অনিন্দ্য অলক »
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন জাতির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, জাতির ক্রান্তিকালে জাতিকে মুক্তির দিশা দেখিয়ে উত্তরণের পথে নিয়ে যাওয়ার জন্য দেবদূতের মত মহাপুরুষেরা আবির্ভূত হয়েছেন বারংবার। ঠিক তেমনই এক মহাপুরুষ ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান।
একদিন শেখ মুজিবুর রহমান তার এক সহকর্মীর বাড়িতে গেলেন বেড়াতে। বাড়ির উঠানে পা দিতে না দিতেই ৫-১০ বছর বয়েসী শিশুদের একটা দল তুমুল মিছিল আর শ্লোগান শুরু করে দিলো! কাঠির মাথায় কাগজ লাগিয়ে, মাথায় নিশান লাগিয়ে হুলস্থুল অবস্থা ! ছোট্ট উঠানে চক্রাকারে ঘুরছে আর বলছে – “তোমার নেতা, আমার নেতা – শেখ মুজিব, শেখ মুজিব”, “ভুট্টোর মুখে লাথি মারো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো”, “ইয়া হিয়া খানের মুসলমানি, এক পোয়া দুধে তিন পোয়া পানি” ঘুরে ফিরে আবারও, তোমার নেতা আমার নেতা – শেখ মুজিব, শেখ মুজিব।
শিশুদের এই কাহিনী দেখে বঙ্গবন্ধুর মন আনন্দে উদ্বেল হয়ে উঠলো। মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে যিনি নি:শঙ্ক চিত্তে চিৎকার করেছেন, আমি বাঙ্গালি, আমি মানুষ, আমি মুসলমান, একবার মরে দুইবার মরে না। সেই তিনিই শিশু মোর্চার সামনে দাঁড়িয়ে কৃত্রিম ভয় পাওয়ার ভঙ্গী করে তাদেরকে বললেন, “আরে.. বাবা! তোদের নেতা শেখ মুজিব! এমন বিচ্ছুদের নেতা হওয়ার সাহস আমার নাই।
শিশুরা যেমন বঙ্গবন্ধুকে ভালবাসাতেন, তেমনি বঙ্গবন্ধুও শিশুদের ভালবাসাতেন। শুধু তাই নয় তার মত এক অবিসংবাদিত নেতা যেভাবে তার সহকর্মি ও জনগনের খেয়াল রাখতেন তা এই ঘটনা থেকে বোঝা যায়।
১৯৭৫ সালের ৭ই মে। ৮ দিন আগে পিতা শেখ লুতফর রহমানকে হারিয়েছেন। শোকে মুহ্যমান সে সময়, তবুও নেতা কর্মীদের সকলকে নিয়ে জাহাজে করে রওনা দিলেন টুঙ্গিপাড়ার উদ্দেশ্যে, পিতার চেহলাম এর জন্য। রাতের খাবার সেরে সিনিয়র নেতারা যে যে যার কেবিনে চলে গেলেন। কেউ কেউ ডেকেই বিছানা পেতে শুয়ে পড়লেন।
জাহাজের ঢুলুনিতে মধ্যরাতে মাহবুব তালুকদার এর ঘুম ভেঙ্গে যায়। ঘুম ভেঙ্গে তিনি অবাক হয়ে যান। তিনি দেখেন তার মাথার নিচে একটি বালিশ। অথচ, সবাই যখন কেবিনে কিংবা ডেকে যার যার মতো শুয়ে পরেছিলেন, তিনি খেয়াল করেছিলেন তার জন্য ঘুমানোর কোনও ব্যবস্থা নেই। তিনি মাথার নিচে হাত দিয়ে একটা সোফায় টান হয়ে শুয়ে পরেছিলেন যতোদূর মনে পরে। পাশেই এডিসি রব্বানী জেগে ছিলেন। জিজ্ঞেস করলেন, ‘এডিসি সাহেব, মাথার নিচে বালিশ আসলো কোথা থেকে?’
এডিসি রব্বানী জানালেন, রাতের সাড়ে ১২টার দিকে বঙ্গবন্ধু দেখতে এসেছিলেন, সবার ঠিক মতো শোয়ার ব্যবস্থা হয়েছে কি না। আপনার কাছে এসে দেখলেন, মাথার নিচে হাত দিয়ে ঘুমাচ্ছেন। বললেন, ‘মাহবুব এইভাবে শুইয়া আছে। একটা বালিশ ওরে যোগাড় কইরা দিতে পারলা না?’ এরপর উনি নিজের কেবিনে গিয়ে নিজেরই একটা বালিশ এনে আপনার মাথার নিচে দিয়ে দেন।
মাহবুব সাহেব একইসাথে বিপন্ন ও বিস্মিত হলেন, কারণ তিনি জানতেন যে বঙ্গবন্ধু মাথার নিচে দুইটি বালিশ ছাড়া ঘুমাতে পারতেন না। তিনি একবার ভাবলেন, বালিশটি ফেরত দিয়ে আসবেন কি না। আবার ভাবলেন, এতোক্ষণে হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছেন, এখন ডাক দেয়া সমীচীন হবে না। ভোরবেলা, সূর্য ওঠার আগেই মাহবুব সাহেব দেখলেন, জাহাজের ডেকে একটি চেয়ারে হেলান দিয়ে পা দুলিয়ে দুলিয়ে আবৃত্তি করছেন, ‘নম নম নম সুন্দরী মম জননী বঙ্গভূমি’।
মাহবুব সাহেবকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি রাত্রে ভালো ঘুম হইছে তো?’ মাহবুব সাহেব বললেন, ‘জ্বি না। ভালো ঘুমাতে পারি নি।‘ – ক্যান? আমি তো তোমার মাথার তলে বালিশ দিয়া গ্যালাম। ঘুম হয় নাই ক্যান? – ওই জন্যই তো ঘুম হয় নি। আপনি নিজের মাথার তলের বালিশ আমার মাথায় দিয়ে গেলে ঘুম হওয়া কি সম্ভব?
