২ নভেম্বর ২০২৫

একনেকে প্রকল্প অনুমোদনের খবরে উচ্ছ্বাস

নিজস্ব হাসপাতাল পাচ্ছে কক্সবাজার মেডিকেল কলেজ

শুরু থেকেই পিছিয়ে থাকা কক্সবাজার মেডিকেল কলেজ (কমেক) প্রতিষ্ঠার ১৫ বছরে পূর্ণতা পাচ্ছে। অবশেষে একনেকে অনুমোদন পেয়েছে মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। গত মঙ্গলবার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহি কমিটির (একনেক) সভায় কমেক হাসপাতাল প্রকল্পসহ প্রায় ১৪ হাজার ৭৭ কোটি ৮৬ লাখ টাকা ব্যয় সম্বলিত ২০টি প্রকল্প অনুমোদন হয়। এ তথ্য প্রচার পাবার পর শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও সচেতন মহলে উচ্ছ্বাস বিরাজ করছে। কমেক হাসপাতাল না হওয়ায় ক্লিনিক্যাল প্রশিক্ষণে পর্যাপ্ত বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে বঞ্চিত ইন্টার্ন চিকিৎসকদের মাঝে এ নিয়ে সবচেয়ে বেশি আনন্দ দেখা দিয়েছে। পাশাপাশি চিকিৎসা বঞ্চিত কক্সবাজারের ২৮ লাখ জনগণ ও অগণিত পর্যটক এবং পর্যটন সেবায় থাকা লোকজন সরকারকে সাধুবাদ জানিয়ে যত দ্রুত সম্ভব প্রকল্পটি বাস্তবায়নের অনুরোধ জানিয়েছেন।

সূত্রমতে, কক্সবাজার সদর হাসপাতালের একটি ছোট ইউনিটে ২০০৮-২০০৯ সেশনে শিক্ষার্থী ভর্তির মাধ্যমে কমেকের যাত্রা। কিন্তু ১৫ বছরেও জেলাবাসী কক্সবাজার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসা সেবার সুযোগ পায়নি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৭ সালের ৬মে কক্সবাজার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ভিত্তি স্থাপন করলেও তা আলোর মুখ দেখেনি। পর্যটন নগরীর অগণিত রোগী শয্যার অভাবে সদর হাসপাতালের ফ্লোরে চিকিৎসা নেয়। একটু জটিল সমস্যা হলেই তাকে পাঠানো হচ্ছে চট্টগ্রাম কিংবা ঢাকায়। এতে অনেক রোগী পথেই মৃত্যুকে আলিঙ্গন করছেন।

স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রনালয় ২০১০ সালের নভেম্বরে কক্সবাজার সদর হাসপাতালকে অস্থায়ী কমেক হাসপাতাল ঘোষনা করে। তখন থেকে এখানেই ইন্টার্ণরা ক্লিনিক্যাল প্রশিক্ষণ এবং রোগীকে সেবা দিচ্ছেন। ভিক্তিপ্রস্তরের পর গত ৬বছরেও আলোর মুখ না দেখা কমেক হাসপাতাল অবশেষে গত ২৯ আগস্ট একনেকের সভায় অনুমোদন পেয়েছে। কিন্তু এর নির্মাণ কাজ কবে শুরু হবে, এবং এর বরাদ্দ কত; এ সংক্রান্ত সবিশেষ এখেেনা জানাতে পারেননি সংশ্লিষ্টরা।

কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর ডা. মো. ফরহাদ হোসেন বলেন, কমেক হাসপাতাল প্রকল্পটি গত মঙ্গলবার একনেকে অনুমোদন হয়েছে বলে জেনেছি। তবে এ সংক্রান্ত বিস্তারিত তথ্য এখনও পাইনি। আরও কয়েকদিন সময় লাগতে পারে।

