৩ নভেম্বর ২০২৫

নীল রাজ্যের রাণী ‘নীলগিরি’র দেশে

আশরাফুন নুর »

এই বছরের জানুয়ারি মাস, বাংলা পৌষের শেষে দিকে। শীতকাল। শহর থেকে দূরে নিরাপদে কাটাবো একদিন। ইচ্ছেপূরণ করতে এই শীতকালেই গিয়েছিলাম বান্দরবান। যে জায়গাটিকে আমরা বাংলাদেশের ভূ-স্বর্গ বলে থাকি। যদি কেউ মেঘ-পাহাড়ের লীলা খেলা দেখাতে চায় কিংবা পাহাড়ের চূড়ায় মেঘ ছুঁয়ে দেখার ইচ্ছা পূরণ করতে চায়, তাহলে যেতে হবে বান্দরবানের নীলগিরিতে।

বেড়াতে যাওয়ার জন্য একটু অন্য ধরনের লোকেশন কে না ভালবাসে! সকালবেলা চট্টগ্রাম থেকে গাড়িতে রওনা। ঢেউর মতো উঁচু-নিচু ও সাপের মতো আাঁকাবাকা রাস্তা সবুজের গহ্বরে হারিয়ে যাচ্ছি। ঘণ্টা দুই পর পৌঁছলাম ছবির মতো সাজানো প্রকৃতির লীলাভূমির শহরে। তখন প্রায় সকাল সাড়ে নয়টা বাজে। মন ভরে গেল বান্দরবান এসে।

ভ্রমণসূচির দিকে তাকালে প্রথমেই মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথের সেই শ্রীমধুর বাক্যটি-‘আমি ভ্রমণ করতে ভালবাসি, কিন্তু ভ্রমণের কল্পনা করতে আমার আরও ভালো লাগে।’

এবার আসা যাক ভ্রমণের কথায়। পৌঁছলাম বান্দরবানে। শহরের একটি হোটেলে উঠেছি। একদিন আগের হোটেল বুকিং দিয়ে রেখেছিল আলিউর ভাই। এই ভ্রমণে আমরা ছিলাম ১৪ জনের মতো। পরে বান্দরবানে এসে যুক্ত হলো আরও দুই জন। আমার ছোট ভাই হাসান ও তার বন্ধু মোরশেদ। হোটেলে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে নাস্তা করে নীলগিরিতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিলাম।

বান্দরবান শহরের বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন রাস্তায় চাঁদের গাড়ি নামক এক ধরনের বিশেষ গাড়ি ভাড়া করা হয়। গাড়িগুলোতে উপরে কোন ঢাকনা কিংবা চাদর জাতীয় কোন কিছুই থাকে না। এতে সরাসরি বাতাস, রোদ, কোয়াশা কিংবা বৃষ্টিতে ভিজে অন্যরকম ভ্রমণ উপভোগ করা যায়। গাড়িতে উঠে পড়ি আমরা। এই গাড়ি ভাড়া করতে হয় নীলগিরি পর্যন্ত। তবে বান্দরবান জেলা সদর থেকে সাধারণত বিকেল ৫টার পর নীলগিরির উদ্দেশে কোন গাড়ি যেতে দেয়া হয় না।

যদি কেউ মেঘের উপর দাঁড়িয়ে মেঘের সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে চায় তাহলে তাকে নীলগিরি যেতেই হবে। বান্দরবান শহর থেকে ৪৮ কিলোমিটার দূর ও সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২২০০ ফুট উঁচু নীলগিরি যাওয়ার পথে দেখা গেলো সেনা চেকপোস্টে পর্যটকদের নাম ও ঠিকানা লিপিবদ্ধ করতে হচ্ছে, আমরাও করে নিলোম। দেখা গেলো বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে এখানে রয়েছে কনফারেন্স হল, রেস্টুরেন্ট ও কটেজ। নীলগিরি ভ্রমনের পথে রাস্তার পাশ থেকে নেমে যাওয়া বিস্তীর্ণ গিরিখাত ও মেঘের ছোটাছুটি যে কেউ মুগ্ধ হবে। অজানা বাঁকের হাতছানি। উড়ে আসা মেঘ। দিগন্তে কাঞ্চন। নীলগিরির পাহাড়ের নীল-সবুজারণ্যে হারিয়ে যাওয়ার ডাক। পাহাড় যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছিল। যা আনল রোমাঞ্চ।

পাহাড়ের, সবুজ অরণ্যের প্রতি আমার আলাদা একটু টান আছে। বড় হয়েছি গ্রামে। গ্রামের মাটি, বায়ু, আলোয় বেড়ে উঠা মানুষ হিসেবে প্রকৃতির প্রতি এক ধরনের মায়া কাজ করে। তাই পাহাড় অরণ্য এসবের প্রতি আমার বুকের বাম পাশে এক রকম কাজ করে, দেখলেই প্রতিক্রিয়া শুরু হয়।

