২৭ অক্টোবর ২০২৫

নতুন ইঞ্জিনে ঠাসা ডিজেল সপ

মাকসুদ আহম্মদ, বিশেষ প্রতিবেদক »

রেলের পূর্বাঞ্চলের ডিজেল সপ নতুন ইঞ্জিনে ঠাসা। সর্বশেষ চালানে আসা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত(এয়ার কন্ডিশন্ড) ডিজিটালাইজড ১০টি ইঞ্জিনের একসঙ্গে কমিশনিং চলছে। এক কথায় পূর্ব রেলের পাহাড়তলীস্থ ডিজেল সপে কর্মব্যস্ততা এখন অনেক বেশি। ৩০০০ সিরিয়ালের সর্বশেষ আসা ১০টি ইঞ্জিনের অপারেটিং ক্যাটালগ অনুযায়ী এখন মিলিয়ে দেখা হচ্ছে। কমিশনিং শেষ হলেই এরপর লাইট ও লোড ট্রায়াল দেওয়া হবে। ট্রায়াল শেষে এসব ইঞ্জিন বিভিন্ন আন্তঃনগর ও মালবাহি ট্রেনের সঙ্গে যুক্ত হবে। চট্টগ্রাম বন্দর ইয়ার্ডে (সিজিপিওয়াই) এসব লোকোমটিভস বা ইঞ্জিন খালাস করা হয়েছে নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে।

শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত (এয়ার কন্ডিশন্ড) এসব ডিজিটালাইজড ইঞ্জিনের কমিশনিং শুরু হয়েছে গত ৮ ডিসেম্বর থেকে। ৩০২১ থেকে ৩০৩০ সিরিয়ালের মোট ১০টি ইঞ্জিনের পাহাড়তলীস্থ ডিজেল সপে কমিশনিং চলছে গত ১১ ডিসেম্বর থেকে। ইতোমধ্যে ৩০২৯ সিরিয়ালের ইঞ্জিনটি কমিশনিং শেষে লাইট ট্রায়াল ও শেষ করা হয়েছে। অল্প কয়েকদিনের মধ্যে এসব ইঞ্জিনেরে কমিশনিং শেষে লাইট ট্রায়াল শেষে লোড ট্রায়ালের জন্য ১৮/৩৬ কোচ লোড দেওয়া হবে।

এরআগে গত এপ্রিল মাসে প্রথম পর্যায়ে ১০ টি লোকমোটিভস বা ইঞ্জিন চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পাহাড়তলীস্থ ডিজেল সপে আনা হয়। প্রথম ধাপের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ১০টি ট্রেন ইঞ্জিন যুক্ত হয়েছে বিভিন্ন ট্রেনের সঙ্গে।

জানা গেছে, সর্বশেষ চালানে আসা চট্টগ্রাম বন্দরে প্রতিটি ইঞ্জিন আনলোডিং ও ডক চার্জসহ প্রায় ৪০ কোটি টাকা পড়েছে। এই ১০টি ইঞ্জিনের ক্রয়মূল্য পড়েছে প্রায় ৪শ’ কোটি টাকা। ২২শ’ অশ্বশক্তির এই লোকোমোটিভসগুলোর প্রতিটির ওজন প্রায় ৮৭ হাজার ৬৫০ কেজি বা ৮৮ টন। এসব ইঞ্জিনের এক্সেল লোড ক্ষমতা প্রায় ১৫শ’ টন। টি-এ/৯ মডেলের এসব শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ট্রেন ইঞ্জিনের সঙ্গে সর্বোচ্চ ১৮টি কোচ সংযুক্ত করা যাবে।

কোরিয়ার হুন্দাই রোটেম কোম্পানীর চুক্তিপত্রে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) অর্থায়নে বাংলাদেশ রেলওয়েতে মিটারগেজ (এমজি) লাইনে ট্রেন চলাচলের জন্য এর আগে ২০২০ সালের মাঝামাঝিতে ৮শ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০টি ডিজেল ইলেকট্রিক ইঞ্জিন (ডিই) ক্রয় করা হয়েছে।

