সায়ীদ আলমগীর, কক্সবাজার»
কক্সবাজারের আদালত এলাকা থেকে তুলে নিয়ে তরুণীকে ‘দলবদ্ধ ধর্ষণ’ ঘটনায় অভিযুক্তদের মাঝে তিনজনকে অবশেষে গ্রেফতার করেছে র্যাব-১৫ কক্সবাজার ব্যাটালিয়ন। তাদের স্বীকারোক্তি মতে একটি পিস্তল ও ৯টি দেশীয় আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার হয়েছে বলে জানিয়েছেন র্যাব-১৫ এর অধিনায়ক লে. কর্ণেল খায়রুল ইসলাম সরকার। শুক্রবার (২৫ মার্চ) দিনগত গভীর রাতে ঈদগাঁও এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের আটক করা হয়েছে বলে উল্লেখ করেন র্যাব-১৫ এর এ কর্তা।
কিন্তু, তিনজন গ্রেফতার হলেও দ্বিতীয় অভিযুক্ত রাসেল উদ্দিন পুলিশের নাকের ডগায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
১৫ মার্চ ঈদগাঁওর এক তরুণী তাকে কক্সবাজার আদালত এলাকা হতে তুলে নিয়ে পার্শবতী বাহারছরায় অভিযুক্তদের আত্মীয়ের বাসায় নিয়ে প্রহার ও ধর্ষণের অভিযোগে কক্সবাজার সদর মডেল থানায় মামলা করেছেন। ১৪ মার্চ বিকেলে এ ঘটনা ঘটে বলে এজাহারে উল্লেখ করা হয়। মামলায় চারজনের নাম উল্লেখ এবং অজ্ঞাতনামা পাঁচজনসহ ৯ জনকে আসামি করা হয়েছে।
সেই মামলার প্রধান অভিযুক্ত কক্সবাজারের ঈদগাঁও উপজেলার পোকখালীর রমজান আলী মেম্বারের ছেলে ফিরোজ আহমদ, তার নিকটাত্মীয় পোকখালীর দোলা মিয়ার ছেলে নুরুল ইসলাম ও একই উপজেলার ইসলামপুরের গণি সওদাগরের ছেলে মো. শরীফকে গ্রেফতার করেছে র্যাব-১৫। মামলার প্রত্যক্ষ অপর আসামী রাসেল উদ্দিন পলাতক রয়েছে।
শনিবার দুপুরে র্যাব-১৫ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল খাইরুল ইসলাম সরকার সংবাদ সম্মেলনে বলেন, গত ১৪ মার্চ কক্সবাজার আদালত পাড়া হতে এক মহিলাকে তু্লে নিয়ে কতিপয় দুর্বৃত্ত পালাক্রমে ধর্ষণ করেন। পরবর্তী উল্লেখিত স্থান হতে পুলিশ ভিকটিমকে উদ্ধার করে। কক্সবাজার সদর থানায় ভিকটিম মামলা রুজু করলে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ছায়াতদন্ত শুরু করা হয়।খবর আসে তরুণীকে মামলায় অভিযুক্তরা এলাকায় প্রভাব ও প্রতাপশালী। তারা অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে অবৈধ অস্ত্র ব্যবহার করছেন। সোর্স ও প্রযুক্তির মাধ্যমে তাদের অবস্থান সনাক্ত হয়ে অভিযান চালানো হয়। তাদের আটকের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে একটি পিস্তলসহ আরো ৯টি দেশীয় আগ্নেয়াস্ত্র তাদের দেখানো মতে উদ্ধার করা হয়।
লে. কর্ণেল খায়রুল ইসলাম সরকার আরো বলেন, তদন্ত চলাকালীন এ মামলার আসামি শরীফ প্রকাশ শরীফ কোম্পানি, ফিরোজ ওরফে মোস্তাক ডাকাতদের কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য আমাদের কাছে আসে।
আসামি শরীফের রেকর্ড পর্যালোচনায় দেখা যায়, তিনি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পরিস্থিতি বিবেচনা করে অত্যন্ত সুকৌশলে বারংবার তার রাজনৈতিক মতাদর্শ পরিবর্তন করে রাজনৈতিক ফায়দা লুটার চেষ্টা করেছেন। ২০১৪ সালের ১২ নভেম্বর ইসলামপুর ইউনিয়নের বটতলীস্থ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের অফিস দখল করে। সেই অফিসে থাকা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রীর ছবি ভাঙচুর করে। পরবর্তী এ সংক্রান্ত মামলায় আসামি হয়। এখন আবার রাজনৈতিক পল্টিতে আওয়ামী লীগের নেতা তিনি।
