৩০ অক্টোবর ২০২৫

নাটোরের উত্তরা গণভবনে আসছে হাজার হাজার দর্শনার্থী

এম এম আরিফুল ইসলাম, নাটোর »

বিল চলন, গ্রাম কলম, কাঁচা গোল্লার খ্যতি,
অর্দ্ধ বঙ্গেশ্বরী রাণী ভবানীর স্মৃতি।
উত্তরা গণভবন, রাজ রাজন্যের ধাম,
কাব্যে ইতিহাসে আছে নাটোরের নাম।

নাটোরের কথা শিল্পী শফি উদ্দিন সরদারের লেখা কবিতার উপরের চারটি লাইন আবৃত্তি করার সাথে সাথেই সকলের মনের পর্দায় ভেসে ওঠে ইতিহাস আর ঐতিহ্যের এক প্রাচীণ নগরীর কথা। আর তাই নাটোরকে পরিচিত করে তুলতেই কথা শিল্পী শফি উদ্দিন সরদার হয়ত এই চার লাইনের কবিতা লিখেছিলেন। সেই নাটোরের দিঘাপতিয়া রাজপ্রাসাদটি প্রাচীন স্থাপত্যকলার দৃষ্টিনন্দন এক নির্দশন।

প্রায় ৩শ’ বছরের প্রাচীন ইতিহাস আর ঐতিহ্যের সৌন্দর্যমনন্ডিত এই রাজবাড়ীটি আজো কালের সাক্ষি হয়ে উত্তরা গণভবন নাম নিয়ে এখন দেশব্যাপী পরিচিতি লাভ করেছে। এই রাজবাড়ীতে এক সময়ে শোনা যেত নুপুরের ঝংকার। এর সঙ্গে মধুরকন্ঠের সুর মূর্ছনা ছিল পাইক পেয়াদার কর্মচাঞ্চল্য, রাজ-বাজন্যবর্গের গুরুগম্ভীর অবস্থান আরও ছিল বিত্তবৈভবের ঝলক। কিন্তুু আর এসব নেই। কালের সাক্ষি দিঘাপতিয়া রাজবাড়ী বর্তমানে উত্তরা গণভবন নাম নিয়ে আজো স্মৃতি বহন করে চলেছে।

দিঘাপতিয়া রাজবাড়ীর সামনে আসলে সবাইকে থমকে যেতে হয়। দৃষ্টিনন্দন সুদূশ্য বিশাল সিংহদুয়ার বা ফটক। এর উপরে প্রকান্ড ঘড়ি। যা আজো সঠিকভাবে সময় নির্ণয় করছে। রাজবাড়ীতে প্রবেশের এটাই একমাত্র পথ। এছাড়া চারদিকে সুউচ্চ প্রাচীর, এরপর পরিখা মাঝখানে দেশী বিদেশী নান প্রকার বিরল প্রজাতির বৃক্ষরাজি শোভিত দৃষ্টিনন্দন বিশাল এ রাজ প্রাসাদ।

প্রতিষ্ঠাঃ

দিঘাপতিয়া রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন রাজা দয়ারাম রায়। জেলা সদর হতে প্রায় ১ দশমিক ৭৫ কিলোমিটার উত্তরে নাটোর বগুড়া মহাসড়কের পাশে দিঘাপতিয়া রাজপ্রাসাদ নির্মাণ করেন। পরে ১৮৯৭ সালে ভূমিকম্পে এ প্রাসাদ ধ্বংস হলে ১৮৯৭ হতে ১৯০৮ সাল পর্যন্ত সময়ে বিদেশী প্রকৌশলী চিত্রকর্ম বিশেষজ্ঞ শিল্পীদের সহায়তায় ৪১ দশমিক ৫০ একর জমির উপর এই রাজবংওশর ষষ্ঠ রাজা প্রতদানাথ এই রাজবাড়ীটি পূর্নঃ নির্মাণ করেন। প্রাচীরের বাহিরের ফটকের সম্মুখে রয়েছে ২ দশমিক ৮৯ একর জমি। চারিদিকে সীমানা প্রাচীর দ্বারে পরিবেষ্টিত স্থানে বিশেষ কারুকার্যে খচিত মুল ভবনসহ ছোট-বড় মোট ১২টি ভবন দিঘাপতিয়া ষষ্ঠ রাজা প্রমদানাথ রায় নির্মাণ করেন। তবে দিঘাপতিয়া রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতাও নাটোর রাজ্যের দেওয়ান দয়ারাম রায় ১৭৩৪ সালে প্রথম রাজপ্রাসাদ নির্মাণ করেন।