অধ্যক্ষ বলেন, কমেকে হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার দাবী কলেজের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি স্থানীয় জনগণেরও। কমেক নিজস্ব হাসপাতাল পেলে এখানকার শিক্ষার্থীরা কলেজের পাশেই হাতে-কলমে শিক্ষা নিতে পারবে। বর্তমানে কমেক থেকে প্রায় ৬ কিলোমিটার দূরে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে গিয়ে তাদের ব্যবহারিক ক্লাশ নিতে হয়। তবে কলেজের ক্যাম্পাসে স্থাপিত পিসিআর ল্যাবে ২০২০ থেকে চলমান সময় পর্যন্ত পৌণে ৪ লাখ করোনার নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। যা বৃহত্তর চট্টহ্রামে একটি রেকর্ড।

কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডস্ট্রিজের সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী খোকা বলেন, কমেক নিজস্ব হাসপাতাল পেলে একদিকে সদর হাসপাতালে রোগীদের চাপ কমবে, অন্যদিকে স্থানীয় জনগণের পাশাপাশি কক্সবাজার বেড়াতে আসা লাখো পর্যটকের স্বাস্থ্যসেবারও উন্নতি ঘটবে। বর্তমানে সদর হাসপাতালে শয্যার অভাবে প্রায়ই মেঝেতে অবস্থান নিয়ে রোগীদের চিকিৎসা নিতে হয়। একটু জটিল সমস্যায় হলেই তাকে পাঠানো হচ্ছে চট্টগ্রাম কিংবা ঢাকায়। এতে অনেক রোগী যাত্রাপথেই মারা যায়।

কক্সবাজার নাগরিক ফোরামের সভাপতি আ.ন.ম হেলালউদ্দিন বলেন, সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ ২০১১ সালে স্থাপিত হয়ে ছয় বছরের মাথায় ২০১৭ সালে কলেজ হাসপাতাল উদ্বোধন হয়। ২০১৩ সালে গাজীপুরে শহিদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ স্থাপিত হয়ে মাত্র চার বছরের মধ্যে মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল উদ্বোধন হলেও দীর্ঘ ১৫ বছর নিজস্ব হাসপাতাল পায়নি কক্সবাজার মেডিকেল কলেজ। এরপরও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বদান্যতায় গত মঙ্গলবার একনেকে কমেক হাসপাতাল প্রকল্পটি অনুমোদন পাওয়ায় আশায় বুক বেঁধেছি আমরা। আমাদের কামনা দ্রæত কাজ শুরু হয়ে নির্ধারিত সময়ে পর্যটন নগরী আধুনিক একটি হাসপাতাল ও সেবা যেন পায়।

সূত্র মতে, কক্সবাজার সদরের ঝিলংজার জানারঘোনা এলাকায় ৩৩ একর জায়গায় কমেক স্থায়ী ক্যাম্পাসে ২০১১-২০১২ সালে অবকাঠামো তৈরি হলেও নির্মাণাধীন কলেজ ও হোষ্টেলের নতুন ক্যাম্পাস ছিল সম্পূর্ণ অরক্ষিত। কলেজের জায়গার ভেতর ৩৪ শতক জমি ছিল অধিগ্রহনহীন। হোষ্টেল না থাকায় ৫টি ভাড়া বাড়ীতে অবস্থান ছিল শিক্ষার্থীদের। এমন সময়েই ২০১৫ সালের ১৯ ডিসেম্বর অধ্যক্ষ হিসেবে আসা কক্সবাজারের সন্তান অধ্যাপক (ডা.) মোহাম্মদ রেজাউল করিম বাউন্ডারিসহ সকল সংকট দূর করে ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে স্থায়ী ক্যাম্পাসে কলেজের কার্যক্রম স্থানান্তর করেন। নানা তদবিরে ২০১৭ সালের ৬মে কমেকের স্থায়ী হাসপাতালের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করাতে সক্ষমহন। একই বছর তিনি চাকরি থেকে অবসরে (২৯ জুন ২০১৭) গেলে হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার কাজ আর এগুইনি।

