মাকসুদ আহম্মদ, বিশেষ প্রতিবেদক»
লাল-সবুজ পতাকার আদলে ইন্দেনেশিয়া থেকে ট্রেনের কোচ আমদানী করা হয় ২০১৬ সালে। ১০০ মিটারগেজ কোচ ক্রয়ের ২০১৪ সালের চুক্তি করা হয়। কোচগুলো যাত্রীসেবার মাত্র দুই মাসের মাথায় ৩৫টি ত্রুটি ধরা পড়লেও এখনও সমাধান মিলেনি। এমনকি কোন ধরনের ক্ষতিপূণ দেয়নি ইন্দোনেশিয়ার ইনকা পিটি ইন্ডাস্ট্রী কারিটা এপিআই(পার্সিরো)। অভিযোগ রয়েছে ইন্দোনেশিয়ার প্রথম চুক্তির ১৫০ টি কোচ ট্রায়াল শেষে ২০১৭ সালে চলাচল শুরু করার মাত্র দুই মাসের মধ্যে ৩৫টি বিভিন্ন ত্রæটি দেখা দেয়। এই কোচগুলোতে ত্রুটির বিষয় জানিয়ে একটি চিঠি প্রেরণ করা হয় ইন্দোনেশিয়ার প্রজেক্ট ম্যানেজার মি.সুটোরো’র কাছে বিআর/এডিবি-২/৫০বিজি এর ব্যাপারে ২০১৭ সালের ৩ আগস্ট । আরো অভিযোগ উঠেছে, আগের ১৫০ টি কোচের ৩৫টি ত্রæটি সারানোর আগেই আবার ২০০ নতুন কোচের চুক্তি করা হয়।

প্রকল্প পরিচালকের দফতর সূত্রে জানা গেছে, ইন্দোনেশিয়া থেকে ২০০টি স্টিলবডির যাত্রীবাহি মিটারগেজ কোচ আমদানীর চুক্তি স্বাক্ষর হয় ২০১৭ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর। ঢাকাস্থ রেল ভবনে বাংলাদেশ রেলওয়ের সঙ্গে ইন্দোনেশিয়ার ইনকা পিটি ইন্ডাস্ট্রী কারিটা এপিআই(পার্সিরো)। ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে ৭৩ দশমিক ৯০ মিলিয়ন ইউ এস ডলার বা ৫৭৯ কোটি ৩৮ লাখ ৯৭ হাজার টাকায় এ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। প্রত্যেকটি কোচের দাম পড়েছে প্রায় ৩ কোটি ১১ লাখ টাকা। তবে চুক্তিতে ২০ হতে ৩৩ মাসের মধ্যে কোচ সরবরাহের কথা ছিল। এ প্রকল্পে অর্থায়ন করা হয়েছে এশিয়ান ডেভলপমেন্ট ব্যাংক(এডিবি) ও সরকারের নিজস্ব ফান্ড থেকে।
ত্রæটি সংশোধনের বিষয়ে নিশ্চয়তা দিয়ে এই প্রজেক্ট ম্যানেজারের এর পক্ষ থেকে আরেকটি চিঠি ইনকা-বিআর-২/০০৮/২০১৭ প্রেরণ করা হয় ২০১৭ সালের ১১ আগস্ট। ট্রেন চলাচলের মাত্র ২ মাসের মধ্যে প্রথমে ১৪টি ত্রুটি দেখিয়ে তৎকালীন রেলের পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান বাণিজ্যিক কর্মকর্তা সরদার শাহদাত আলীর পক্ষ থেকে রেলের ডিরেক্টর জেনারেল(ডিজি) বরাবর লিখিত অভিযোগ করা হয়। ফলে রেল সংসদীয় কমিটির চেয়ারম্যান এ বি এম ফজলে করিম এমপি’র সভাপতিত্বে আয়োজিত এক বৈঠকের সিদ্ধান্তে ইন্দোনেশিয়ার প্রজেক্ট ম্যানেজার বরাবর চিঠি লেখা হয়।

বাংলাদেশ রেলওয়ের পক্ষে তৎকালীন অতিরিক্ত মহাপরিচালক(আর এস/ রোলিং স্টক) ও ইন্দোনেশিয়ার ইনকা পিটি ইন্ডাস্ট্রিজ এর পক্ষে আর আগুস এইচ পুরনোমা। চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন তৎকালীন রেল মন্ত্রী মুজিবুল হক। এসময় অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রদূত রিনা পি সোয়েমার্নো ও রেলের তৎকালীন মহাপরিচালক আমজাদ হোসেনসহ প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী হারুন অর রশীদ।