রাজা প্রমদানাথ রায়ের সময় ১৮৯৭ সালে ১০.১১.১২ জুন ও তিনদিনব্যাপী বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসের অধিবেশন নাটোরের ডোমপাড়া মাঠে শুরু হয়। বিশ্বকবি রবি ঠাকুর সহ অনেক বরেণ্য ব্যক্তি এ অধিবেশনে যোগ দেন। কিন্তুু অধিবেশনের শেষ দিন ১২ জুন প্রলয়ংকরি ১৮ মিনিটব্যাপী এক ভূমিকম্পে রাজপ্রাসাদ ধ্বংসস্তুপে পরিনত হয়। ফলে রাজা প্রমদানাথ রায় মাত্র অল্প সময়ের মধ্যে বিদেশী প্রকৌশলী, দেশী মিস্ত্রি ও চিত্রকর্মী বিশেষজ্ঞ শিল্পী দ্বারা আবার নতুনভাবে এই রাজপ্রাসাদটি নির্মাণ করেন।

মোঘল ও প্রাশ্চত্য রীতি অনুসারে নান্দনিক কারুকার্যময় প্রাসাদটিকে এক বিরল রাজভবন হিসেবে গড়ে তোলেন। রাজপ্রাসাদের দক্ষিণে তৈরি করা হয় এক বাগান। যা রাজার বাগান নামে পরিচিত। বাগানে রোপন করা হয় শত প্রজাতির দেশী বিদেশী প্রজাতির ফুল ও ফলের বৃক্ষরাজি। স্থাপন করা হয় শ্বেতপাথরের মূর্তি, কৃত্রিম ঝর্ণা।

রাজবংশের রাজাগণঃ

দিঘাপতিয়া রাজবংশের রাজাগণ চিলেন আধুনিক মনমানসিকতার অধিকারী। ১৭১০ সাল থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত এই রাজবংশের রাজাগণ কৃতিত্বের সঙ্গে রাজ্য শাসন করে ইতিহাসের পাতায় এখনো অমর হয়ে রয়েছেন। এরা হচ্ছেন এই রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা রাজা দয়ারাম রায়, জগন্নাথ রায়, প্রাণনাথ রায়, প্রসন্ননাথ রায়, প্রমথ নাথ রায়, প্রমদানাথ রায়, প্রতিভানাথ রায়, অষ্টম ও বংশের শেষ রাজা প্রভাত নাথ কুমার। ১৯৬২ সালে তিনি দেশ ত্যাগ করেন। ১৯৯৭ সালে তিনি কলকাতায় ৮০ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।

কে এই দয়ারাম রায়ঃ

দিঘাপতিয়া রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন রাজা দয়ারাম রায়। তিনি নাটোর রাজ রামজীবনের দেওয়ান ছিলেন। তিনি বংশিয দয়ারামের বাসস্থান চিল সিংড়ার কলম গ্রামে। সপ্তদশ শতকের শেষদিকে পুঠিয়া দর্পনারায়নের অধীনে নাটোর রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা রাজ জীবন যখন পুঠিয়া কাবারিতে মাসিক মাত্র ৮ আনা বেতনে জমার মহুরীর কাজ করতেন। সে সময় তিনি দয়ারাম রায়কে মাসিক মাত্র ৮ আনা বেতনে চাকর রেখেছিলেন।

কথিত আছে রামজীবন একদিন কাজ উপলক্ষে নৌকায় চলনবিল এলাকায় যান এবং কলম গ্রামে নৌকা ভিড়ানো হয়। এ সময় কলম নদীতে কতগুলো ছোট ছেলে হইচই করে স্নান করছিল। এ সময় দুটি ছেলে নৌকার কাছে আসে এদের মধ্যে একজন দয়ারাম। তাকে অত্যন্ত বুদ্ধিমান হওয়ায় রামজীবন তাকে পুঠিয়ায় এনে মাসিক ৮ আনা বেতনে চাকরী দেন। ১৭১৪ সালের শেষ দিকে ভূষনার জমিদার সীতারামের পতনের মূলে চির এই দয়ারাম রায়ের কুটকৌশল।