২০১৯ সালের ১৮ মার্চ এসব মিটারগেজ ডিজেল ইলেকট্রিক ইঞ্জিন ক্রয়ের জন্য কোরিয়ার হুন্দাই রোটেম কোম্পানির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিল বাংলাদেশ রেলওয়ে। প্রকল্প পরিচালক ও প্রধান যন্ত্র প্রকৌশলী (প্রকল্প) বরাবর শিপমেন্টের চিঠি দিয়ে তিন হাজার সিরিজের ১০টি লোকোমোটিভস গত ১০ জুনের মধ্যেই চট্টগ্রাম বন্দরে পৌছানোর ব্যবস্থা করা হয়। জুনের পর আগস্টে আরো ১০টি ইঞ্জিন কোরিয়া থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে খালাস হয়ে পূর্ব রেলে বিভিন্ন মালবাহি ও যাত্রীবাহী ট্রেনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে।

এ ব্যাপারে পাহাড়তলীস্থ ডিজেল ইলেকট্রিক লোকোমোটিভ কারখানার কর্ম ব্যবস্থাপক রাজীব কুমার দেবনাথ বাংলাধারাকে বলেন, এই নিয়ে ২০টি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত লোকোমটিভস কোরিয়া থেকে এসেছে। এখানে অবস্থানরত হুন্দাই রোটেম কোম্পানির প্রকৌশলীরা সর্বশেষ চালানে আসা ১০টি ইঞ্জিনের কমিশনিং শেষ করলেই আমরা লাইট ও লোড ট্রায়ালের ব্যবস্থা করবো। ক্রমান্বয়ে এসব ইঞ্জিন বিভিন্ন ট্রেনের সঙ্গে যুক্ত হবে।

পাহাড়তলীস্থ ডিজেল লোকোমোটিভস মেরামত কারখানা সূত্রে জানা গেছে, প্রতিটি ইঞ্জিন কমিশনিংয়ে কমপক্ষে ৪/৫ দিন সময় লাগছে। এরপর এসব শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত একটি একটি ইঞ্জিন পাহাড়তলী ডিজেলসপ থেকে চিনকি আস্তানা স্টেশন পর্যন্ত প্রায় ৭০ কিলোমিটার লাইট ট্রায়াল শেষ করবে। ক্রমান্বয়ে সবগুলো লাইট ও লোড ট্রায়াল পরীক্ষা করা হবে।

রেলের মহাপরিচালকের দফতর সূত্রে জানা গেছে, লাইট ট্রায়ালের পর ডিভিশনাল রেলওয়ে ম্যানেজার (ডিআরএম) এর তত্ত্বাবধানে লোড ট্রায়ালে শতভাগ পরিপূর্ণতা পেলে ইঞ্জিনগুলো আন্তঃনগর ট্রেনের সঙ্গে যুক্ত হবে।

কোরিয়ার হুন্দাই রোটেম কোম্পানির পক্ষ থেকে জানা যায়, ২০১৯ সালের ১৮ মার্চ মাসে ২০টি ডিজেল ইলেকট্রিক (ডিই) লোকোমোটিভ ক্রয়ের জন্য চুক্তি হয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ের সঙ্গে। ৮৭ হাজার ৬৫০ কেজি ওজনের এসব লোকোমটিভসের ক্ষমতা ২২শ’ অশ্বশক্তি বা হর্স পাওয়ার। বাংলাদেশে এই প্রথম ২২শ হর্স পাওয়ার ক্ষমতাসম্পন্ন শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ডিজেল ইঞ্জিন মিটারগেজ লাইনে চলার জন্য তৈরি করা হয়েছে। এসব ইঞ্জিন লিফটিং এবং প্যাকিং ইনস্ট্রাকশনও কোম্পানির পক্ষ থেকে দেয়া হয়েছে।