এরই মধ্যে খুবই ক্ষুধা লেগেছে। সেই সকালে খেয়ে এসেছি, আর খাওয়া হলো না। ক্ষুধা লেগেছে খুব। যাওয়ার পথে শৈলপ্রপাত, চিম্বুক পাহাড় ঘুরে একেবারে নীলগিরি। এবার চাদের গাড়ি থামালো চিম্বুক পাহাড়ে। নেমে সবাই পাকা পেঁপে খেলাম। ক্ষুধার তাড়নায় একটু বেশি খেয়ে ফেলেছি। চাও খেলাম।

বন্দরবারন শহর থেকে ২৬ কিলোমিটার দূরে এই চিম্বুক পাহাড় বাংলাদেশের তৃতীয় উচ্চতম পর্বত হিসেবে পরিচিত। ২৩০০ ফুট উচ্চতার এই চিম্বুক যাওয়ার সময় রাস্তার দু’পাশের দৃশ্য আমাকে চিত্তকে মুগ্ধ করেছে। উঁচুনিচু পাহাড়ী রাস্তা অন্য রকম এক রোমাঞ্চকর অনুভূতির সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে সেদিন। এই চিম্বুকের পাদদেশে মুরং বা ম্রো আদিবাসীদের বসবাস। আমরা চিম্বুকে কিছু সময় ঘোরাঘুরির পর এবার রওনা হলাম নীলগিরির পথে।

সাপের গতির ন্যায় উঁচুনিচু শ্বাসরুদ্ধকর পাহাড়ী রাস্তা, চারপাশে সারিবদ্ধ পাহাড়, মেঘের সাথে ছোঁয়াছুঁয়ি, পাহাড়ের ওপর হ্রদ, ঝর্ণার ধারা, পাহাড়ী নদীর খরস্রোত, বহু আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অকৃত্রিম সংস্কৃতিতে মিশে যাওয়া।বৃক্ষলতা ও সবুজে ঘেরা পাহাড়, নদী, হ্রদ, ঝর্ণার অমোঘ সৌন্দর্যের টানে সারা বছর, বিশেষ করে শীত মৌসুম জুড়ে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের ভিড় লেগেই থাকে। নীলগিরির কাছাকাছি রয়েছে বেশ কয়েকটি ম্রো উপজাতিদের গ্রাম।

পৌঁছলাম শেষ বিকেলের দিকে। পাহাড়ী ঠাণ্ডা এভাবে কখনো অনুভব করিনি জীবনে। পৌঁছতেই একটি দোকানে ঢুকে পড়ি। আমার স্বভাব খাদ্য না পেয়ে এক ধরনের কাপে করে রেডিমেট ন্যুডলস খেলাম। পরে টিকেট কেটে ভেতরে ঢুকে পড়ি। এতো সুন্দর জায়গা, আবহাওয়া ও পরিবেশ আমাকে দিশাহারা করে দিয়েছে। আগে কি দেখবো, কোথায় ছবি তুলবো সব মিলে দিশাহারা ছিলাম। যদিও আমার ছবি তুলার এত সখ আগে কখনো উঠেনি। সেদিন হঠাৎ এতো আন্দোলিত হয়েছি যে, ছোট ভাই ও তার বন্ধুর সাথে অসংখ্য ছবি তুলেছি। জীবনে এতো ছবি তুলার রেকর্ড নেই আমার।

আকাশ-মেঘ ভ্রমণপিপাসু মানুষকে হাতছানি দিয়ে ডাকে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে অনেক উচুঁতে অবস্থিত এই নীলগিরিতে সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হল পাহাড় আর মেঘের খেলা উপভোগ করা। অবারিত সবুজ প্রান্তর যেখানে মিশে যায় মেঘের ভেলায়। এখানে মেঘের সাথে পাহাড়ের যেন আজন্ম বন্ধুত্ব। প্রকৃতি এ এলাকাটিকে সাজিয়েছে আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে। এখানে ইচ্ছে করলেই ছোঁয়া যায় মেঘ, আকাশকেও মনে হয় বেশ কাছে।

বান্দরানের এই দুর্গম পাহাড়ে নীলগিরি পর্যটন কেন্দ্রে গড়ে তোলা হয়েছে আকাশ নীলা, মেঘদূত, নীলাতানা নামে পর্যটকদের জন্য সকল সুবিধা সম্বলিত তিনটি কটেজ। কটেজগুলো রাত যাপনের জন্য ভাড়া পাওয়া যায়। তবে আগে থেকে তা বুকিং দিতে হয়। এছাড়া বান্দরবান শহরে অনেকগুলো বিভিন্ন মানের হোটেল রয়েছে।

নীলগিরি ছাড়াও বান্দরবানের আকর্ষণীয় পর্যটন স্পটগুলোর মধ্যে রয়েছে চিম্বুক পাহাড়, নীলগিরি, বগা লেক, নীলাচল, শৈল প্রপাত, জীবন নগর পাহাড়, মিরিঞ্চা, আলী সুড়ঙ্গ, তাজিংডং বিজয়, কেওক্রাডং, ক্যামলং জলাশয়, উপবন লেক, কানাপাড়া পাহাড়, স্বর্ণ মন্দির, মেঘলা পর্যটন কমপ্লেক্স, প্রান্তিক লেক, শ্রভ্র নীল প্রভৃতি।