সীতারামের পতনের পর নাটোর রাজা রামজীবন নবাব মুর্শিদ কুলি খার কাছ হতে ভূষানাও মাহমুদাবাদের জমিদারী লাভ করেন। সীতারাম বনাম মুর্শিদ কুলি খার যুদ্ধে তৎকালীন বাংলার যেসব জমিদার বা রাজা সহযোগিতা করেন এদের মধ্যে নাটোর রাজা ছিলেন অন্যতম। আর নাটোর রাজের পক্ষে এ যুদ্ধে গুরত্বিপূর্ন ভূমিকা রাখেন দয়ারাম রায়। আর এ জন্য নবাব মুর্শিদ কুলী খা খুশি হয়ে দয়ারামকে ‘রায়বায়ান’ উপাধি দেন আর রামজীবন পুরুস্কার স্বরূপ দয়ারামকে বগুড়া জেলার সারিয়াকান্দি উপজেলার মানস নদীর তীরের নওখিলা পরগনা দান করেন।

দিঘাপতিয়া রাজ্যের সর্বাপেক্ষা লাভজনক জমিদারি ছিল নওকিলা। আর ১৭০৬ সালে স্থাপত্যকলার অন্যতম নির্দশন দিঘাপতিয়া রাজবাড়ি নির্মাণ করেন। তবে নাটোর রাজ্যের যখন দুর্দিন সে সময় দয়ারাম রায় দিঘাপতিয়া রাজপ্রাসাদ গড়েন। রাজা দয়ারাম রায় পুত্র জগন্নাথ রায় ও ৫ কন্যা রেখে ১৭৬০ সালে ৮০ বছর বয়সে মারা যান।

যা আছে রাজবাড়িতেঃ

রাজবাড়িতে মোট ভবন রয়েছে ১২টি। এগুলো হচ্ছে প্রদান প্রাসাদ ভবন, কুমার প্যালেস। প্রধান কাচারীভবন, ৩টি কর্তারাণী বাড়ি, প্রধান ফটক রান্নাঘর, মটর গ্যারেজ, ড্রাইভার, কোয়ার্টার, ট্রেজারি বিল্ডিং ও সেন্ট্রি বক্স। রাজভবনসহ অন্যান্য ভবনের দরজা জানালা সক কাঠের দরজা দ্বারা নির্মিত। প্যালেসের দক্ষিণে রয়েছে পাথর এবং মার্বেল পাথর দ্বারা নির্মিত ফুলের বাগান। এ বাগানটি ইটালি গার্ডেন নামে পরিচিত। দেশী-বিদেশী নানা জাতের ফুলে পরিপূর্ন এ বাগান।

বাগানের ভিতর শ্বেত পাথরের নির্মিত ৪টি নারী মূর্তি এখনো পর্যটকদের আকর্ষন করে। রয়েছে একটি ইতালি টাইপের ফোয়ারা এবং মাঝে মাঝে লৌহ ও কাঠ দ্বারা নির্মিত বেঞ্চ, একটি ডিম্বাকার সাইজের মার্বেল পাথরের নির্মিত প্লাটফরম। এছাড়াও ভেতরে রয়েছে আগত অতিথিদের চলাফেরার জন্য ৪ ফুট চওড়া রাস্তা। সমগ্র বাগানে শুধু ফুল আর ফুলের সমাহার।

রাজ ভবনঃ

দিঘাপতিয়া রাজবাড়ির মূল প্রাসাদটি একতলা। এর মাঝে রয়েছে প্রশস্ত একটি হল ঘর। বেশ উঁচু হলঘরের শীর্ষে রয়েছে একটি প্রকান্ড গুম্বুজ। এ গুম্বুজের নিচ দিয়ে হলঘরে আলো বাতাস প্রবেশ করে। হলঘরের মাঝে রাজার আমলে তৈরি বেশকিছু সোফা রযেছে। এছাড়া হলরুমে একটি কারুকার্য খচিত সোফা রয়েছে যাতে একসঙ্গে ৪ জন চারমূখী হয়ে বসা যায়। উত্তরা গণভবনে উচ্চ পর্যায়ের কোন সভা হলে এ রুমেই হয়। হলরুমের আসবাবপত্র এখনো রয়েছে। উপরে রয়েছে ঝাড়বাতি।