আরও জানা গেছে, তিন হাজার সিরিজের ২ হাজার ২শ’ হর্স পাওয়ার বিশিষ্ট এসব ইঞ্জিন অটোমেটিক কন্ট্রোল সিস্টেমের। ইঞ্জিনের বিভিন্ন প্যারামিটারগুলো ডিজিটাল মনিটরে দেখা যাবে। এসব ইঞ্জিনে কোন ডেডম্যান প্যাডেল নেই ফলে লোকোমোটিভ মাস্টার(চালক) ইঞ্জিনের কেবিনের ভেতরে ঘুমানোরও কোন সুযোগ নেই। ইঞ্জিনের সামনে স্যান্ডিং সিস্টেম ও ক্যাটেল গার্ডও রয়েছে। যদিও ইঞ্জিনের গতিবেগ ঘন্টায় ১১০ কিলোমিটার পর্যন্ত ক্যাপাসিটি কিন্তু পূর্বাঞ্চলীয় রেল ট্র্যাকের ক্ষমতানুযায়ী সর্বোচ্চ ৯০ কিলোমিটার গতিবেগ সেট করা হয়েছে। এরপরও ৮০/৮৫ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চলতে থাকলে এ্যালার্ম বাজবে। এসময় চালক স্পীড কন্ট্রোল না করলে ট্রেন ইঞ্জিন অটোমেটিক থেমে যাবে।

কোরিয়া থেকে আনা এসব ইঞ্জিনের কেবিন সম্পূর্ণ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ও ডিজিটালাইজড। ২০১৯ সালের ১৮ মার্চ এসব মিটারগেজ ডিজেল ইলেকট্রিক ইঞ্জিন ক্রয়ের জন্য কোরিয়ার হুন্দাই রোটেম কোম্পানির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিল বাংলাদেশ রেলওয়ে। কোরিয়ার হুন্দাই রোটেম কোম্পানী থেকে মোট ২০টি ট্রেন ইঞ্জিন আনার চুক্তি হয়েছিল। এরমধ্যে প্রথম ধাপে এসেছে ১০টি গত এপ্রিল মাসে। বাকি ১০টি আগস্ট মাসে আসার কথা থাকলেও সেগুলো নভেম্বরে এসেছে। পাহাড়তলীস্থ ডিজেল ইলেকট্রিক লোকোমটিভ কারখানায় এসব ইঞ্জিন আনা হয়েছে কমিশনিংসহ স্পীড ও লোড ট্রায়ালের জন্য।

উল্লেখ্য, গত বছরের আগস্টে আনা তিন হাজার সিরিজের ১০টি ইঞ্জিনের সঙ্গে শুধু এসব ইঞ্জিনের একটাই পার্থক্য ইঞ্জিনের কেবিন শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত এবং এয়ার ব্রেক সিস্টেমের (বাতাস নিয়ন্ত্রিত)।

কোরিয়ার হুন্দাই রোটেম কোম্পানির এসব ইঞ্জিনের অপারেটিং ম্যানুয়াল বা ক্যাটালগ থেকে জানা যায়, হঠাৎ ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে গেলে মনিটরে দেখাবে ইঞ্জিনের কোথায় এবং কি ত্রুটি। কেনইবা ইঞ্জিন আকস্মিক থেমে গেল। ডিজিটাল পদ্ধতির এসব ইঞ্জিনের ট্রাকশন মোটরগুলো ডিজিটালাইজড। মিটারগেজ লাইনের এসব ইঞ্জিনের কেবিন সম্পূর্ণ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ও ডিজিটালাইজড। এসব ইঞ্জিন ব্রেক বাতাসে নিয়ন্ত্রিত হবে। অর্থাৎ এয়ার ব্রেক সিস্টেমের।

রেলের পূর্বাঞ্চলীয় এক সিনিয়র সাব এ্যসিসটেন্ট ইঞ্জিনিয়ার বলেছেন, কমিশনিংয়ে আমরা যা পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখছে তা হল— ইঞ্জিনের লুব অয়েলের কনজাম্পশন ঠিক আছে কিনা, র্স্টাটিং সিস্টেম ঠিক আছে কিনা। এছাড়া কমিশনিংয়ে দেখা হচ্ছে ইঞ্জিনের অয়েল ট্যাংকের ধারন ক্ষমতা অনুযায়ী অয়েল রিজার্ভ করা যায় কিনা। ইঞ্জিনের বিভিন্ন পার্ট ডিজিটাল মনিটরে প্রদর্শন করছে কিনা। ইঞ্জিনের ত্রæটি থাকলে তা র্স্টাটিং কোন পয়েন্টে ত্রুটি এবং তা ইঞ্জিন কেবিনের ভেতরে থাকা মনিটরে তা দেখাচ্ছে কিনা। ইঞ্জিন কমিশনিংয়ের সময় এসব বিষয় প্রত্যক্ষভাবে দেখা হচ্ছে।

আরও পড়ুন