২৯ অক্টোবর ২০২৫

‘দার্জিলিং গ্রাম’— যেখানে পরিবহনের একমাত্র সম্বল ঘোড়া

আকাশ মারমা মংসিং, বান্দরবান »

বান্দরবানে দুর্গম এলাকায় কেওক্রাডং এর পাদদেশে দার্জিলিং পাড়ায় জুমে উৎপাদিত কৃষিপণ্য পরিবহনে মানবের পোষ্য প্রাণী ঘোড়াই একমাত্র ভরসা বলে মনে করে বম সম্প্রদায় লোকেরা। সরেজমিনে দেখা যায়, দুর্গম এলাকায় যেখানে যানবাহন দিয়ে পণ্য পরিবহন করে সেইখানে চিত্র দেখা যায় ভিন্ন রকম। জুমের ধান, আদা, হলুদ, মিষ্টি কুমড়াসহ উৎপাদিত ফসল ঘোড়া মাধ্যমে পরিবহন করে বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছে। একটি ঘোড়া ১০ আড়ি (১০০ কেজি) ধান বহন করা ক্ষমতা রাখেন।

জানা যায়, কেউক্রাডং পাহাড়ের পাদদেশে দার্জিলিং পাড়ার কার্বারি সাকচিং বম (৬৫) নামে একব্যক্তি ২০০৬ সালে একটি ঘোড়া ২০-৪০ হাজার টাকায় কিনেছিলেন। কিন্তু হঠাৎ অজানা রোগের কারণে চারটি ঘোড়াই মারা যায়। আবার ২০১৩ সালে দিকে ২০ হাজার টাকা করে ৪টি ঘোড়া কিনে নিয়ে এসে লালন পালন শুরু করেন।

শুরু থেকেই ঘোড়াগুলোকে নিজেদের ঐতিহ্য ভাষায় শিখিয়ে দেন মালিকরা। সেই ভাষা ছাড়া অন্য কোন ভাষায় ডাকলে পাশ কাটিয়ে চলে যায়। এই ঘোড়াগুলো যাকে অপছন্দ করে তাকে কাছেও যেতে দেয়না, এমনকি তার কাছে ঘেষতেও দেয়না। অতিরিক্ত হলে বিরক্ত প্রকাশ করে।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, আগে গ্রামের প্রতি পরিবারে ১শ-২শ মণ আদা চাষ করতেন। আগে আদার দাম ছিল ৩ হাজার থেকে সাড়ে ৩ হাজার আর এখন দাম কম হওয়াই প্রতিমণ আদা বিক্রি হয় ৮শ থেকে ১২শ টাকা। আদার দাম নায্যমূল্যে না পাওয়ার কারণে এলাকাবাসী এখন আদা চাষ কম করে। পরে আদা চাষ ছেড়ে জুম চাষ বেড়ে গেলে পাহাড় থেকে উৎপাদিত আদা ঘোড়ার মাধ্যমে পরিবহন করা হয়।

ওই এলাকার ৪টি ঘোড়ার মধ্যে ১টি পুরুষ ৩টি মাদি, লাল ঘোড়াটি নাম রাখ হয় চহ্লদি অন্যটি নাম রাখা হয় মং নিং। সাদা পুরুষ ঘোড়াটির নাম রাখা হয় ব্লং এবং অসুস্থ ঘোড়াটির নাম রাখেন চিং লং। ঘোড়াগুলো সুস্থ থাকলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ৫-৬ মিনিট চোখ বন্ধ করে ঘুমায়। কিন্তু কোন সময় অসুস্থবোধ হলে দীর্ঘসময় ধরে ঘুম যায়। এসময় রোগটি সাড়াতে গুড় আর চনাবুট মিক্স করে খাওয়ালে সুস্থ হয়ে যায়। তবে পেট ব্যাথার জন্য বেশিরভাগ ওষুধ প্রয়োজন পড়ে।

পাড়ার বেঞ্জামিন বম নামে একজন বলেন, বগালেক হতে দার্জিলিং পাড়া পর্যন্ত শুষ্ক মৌসুমে গাড়ি চলাচল করতে পারলেও বর্ষামৌসুমে মোটেই গাড়ি যাতায়াত করতে পারে না। তখন রুমা-বগালেক থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস, জরুরি পণ্য পরিবহনে সম্পূর্ণ ঘোড়ার ওপর নির্ভরশীল হতে হয়। বগালেক থেকে প্রতি কেজি পণ্য বহনে ২০টাকা করে ভাড়া নেওয়া হয় বলে জানান পাড়ার এই বাসিন্দা।

গ্রামের লোজন সবাই কম-বেশি জুম চাষ, আদা চাষ ও ফলদ বাগান করেন। তারা সবাই বম সম্প্রদায়ের। পাড়ায় বর্তমানে ৩৫ পরিবারের বসবাস বলেও জানান পাড়ার বেঞ্জামিন বম।

আরেক গ্রামবাসী পাকোল বম (৪৫) বলেন, প্রথমে একটু কষ্ট হয়েছিল, কারণ ঘোড়াগুলো বম ভাষা বুঝেনা, ম্রো ভাষা আর মার্মা ভাষা বুঝে। যেহেতু তিনি মার্মা ভাষা জানেন সেজন্য ঘোড়াগুলোকে মার্মা ভাষা আর বম ভাষায় কথা বলতেন এখন ঘোড়াগুলো পুরোপুরি বম ভাষা বুঝে তাই কাজ আদায় করতে এখন আর কোন সমস্যা হয় না।

দার্জিলিং গ্রামবাসী লাল নুর খান বম জানান, এ বছর আদা চাষ কম করেছেন তিনি। মাত্র ৮০ মণ আদা চাষ করেছেন। তা থেকে ৬শ মণ আদা পাওয়ার আশা করছেন লালু নুর খান।প্রতি মণে ১ হাজার করে বিক্রি করলেও ৬ লাখ টাকা পাবেন বলে আশা করছেন তিনি।

তিনি আরও জানান, ঘোড়া দিয়ে শুধু আদা নয় জুমে উৎপাদিত মিষ্টি কুমড়া, আলু, কচু ও ধান পরিবহন করে বাড়িতে আনা হয়। দূরত্ব ভেদে পরিবহন মূল্য নির্ধারিত হয়ে থাকে। ঘোড়ার মাধ্যমে পাহাড়ি রাস্তায় মালামাল পরিবহনে খুবই সুবিধা হয়। ঘোড়া না থাকলে জুমিয়াদের অনেক কষ্ট হতো আর শ্রমিকের মজুরিও বেশি লাগতো। আর এখন জুমে উৎপাদিত পণ্য বা নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য অন্যান্য এলাকা থেকে বাড়িতে আনতে টাকা ও সময় দুটোই কম লাগে।

জেলা প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. গোলামুর রহমান বলেন, ‘ঘোরা পরিচ্ছন্ন প্রাণী, যেখানে প্রচুর আলো বাতাস আছে খোলামেলা জায়গায় থাকতে পছন্দ করে। ঘোড়া যে খাদ্য খায় তার মধ্য বিভিন্ন সবুজ শাক-সবজি, ঘাস, দানাদার খাদ্য যেমন- গম ভাঙা, গমের ভুষি, ভুট্টা ভাঙা, ধানের খুড়া, ছোলা ইত্যাদি।’ ঘোড়ার কি কি রোগ হতে পারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘স্কীন ডিজিস,কলিক পেইন, মানডে মর্ণিং সিকনেস, লেইমনেস (খুড়া রোগ), কৃমি রোগ, অপুষ্টি জনিত রোগও হতে পারে।’

আরও পড়ুন