হলরুমের পাশে রয়েছে আরেকটি বড় ঘর। পাশের রান্নঘর হতে এ ঘরে সরাসরি আসা যায়। নিরাপত্তার জন্য রান্নাঘরের করিডোরের দু’পাশে রাজ আমলের তার দিয়ে এখনো ঘেরা রয়েছে। এর পাশে একটি ঘরে রয়েছে সিংহাসন। এর পামের ঘর রাজার শয়ন ঘর। এ ঘরে এখনো রাজার খাট শোভা পাচ্ছে। শোবার ঘরের বারান্দার চারদিকে তারের নেট দিয়ে গেরা চিল। কুমার ভবনের পেচনের ভবন রাজার কোষাগার আর অস্ত্রগার। দক্ষিণে চিল রাণীমহল। আজ আর সেটা নেই। ৬৭ সালে ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে।

রাণীমহলের সামনে একটি ফোয়ারা স্মৃতিবহন করে চলেছে। পাশে ছিল দাসী ভবন। রাজার একটি চিড়িয়াকানা ছিল। এখানে হরিণ, খরগোসসহ অন্যান্য জীবজন্তু ছিল আজ আর এসব নেই। শুধুমাত্র খাঁচাগুলো আজো স্মৃতিবহন করছে।

শোনা গেছে এসব জীবজন্তু পরে নাকি রাজশাহী চিড়িয়াখানাতে স্থানান্তর হয়েছিল। মূল ববন রাজ প্রাসাদের সামনে রয়েছে রাজা প্রসন্ন নাথ রায় বাহাদুরের আবক্ষ মূর্তি। এর দু’পাশে রয়েছে ১৮৫৪ সালে ব্রিটিশদের তৈরি করা দুটি কামান। মূল প্যালেসের মাঠের পূর্বে রয়েছে রাজার দোলমঞ্চ। পাশেই রয়েছে কুমার প্যালেস। এর সামনে বসানো চারচাকা বিশিষ্ট একটি কালো কামান আজো শোভা পাচ্ছে। মূল রাজপ্রাসাদের প্রবেশের পথে সিঁড়ির দু’পাশে দুটি কালো কৃষ্ণ মূর্তি। এর পরেই রয়েছে ধাতব বর্ম। এটা পরেই নাকি রাজা যুদ্ধে যেতেন। এ কারণে এ পিতলের তৈরি এ বর্মটি আরো দর্শনার্থীদের বিশেষভাবে নজর কাড়ে। রাজপ্রাসাদের উত্তরের পাশে ছিল রাজার বিদ্যুূৎ উৎপাদন কেন্দ্র। সেখান থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ অস্টাদশ শতকের রাজবাড়ি বিদ্যুতের আলোতে ঝলমল করতো।

বিদ্যুৎ উৎপাদনের সেসব সরঞ্জামাদি আজো কেন্দ্রস্থলে পরে রয়েছে। পুরো রাজপ্রাসাদে চিল রাজার বিভিন্ন চিত্রকর্ম, ছবি আর বিদেশী ঘড়ি আজ সে সব নেই। প্রাসাদের শ্বেতপাথরের মেঝে মোড়ানো থাকতো পার্মিয়ান গালিচায়। রাজা প্রমদানাথ রায়ের প্রচন্ড রকম ঘড়িপ্রীতি ছিল। আর এ জন্য তিনি দেশ বিদেশ থেকে অর্ডার দিয়ে ঘড়ি তৈরি করে আনতেন। এসব ঘড়ি মূল প্রসাদ ভবন ছাড়া বিভিন্ন ভবনে স্থাপন করতেন। এমন একটি ঘড়ি চিল যাতে ১৫ মিনিট পরপর জলতরঙ্গ বাজতো।