অপরদিকে, প্রধান অভিযুক্ত গ্রেফতার আসামি ফিরোজ ওরফে মুস্তাক ডাকাত মূলত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের একজন প্রসিদ্ধ ঢাকাত। কুখ্যাত ডাকাত সর্দার হিসেবে ইতিপূর্বে তিনি কক্সবাজার-চট্টগ্রাম মহাসড়কের শতাধিক ডাকাতি সংঘটিত করেছে। ১৯৯৬ সালে গোমাতলী হাফেজ মিয়ার ঘোনা দখলে অংশ নিয়ে একাধিক হত্যা, হত্যা চেষ্টা ও অস্ত্র মামলার আসামি। ১৯৯৭ সালে খুটাখালী বাজারে ডাকাতিকালে স্থানীয় জনতার হাতে অস্ত্রসহ আটকের পর গণধোলাই দুয়ে পুলিশে সোপর্দ করা হয়। যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামী হয়ে ১২ বছর জেল খেটে আপিল করে জামিন পেয়ে স্থানীয় পুলিশ ফাঁড়িতে হাজিরা দেওয়ার শর্তে মুক্তি পায়। মোস্তাক হতে ২০০৮ সালে ফিরোজ আহমেদ নাম ধারণ করে এনআইডি কার্ড করে ডাকাত মোস্তাক। এ ফিরোজ ২০১৪-১৫ সালে সাগরপথে মালয়েশিয়ায় মানব পাচার করে। শরিফ- ফিরোজরা সংঘটিত হয়ে সোনালী এন্টারপ্রাইজ নামে সিন্ডিকেট করে এলাকায় জমি দখল, বন দখল, ভূমি দখল, গাছ চুরি করে বিক্রিসহ নানা কর্মকাণ্ডে লিপ্ত ছিল। শরীফ-ফিরোজরা এতটাই ভয়ংকর যে তাদের বিরুদ্ধে এলাকায় কেউ টুঁ-শব্দটিও করে না। কেউ করে থাকলে তাদের সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে শায়েস্তা করানো হয়। তেমনি একজন ভুক্তভোগী ইদ্রিস। তাকে ধরে নিয়ে দুই হাতের কব্জি কেটে নেয় শরীফ। জেলার সরকার দলীয় এক নেতাকে হত্যার চক এঁকে অপারেশন চালিয়েও ব্যর্থ হন শরীফ। তার অধিকাংশ অপরাধ কর্মের অডিও র্যাবের হাতে এসেছে।
তিনি আরো জানান, এলাকায় ছোট বাচ্চা এবং মহিলাদের নিয়ে খুচরা ও পাইকারি মাদক বিক্রি করাতো ফিরোজ। তার সিন্ডিকেটের অনেকে বেশ কয়েকবার মাদকসহ গ্রেফতার হয়েছিল। ১৪ মার্চে সংঘটিত ধর্ষণকাণ্ডে ভিকটিমের সাথে বৈবাহিক অবস্থা প্রমাণ করতে একটি ভুয়া কাবিননামা তৈরি করে গোপন কক্ষে বিতর্কিত সংবাদ সম্মেলন করে মোস্তাক ডাকাত ‘শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা’ করে। কিন্তু র্যাবের তদন্তে আসল ঘটনা উঠে আসে। ফিরোজ ১৪ মার্চের ভিকটিমকে অকথ্য ভাষায় হুমকি দেয়। এছাড়া ফিরোজ নিজেই স্বীকার করেছে তিনি পাঁচটি মামলার আসামি, ১২ বছর জেল খেটেছে। ফিরোজ-শরীফের যোগসাজশে ১৪ মার্চপর ভিকটিমকে পূর্বেও অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে। তাদের নির্জন আস্থানা হতে তাদের গ্রেফতারের পাশাপাশি তল্লাশি করে অস্ত্রগুলো উদ্ধার করা হয়।
তাদের গ্রেফতারের মাধ্যমে ঈদগাঁও এলাকায় অপরাধ অনেকাংশে কমে শান্তি ফিরে আসবে বলে মনে করছেন র্যাবের এ কর্মকর্তা।