এমনি অদ্ভুত ভালোবাসা ছিল দেশের মানুষের প্রতি তার। বাংলার জনগনও তাকে যে কতটা ভালবাসতেন তা বোঝা যায় তার লেখা অসমাপ্ত আত্মজীবনী বইয়ে বঙ্গবন্ধুর নিজের বর্ণনায়।
সময়টা ১৯৫৪, পাকিস্তানের ইতিহাসের প্রথম নির্বাচন। বঙ্গবন্ধুর নির্বাচনি এলাকার শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বি তারই প্রতিষ্ঠীত গোপালগঞ্জ মুসলিম লীগের মনোনীত প্রার্থী ওয়াহিদুজ্জামান। তার যেমন অর্থ বিত্ত তেমনি লঞ্চ, স্পিডবোট, সাইকেল, মাইক্রোফোন কোনো কিছুরই অভাব নেই তার। অপরদিকে আমাদের প্রিয় নেতার সম্বল বলতে আছে দুইখানা সাইকেল, একটি মাইক্রোফোন আর যথেষ্ট অর্থের অভাব।
তিনি লিখেন ওয়াহিদুজ্জামান সাহেব যতই টাকা উড়াক টাকায় কুলাবে না, জনমত আমার পক্ষে। আমি যে গ্রামেই যেতাম, জনসাধারণ শুধু আমাকে ভোট দেওয়ার ওয়াদাই করতেন না, আমাকে বসিয়ে পানদানের পান এবং কিছু টাকা আমার সামনে নজরানা হিসাবে হাজির করত এবং না নিলে রাগ করত। তারা বলত, এ টাকা নির্বাচনের খরচ বাবদ দিচ্ছে।
বঙ্গবন্ধু আরো লিখেন ” আমার মনে আছে খুবই গরিব এক বৃদ্ধ মহিলা কয়েক ঘন্টা রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে, শুনেছে এই পথে আমি যাব, আমাকে দেখে আমার হাত ধরে বলল, বাবা আমার এই কুঁড়েঘরে তোমায় একটু বসতে হবে। আমি তার হাত ধরেই তার বাড়িতে যাই। অনেক লোক আমার সাথে, আমাকে মাটিতে একটা পাটি বিছিয়ে বসতে দিয়ে এক বাটি দুধ, একটা পান ও চার আনা পয়সা এনে আমার সামনে ধরে বলল, খাও বাবা, আর পয়সা কয়টা তুমি নেও, আমার তো কিছুই নাই।
আমার চোখে পানি এল। আমি দুধ একটু মুখে নিয়ে, সেই পয়সার সাথে আরও কিছু টাকা তার হাতে দিয়ে বললাম, তোমার দোয়া আমার জন্য যথেষ্ট, তোমার দোয়ার মূল্য টাকা দিয়ে শোধ করা যায় না। টাকা সে নিল না, আমার মুখে হাত দিয়ে বলল, গরিবের দোয়া তোমার জন্য আছে বাবা। নীরবে আমার চক্ষু দিয়ে দুই ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়েছিল, যখন তার বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসি। সেইদিনই আমি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, মানুষেরে ধোঁকা আমি দিতে পারব না। ”
সেবার মানুষও তাকে ধোঁকা দেয়নি। মোট ৩০৯ টি আসনের মধ্যে ২৯১টি আসনই পান বঙ্গবন্ধুর যুক্তফ্রন্ট ও তার সহযোগীরা। আর একক ভাবে সর্বাধীক আসন পায় আওয়ামী লীগ (১৪০ টি)।
বর্ষ পরিক্রমার চিরাচরিত নিয়মেই বিশেষ বিশেষ দিবসগুলো নির্দিষ্ট সময়েই আমাদের সামনে এসে হাজির হয়। তেমনি একটি বিশেষ দিবস আজকের ১৫ আগষ্ট। ১৯৭৫ সালের এই দিনে জাতির পিতাকে হারিয়ে অন্ধকার এক সময়ের মুখোমুখি হয় বাংলাদেশ। গর্বের ইতিহাস আছে যে জাতির, সেই জাতিরই এক কলঙ্কময় অধ্যায় এই দিন, জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানকে বুলেটে বিদ্ধ করার দিন। আজকের এই দিনে এই মহামানবকে জানাই শ্রদ্ধা ও ভালবাসা।
সূত্রঃ
১. বঙ্গবন্ধু (প্রবন্ধ: সরদার ফজলুল করিম, সম্পাদনায় অভিনয় কুমার দাস)
২. বঙ্গভবনে পাঁচ বছর, মাহবুব তালুকদার
৩. অসমাপ্ত আত্মজীবনী, শেখ মুজিবুর রহমান।













