড়ে উঠেছে বহুতল ভবন। যার ফলে নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবার যারা কৃষির উপর নির্ভরশীল তাদের পরিবার আজ অসহায় হয়ে পড়েছে। দিনের পর দিন বাসা বাড়ির চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় আরো আবাসস্থল গড়ে উঠছে আবাদ জমিগুলোতে।

ইছামতী এলাকার কৃষক কালাম আলী জানান, এখন মানুষের কৃষি নির্ভরশীলতা কমে গেছে। যে যেখানে পারছে ইচ্ছেমাতো গড়ে তুলছে একের পর এক ভবন। এভাবে নষ্ট হচ্ছে কৃষকের আবাদি জমি।

জোরারগঞ্জ ইউনিয়নের বাসিন্দা মানারাত চৌধুরী জানান, জোরারগঞ্জ সম্ভাবনাময় একটি জায়গা এখানে সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে অনেক কিছু বেড়েছে এবং উন্নতি সাধন হয়েছে। অতিদ্রুত এটি একটি শহরে পরিণত হবে। এখন থেকে আমাদের পরিকল্পিত নগরায়নের জন্য পরিকল্পনা গ্রহন করতে হবে। কোনোভাবেই আবাদ জমি নষ্ট করা যাবে না।

তিনি আরো বলেন, চট্টগ্রামের রাজনৈতিক অভিভাবক ইঞ্জিনিয়ার মোশারফ হোসেনের স্বপ্নের মিরসরাই ইকোনোমিক জোনের অন্যতম সংযোগ সড়ক জোরারগঞ্জে এসে মিশেছে। ইকোনমিক জোনে প্রায় ৩০ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হবে। সেটির প্রভাব আমাদের জোরারগঞ্জে এসে পড়বে এবং এটি আমাদের উপজেলা একমাত্র শিক্ষানগরী।তাই এখন থেকে পরিকল্পনা প্রণয়ন অত্যন্ত জরুরি।

জোরারগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মুকছুদ আহমেদ চৌধুরী বলেন, বিভিন্ন পৌরসভার এবং সিটি কর্পোরেশনগুলোতে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য পর্যাপ্ত জায়গা থাকলেও আমাদের সেটি না থাকায় ইউনিয়ন পরিষদকে বর্জ্য এবং আবর্জনা নিষ্কাশনের জন্য বিড়ম্বনায় পড়তে হয়।

তিনি আরো বলেন, জোরারগঞ্জে অপরিকল্পিত আবাসস্থল কিংবা আবাদি জমি ভরাট করে আবাসস্থল গড়ে উঠলে সেটি পরিবেশ এবং বন অধিদপ্তরের বিষয়।

বাংলাধারা/এফএস/টিএম/এএ

আরও পড়ুন