উল্ল্যেখ থাকে যে, এর আগে ইন্দোনেশিয়ার এই প্রতিষ্ঠানটি ২০১২ সালের আরেকটি চুক্তিতে এক হাজার ৮২ কোটি টাকায় ১০০টি মিটারগেজ ও ৫০টি ব্রডগেজ কোচ সরবরাহ করে। এই প্রকল্পের অর্থ এডিবি ৮০০ কোটি টাকা ও সরকার ২৮২ কোটি টাকা সরবরাহ করে। ২০১৬ সালে এসব কোচ সরবরাহ শেষ করে ইন্দোনেশিয়ার ইনকা পিটি। এদিকে, ৩৫টি ত্রæটি দেখা দেয়ার কারনে ২০১৭ সালের ৩০ আগস্ট তারিখে ইন্দোনেশিয়ার ইনকা পিটি এর প্রকল্প ব্যবস্থাপক মি.সুটোরো বরাবর একটি চিঠি পাঠানো হয়।ওই চিঠিতে উল্ল্যেখ করা হয়েছে, ১০০ এমজি কোচের চুক্তি নং-বিআর/এডিবি/১০০ এমজি এবং ৫০ বিজি কোচের চুক্তি নং- বিআর/এডিবি/৫০বিজি ক্যারেজ এর আওতায় দুটি চুক্তিপত্র স্বাক্ষরিত হয় ২০১৪ সালের ২৭ নভেম্বর। এই দুটি চুক্তির আওতায় আসা ১৫০ ইন্দোনেশিয়ান কোচ প্রত্যেকটিতে প্রায় ৩৫ ধরনের ত্রুটি রয়েছে।
এসব ত্রæটি গুলোর মধ্যে রয়েছে, টয়লেটের কমোড, বেসিন, দরজা ও ফ্লোরসহ ৯টি সমস্যা। কোচের দরজা, বডি, জানালা ও কোচের ভেতরে সমস্যা রয়েছে ১২টি। এসি ও ননএসি বার্থ গুলোতেও সিট ও টেবিল এমনকি লকগুলোসহ আটটি সমস্যা রয়েছে। বৈদুতিক ত্রæটির কারনে বিদ্যুৎ সরবরাহে ৯টি সমস্যা দেখা দিয়েছে। ফলে এসিগুলো ঠিকভাবে কাজ করছে না। এসি কোচের ভেতরে বাতাসের শব্দ ও চাকার শব্দ পাওয়া যায়। এছাড়াও এসির কম্প্রেসারের শব্দে অনেক সময় মাথা ব্যাথা করে যাত্রীদের।

এদিকে, নন এসি কোচের জানালায় এল্যুমিনিয়াম সাটার নেই। ফলে পাথর নিক্ষেপের ঘটনা ঘটলে রক্ষা নেই যাত্রীদের। এছাড়াও প্রত্যেক সিটের সামনে থাকা বোতলের খাঁচা ছোট, তরল সাবানের বোতলের সুইচ কাজ করছেনা ও টয়লেট টিস্যু হোল্ডার মান সম্মত নয়। দুটি কোচের মধ্যে ভেতরে চলাচলের জন্য স্থাপিত গ্যাংওয়ে ব্রীজে যাত্রীদের হোঁচট খাওয়ার উপক্রম, বার্থ এর ভেতরে উপরের সিটে উঠার সিঁড়িটি ভুল লাগানো হয়েছে, বার্থের ভেতরে লাগানো লুকিং গ্লাসগুলো নিম্নমানের ও প্লাস্টিকের ষ্ক্রু দিয়ে লাগানোর ফলে ২ মাস যেতে না যেতেই অনেক গুলো গ্লাস ফ্রেমসহ খুলে পড়ার ঘটনা ঘটেছে। টয়লেটের সাইজ ছোট, হাই কমোডের ফ্ল্যাশ সিস্টেম ভাল নয়, টয়লেটের দরজায় দেয়া ইন্ডিকেটর কাজ করেনা, টয়লেটের কর্ণার বেসিনটি লাগানো হয়েছে গ্লু বা গাম দিয়ে, প্যান কমোডের মেঝের ড্রেইন পাইপটি সরু হওয়ার কারনে মেঝেতে সহজে টয়লেটের পানি নির্গত হয় না, প্রতিবন্ধীদের টয়লেটের দরজা নড়ে গেছে, হাই কমোডের পানির ছিটকা গায়ে পড়ে, নামাজ কক্ষের পাশে অজুখানা নেই।
বাংলাধারা/এফএস/এফএস