আরো জানা যায়, এরপর ২০২২ সাল পযন্ত সময়ে আরো দুজন অধ্যক্ষ দায়িত¦পালন করে গেছেন, তবে হাসপাতালের ফাইলটি আর সামনে যায়নি। কিন্তু কমেক অধ্যক্ষ হিসেবে চলতি বছরের শুরুতে দায়িত্ব নেয়ার পর ডা. ফরহাদ হোসেন কমেক ক্যাম্পাসে হাসপাতাল গড়তে তোড়জোড় শুরু করেন। এরই ফল গত মঙ্গলবার একনেকে হাসপাতাল প্রকল্প অনুমোদন।

জেলা আওয়ামী লীগ নেতা মো. খোরশেদ আলম বলেন, কমেক হাসপাতালটি পূর্ণতা পেলে এখানকার চিকিৎসা সেবা বহুলাংশে এগিয়ে যাবে।

বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন (বিএমএ) কক্সবাজার শাখার সাধারণ সম্পাদক ডা. মাহবুবুর রহমান বলেন, রোহিঙ্গাদের কারণে সদর হাসপাতালে রোগীর চাপ অনেক। তাই কমেকে ৫০০ শয্যার হাসপাতাল নির্মাণ হলে স্থানীয় ও রোহিঙ্গাদের সেবা বাড়বে। চিকিৎসা জট কমবে সদর হাসপাতালে।

সম্প্রতি কক্সবাজারে হোপ ফাউন্ডেশনের ফিস্টুলা সেন্টার উদ্বোধনে এসে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক এমপি বলেছিলেন, ভুল উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনার (ডিপিপি) কারণে কমেকের হাসপাতাল নির্মাণ অর্ধযুগ পিছিয়ে ছিল। মানসম্মত চিকিৎসক তৈরীতে একটি মেডিকেলে পরিপূর্ণ হাসপাতাল অপরিহার্য। কক্সবাজারসহ আরো চারটি হাসপাতাল জিও ফান্ডে সম্পন্ন করতে ডিপিপি মন্ত্রণালয়ে পাশ হয়েছে। একনেকে পাশ হলেই, হাসপাতাল নির্মাণ কাজে হাত দেয়া হবে। ধীরে ধীরে কমেকের সকল সংকট পুরণ করার কার্যক্রম চলছে।

কলেজ সূত্র জানায়, একজন অধ্যক্ষসহ বিভিন্ন পর্যায়ে ৮৯টি শিক্ষকের পদ থাকলেও অনেক পদ এখনো শুণ্য। এরপরও সাম্প্রতিক ফাইনাল পরীক্ষায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন ১৪ মেডিকেল কলেজে পাশের হারে শীর্ষ ছিল কমেক। কমেকের শুরু হতেই কর্মচারীর সংকট ছিল যা এখনো বিদ্যমান। রাজস্ব খাতে ৩৪টি তৃতীয় শ্রেণীর পদ সৃষ্টি হলেও এক চিঠির মাধ্যমে তা ২৪ জনে নামিয়ে আনা হয়েছে। ২৪ জনেও কর্মরত ৫ জন, একজন সংযুক্তি, আরেকজন প্রেষণে কাজ করছে। আর আউটসোর্সিং ৪৫পদ হলেও তাও কমিয়ে ২০ জনে নামিয়ে ফেলা হয়েছে। কর্মচারীর পদ অদ্যাবধি শুণ্য থাকায় কাজ কর্মে ব্যঘাত ঘটছে। ১০ তলার একাডেমি ভবনে ৬ তলা পরিপূর্ণ হলেও বাকি রয়েছে আরো চারতলা নির্মাণ। দুটি হোস্টেল ৬ তলা করে হবার কথা থাকলেও তিনতলা সম্পন্ন করে বাকি তিনতলা অসম্পূর্ণ রাখায় শিক্ষার্থীদের গাদাগাদি করে অবস্থান করতে হয়।

আরও পড়ুন