র্যাবের সংবাদ সম্মেলনের পর এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তাদের সিন্ডিকেটের কাছে আরো অনেক ভারী অস্ত্র মজুদ রয়েছে।গ্রেফতার শরীফ-ফিরোজদের সিন্ডিকেটে রাশেদ, আরমান, সাহাবুদ্দিন, আবু ছিদ্দিক, সাইফুলসহ আরো একাধিক জনপ্রতিনিধি, স্থানীয় সাংসদের কাছের জন হিসেবে পরিচিত মিজান, জেলা ও উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতা বা তাদের সন্তানসহ বেশ কয়েকজন রয়েছেন। তারাই বৃহত্তর ঈদগাঁওতে দখল-বেদখল, বালু লুটসহ সব ধরণের অপরাধকর্ম করছেন। তাদের প্রায় সকলের কাছেই অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র দখলে রয়েছে। জেলা উপজেলার শীর্ষ রাজনৈতিক নেতাদের ছায়ায় থেকে তারা বীরদর্পে অপকর্ম করে। তাদের বলয়ে রয়েছে ইয়াবাসহ নানা মাদক বিক্রয়কারিও। সেখান হতে আসে বিশাল টাকার জোগান। যা, নানা জায়গায় ভাগ যায় বলে তথ্য মিলেছে। শরীফদের নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করে তাদের সোনালী এন্টারপ্রাইজ সিন্ডিকেটের অনেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্ট্যাটাস দিয়েছে।
এসব বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে, র্যাব কর্মকর্তা লে. কর্ণেল খায়রুল ইসলাম সরকার বলেন, যত ধরনের অভিযোগ আসছে সবকিছু নোট করে রাখা হচ্ছে। এসব খতিয়ে দেখে পরবর্তীতে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
মামলরা বাদি তরুণী বলেন, আমার মামলার আসামীরা আগে থেকেই পুলিশের অতি ঘনিষ্ট। যার ফলে তারা মামলার পরও আমায় হত্যার হুমকিসহ মামলা আপস দিতে আইনজীবী ও রাজনৈতিক বেতাদের দিয়ে চাপ দিয়েছে। র্যাব ছায়াতদন্ত করে গ্রেফতার না করলে তারা আইনের আওতায় আসতো কিনা সন্দেহ। তারা গ্রেফতার হলেও সদর থানা পুলিশের আস্থাভাজন নিজেকে পুলিশ পরিচয় দিয়ে চলা রাসেল উদ্দিন এখনো অধরা।
তিনি আরো বলেন, দ্বিতীয় অভিযুক্ত রাসেল উদ্দিন পুলিশের নাকের ডগায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন। মামলার সাতদিনের মাথায় জামিন নেয়ার কথা প্রচার করে নিজের ফেসবুক একাউন্টে একটি স্ট্যাটাস দিয়ে সবাইকে ধোঁকা দিয়ে বোকা বানিয়ে তিনি তার অনুসারিদের বিয়ের অনুষ্ঠানসহ সবরকম আড্ডায় যোগ দিচ্ছেন বলে ছবি প্রচার পাচ্ছে। আমাকে নানা ভাবে হুমকি দেয়া অব্যাহত রেখেছেন। সদর থানা পুলিশের সিনিয়র কর্মকর্তাদের সাথে দহরম সম্পর্কের কারণে তিনি ‘খোলা ফিল্ডে’ ঘুরতে পারছেন বলে দাবি করেন ভিকটিম।
তবে, কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের আইনজীবী বাপ্পী শর্মার মতে- যে ধারায় মামলা নথিভুক্ত হয়েছে তা নিম্ন আদালতে জামিন অযোগ্য। সেখানে জামিন না পেলে উচ্চতর আদালতে মিচ মামলা করতেও নথি পাওয়া এবং মামলা দায়ের করতে এক সপ্তাহ হতে পক্ষকাল সময় লাগে। তাছাড়া নারী ও শিশু আদালতে নিজে উপস্থিত না হয়ে জামিন পাবার কোন সুযোগ নেই।
তাই- একটি নথিভুক্ত ধর্ষণ মামলায় পলাতক আসামী রাসেলের জামিন প্রচারণা ‘চরম প্রতারণা’ ছাড়া কিছুই নয় বলে মন্তব্য করেন তিনি।
কক্সবাজার সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শেখ মুনীর উল গীয়াস বলেন, তরুণীকে ধর্ষনের অভিযোগে মামলা রেকর্ড করা হয়েছে। অভিযুক্ত কয়েকজনকে র্যাব গ্রেফতার করেছে বলে জনেছি। এখনো তাদের থানায় সোপর্দ করা হয়নি।