কেন জানি দুটি জায়গায় আমর বারবার যেতে ইচ্ছে করে, বেড়াতে ইচ্ছে করে। রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান। সেই দিন নীলগিরি থেকে আসার পথে প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় মাথাব্যাথা শুরু হয়ে গেছে। এতো ঠাণ্ডা টনটন কাঁপিয়েছিল। আমার গায়ে চাদরে ভোট ভাইসহ প্যাঁচিয়ে ফেলেছি। কিছুতেই যেন এই ঠাণ্ডা সহ্য করার নয়।

হোটেলে এসে স্নান করে সবাই খেতে যাই। খেয়ে এসে বান্দরবানের সাংবাদিক বন্ধু ন্যুসিং থুই মারমাকে কল দিয়েছি। তিনি সাথে সাথে সাড়া দেন এবং দেখা করি দু’জনে। ন্যুসিং ভাই প্রায় সময় আমাকে বলে, ‘আপনি বেড়াতে আসেন’। কিন্তু এই শহরের যান্ত্রিক শেকল আটকে রাখে। তবুও যে পাহাড়ের টানে, প্রকৃতির টানে বারবার যেতে চাই। এই পাহাড়-অরণ্য নিয়ে রহস্যের শেষ নেই আমার। কোন শেকল আটকে রাখতে পারে টান পড়লে।

রাতে আমিরাবাদ হোটেলে খেলাম। পরদিন সকালে ছোট ভাইকে নিয়ে স্বর্ণমন্দির যাওয়া কথা রয়েছে। সকালে উঠেই নাস্তা অতপর স্বর্ণমন্দিরের দিকে রওনা হলাম। এক ধরনের ছোট মোটরে রিক্সায় করে গেলাম স্বর্ণমন্দিরে। যদিও এই জায়গায় আগেও দিয়েছি। তবুও আবার যেতে ইচ্ছে করলো ভোট ভাইয়ের অনুরোধে।

এই স্বর্ণমন্দির শহর থেকে মাত্র ৪ কিলোমিটার উত্তরে বালাঘাটে। মায়ানমার, চীন ও থাইল্যান্ড এর বৌদ্ধমন্দির গুলোর আদলে তৈরি এই মন্দিরে প্রবেশ করলে একটি শান্তিময় আবহ যেন অভিনন্দন জানায়। দেশের সর্ববৃহৎ এবং দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম মন্দির এটি। পঞ্চাশ টাকা করে টিকেট কেটে স্বর্ণমন্দিরে উঠলাম তিনজন। ছবির পর ছবি। শেষ নেই ছবি তোলার। দৃষ্টিনন্দন এই মন্দিরের গায়ে বাহারি কারুকাজ ও  সোনালি রঙের ছোঁয়া। আশপাশের প্রাকৃতিক পরিবেশ এখানকার সৌন্দর্যকে আরো আকর্ষণীয় করে তুলেছে।

বান্দরবানের পাহাড়গুলো যেন আকাশ ছোঁয়ার চেষ্টা। যেদিকে তাকাই শুধু সবুজ আর সবুজ। সবুজে শ্যামলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের হাজারও অপরূপ দ্যুতি। যা উপমার অতীত। সেই দিন কবিতাও লিখেছিলাম বেশ কয়েকটি। এসে কল্পনার রাজ্যে হারিয়ে যেতেও লিখেছিলাম আরও কয়েকটি। এই পাহাড় নিয়ে কথা উঠতেই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা একটি কবিতার কথাগুলো বারে বারে নাড়া দেয় আমাকে। এই পাহাড় নিয়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর ‘পাহাড় চূড়ায়’ কবিতায় লিখেছেন-

‘এখন আমি একটা পাহাড় কিনতে চাই।
সে ই পাহাড়ের পায়ের কাছে থাকবে গহন অরণ্য,
আমি সেই অরণ্য পার হয়ে যাবো,
তারপর শুধু রুক্ষ কঠিন পাহাড়।

একেবারে চূড়ায়, মাথার খুব কাছে আকাশম নিচে বিপুলা পৃথিবী, চরাচরে তীব্র নির্জনতা।
আমার কষ্ঠস্বর সেখানে কেউ শুনতে পাবে না।

আমি শুধু দশ দিককে উদ্দেশ্য করে বলবো, প্রত্যেক মানুষই অহঙ্কারী,
এখানে আমি একা- এখানে আমার কোনো অহঙ্কার নেই।

এখানে জয়ী হবার বদলে ক্ষমা চাইতে ভালো লাগে।…’

লেখক : সহ-সম্পাদক, বাংলাধারা ডটকম

আরও পড়ুন

এ সম্পর্কিত আরও

সর্বশেষ