এছাড়া রাজবাড়ির মূল ফটকে রয়েছে একটি ঘড়ি। এর দু’পাশে দুটি ডায়াল রয়েছে। ঘড়িটি এখনো সঠিক সময় দিচ্ছে। ঘড়িটি নাকি ইটালির ফ্লোরেন্স থেকে আনা হয়েছিল। শোনা যায় স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় দিঘাপতিয়া রাজবাড়ি পাকবাহিনীর ক্যাম্প হওয়ায় ঘড়িসহ অন্যান্য মূলবান সম্পদ এরা নিয়ে যায়।

অবদানঃ

১৯১৭ সাল হতে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত দিঘাপতিয়া রাজ্যের ৭ জন রাজা বংশানুক্রমিকভাবে রাজ্য শাসন ও উন্নয়নমূলক কাজ করে ইতিহাসে অমর হয়ে রয়েছেন এ রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা রাজা দয়ারামের সময় এলাকায় ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত হয়। চতুর্থ রাজা প্রসন্ননাথ রায়ের আমলে ১৮২৯ সালে নাটোর মহকুমা হয়। রাজশাহী হতে নাটোর পর্যন্ত রাজপথকে দিঘাপতিয়া পর্যন্ত স¤প্রসারিত করেন এবং বগুড়াগামী রাস্তার সঙ্গে সংযুক্ত করেন।

১৯৫০ সালে এ রাস্তার সংস্কার বাবদ সরকারকে ৩৫ হাজার টাকা দান করেন। ১৮৫১ সালে স্থাপন করেন জেলার সর্বপ্রথম নাটোরের দাতব্য হাসপাতাল। যা আজকের আধুনিক সদর হাসপাতালে রুপান্তরিত হয়েছে। সে সময় এখানে ইউরোপীয়ান ঔষধপত্র ও যন্ত্রপাতি বিনামূল্যে দেয়া হতো। ১৮৫৩ সালে তার মৃত্যুর পর তার দানের অর্থে রাজশাহী দাতব্য চিকিৎসালয় প্রতিষ্ঠিত হয়।

পরবর্তীতে এটিই হয় রাজশাহী সদর হাসপাতাল। ১৮৫২ সালে নির্মিত হয় প্রসন্ননাথ একাডেমী। এটি পরে নাটোরের সর্ব প্রথম হাইস্কুল। এছাড়া দিঘাপতিয়া হাইস্কুল, নাটোর রাজশাহীর হাসপাতালের জন্য রাজা প্রসন্ননাথ রায় ১৮৫২ সালে এক লাখ টাকা দেন। দিঘাপতিয়া রাজবাড়িতে তিনি আধুনিকভাবে গড়ে তোলেন। পঞ্চম রাজা প্রসন্ননাথ রায়ের আমলে রাজ্যের বিস্তৃতি লাভ করে।

রাজশাহী হুগলী জেলার শেওরাফুলী এস্টট যশোরের মাহমুদপুর, নড়াইলের কিছু অংশ, নদীয়ান ও বগুড়ার বেশকিছু অংশ জমিদারির অন্তর্ভৃক্তি হয়। এজন্য ১৮৭১ সালে তিনি রাজা বাহাদুর খেতাব লাভ করেন। তিনি রাজশাহী জেলার মধ্যে সর্বাপেক্ষা ধনী জমিদার ছিলেন। ১৮৬৮ সালে রাজশাহী বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। বগুড়ার নওখিলাতে একটি দাতব্য চিকিৎসালয়, একটি মাধ্যমিক চিকিৎসালয় স্থাপন করেন। ১৮৮২ সালে তা উচ্চ বিদ্যালয়ে পরিণত হয়। ১৮৭৭ সালে প্রসন্ননাথ রায় বঙ্গীয় আইন সভার সদস্য মনোনিত হন। তার চেষ্টায় আইন পাশ হয়।

এ রাজবংশের ষষ্ঠ রাজা প্রমদানাথ রায় ১৮৯৪ সালের ২৯ জানুয়ারী ক্ষমতা গ্রহণের পর বিভিন্ন জনকল্যালকর কাজ করেন। এর মধ্যে রাজশাহী চিকিৎসালয়ের ৭ হাজার টাকা এবং লেডি ডাফুরীন ফান্ডে ২০ হাজার টাকা দান করেন। নওখিলাতে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। রাজশাহী-নাটোর সড়ক সংস্কারের জন্য সমস্ত ব্যয়ভার গ্রহণ করেন। ১৮৯৮ সালে ইংরেজ সরকারের কাছ থেকে রাজা উপাধি পান। রাজশাহী হাসপাতালে পিতামহীর নামে মহিলাদের জন্য ‘ভবসুন্দরী ওয়ার্ড’ তিনি নির্মাণ করেন। পিতার নামে রাজশাহী কলেজে পিএস হোস্টেল নির্মাণ করেন। রাজশাহী টাউন হল (বর্তমানে অলকা হল) প্রমদানাথের কীর্তি। রাজশাহী এসাসিয়েশনের পরিচালিত লাইব্রেরির যাবতীয় খরচ এই হলের উপার্জিত অর্থ দিয়ে চলতো। রাজ্যে প্রমদানাথ রায়ের আমলে ১৯০৯ সালে গভর্নর স্যার ল্যান্সলটি হেয়ার দিঘাপতিয়া রাজ প্রাসাদে আসেন।

সর্বশেষ অবস্থাঃ

১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর দিঘাপতিয়া রাজা দেশত্যাগ করে ভারতে চলে যান। ৫০ সালে জমিদারি অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন পাশ হওয়ার পর দিঘাপতিয়ার রাজপ্রাসাদের রক্ষণাবেক্ষণের সমস্যা দেখা দেয়। ফলে ১৯৬৬ সালে এ রাজভবন ইস্ট পাকিস্তান হাউসে পরিণত হয়। ১৯৬৭ সালের ২৪ জুলাই তৎকালীন গর্ভনর মোমেন খান এটাকে হাউস এ রূপান্তরিত করেন। আর দেশ দেখতে সমতল ভূমি হলেও এটি রাজবড়ীর একটি মন্দিরের ছাদ যা ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে মাটির নিচে তলিয়ে যায়।

স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান এটাকে উত্তরা গণভবন হিসেবে ঘোষণা দেন। আর ১৯৮০ সালের ১৭ নভেম্বর জিয়াউর রহমান ঢাকার বাহিরে প্রথম এই উত্তরা গণভবনে মন্ত্রীসভার বৈঠক করে ইতিহাস সৃষ্টি করেন।

দিঘাপতিযা রাজবাগীর এক সময় বিস্তীর্ণ এলাকার ক্ষমতার কেন্দুবিন্দু ছিল। সে বাড়ী বর্তমানে মর্যাদাহীন বা মুকুটহীনভাবে পড়ে রয়েছে। তবে মূল ফটকের উপরে যে বিশালাকার ঘড়িটি আছে পূর্বে ১০ থেকে ১২ মাইল দূর হতে এর ঘন্টাধ্বনি শোনা যেত। আর বর্তমানে তা মাত্র ১ মাইল দূর থেকে ঘন্টাধ্বনি শোনা যায়। তেমনি এ রাজবাড়ীর পূর্বের গৌরব আর নেই আগের মতো রাজা নেই, রাণী নেউ, সে সঙ্গে নেই এ রাজপরিবারের মর্যাদাও।

তার পরও বর্তমান সরকার নাটোরের উত্তরা গণভবন দশনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করার পর থেকে এখানে নিয়মিত শত শত দর্শনার্থী আসে ইতিহাস ঐতিহ্যখ্যাত এই ভবন দর্শন করতে। আর শীতের আগমের সাথে সারা দেশের মানুষ যখন শিক্ষা সফরসহ বেড়ানোর নানা আয়োজন করে তখন এখানে কেয়ারটেকারদের ভীড় সামলানোই দায় হয়ে পড়ে।

প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত ১০ টাকা করে প্রবেশ ফি দিয়ে দেশের যেকোন মানুষ এখন গণভবনে প্রবেশ করতে পারে। এখানে দেশের বিভিন্ন স্কুল কলেজ মাদরাসা থেকে তাই প্রতিদিন আসছে হাজার হাজার শিক্ষার্থী ও দর্শনার্থী।

বাংলাধারা/এফএস/টিএম

আরও পড়ুন