২৬ অক্টোবর ২০২৫

পতেঙ্গা সৈকতে অবৈধ দোকান বাণিজ্য

মুহাম্মদ আব্দুল আলী »

চট্টগ্রাম শহর মানেই পাহাড়, সৈকত আর সবুজে ঘেরা নগরী। নানারূপ সৌন্দর্য্যে ঘেরা এই নগরীর অন্যতম আকর্ষণ পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত। মূল শহর থেকে প্রায় ১৪ কি. মি. দক্ষিণে এই সৈকতে ছুটির দিন গুলোতে অবসাদ কাটাতে পরিবার নিয়ে সৌন্দর্য উপভোগ করতে ছুটে যান নগরবাসী। কিন্তু এই সৌন্দর্য্যে ঘেরা সৈকত যেন দিন দিন সৌন্দর্য্য হারাচ্ছে অবৈধ দোকানপাট আর ভাসমান হকারে। প্রায় পাঁচ কিলোমিটার জায়গা জুড়ে পর্যটকদের জন্যে নির্মিত ওয়াকওয়ের অধিকাংশই দখলে নিয়েছে এই দোকানগুলো। বাদ যায়নি শিশুদের জন্যে নির্মিত কিডস জোনটিও। আর এতে প্রতিদিন ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে বিভিন্ন স্থান থেকে আসা পর্যটকদের। আর সৈকত হারাচ্ছে তার সৌন্দর্য্য।

নানা রঙের ছাতা আর দোকানে ভিড়ের সমুদ্রের বালুচর এখন সাধারণের দৃষ্টির আড়ালে। সাধারণ জনগণ বলছেন একটু প্রশান্তির খোঁজে এখানে এসেও দেখছেন একই রকম জঞ্ঝাট।

আগ্রাবাদ এলাকা থেকে আগত পর্যটক সাইদুর জানান, সাপ্তাহিক ছুটির দিনে বন্ধুদের সাথে এখানে আসি একটু ঘুরতে। আগে অনেকটাই পরিষ্কার ছিলো এই সৈকত। ওয়াকওয়ের পাশে বসার স্থানগুলোতে বসে প্রায়ই গান করতাম আমরা। কিন্তু এখন দিন দিন ভাসমান এই দোকানগুলোর সংখ্যা বাড়ায় কোথাও নিরিবিলি বসাটাই যেন দায়।

স্থানীয় এলাকার বাসিন্দা ইমন জানান, বাসার পাশে হওয়ায় প্রায় বিকেলে আমি এখানেই বসি। কিন্তু এখন আর আগের মতো সেই অনুভূতি হয় না। অতিরিক্ত কোলাহল আর দোকানগুলোর কারণে পরিবেশটা নষ্ট হচ্ছে।

২০১৯ সালে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) উদ্যোগে পতেঙ্গা সৈকতের আধুনিকায়ন এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নের কাজ করা হয়। গত দু বছরে পাল্টে গেছে সেই উন্নয়নের চিত্র। বিশ্বমানের পর্যটন কেন্দ্র তৈরী আর পর্যটকদের হাঁটার জন্য নির্মাণ করা হয়েছিল ৩০ ফিট ব্যাসে প্রায় সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার ওয়াকওয়ে। যেখানে এক সঙ্গে হাঁটতে পারবে প্রায় ৫০ হাজার মানুষ।

পর্যটকদের জন্যে নির্মিত সেই ওয়াকওয়ে এখন দোকানিদের দখলে। জানা গেছে, ভাসমান ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে এককালীন টাকা নেওয়া ছাড়াও প্রতিদিন দোকান প্রতি আদায় করা হয় দোকানের আকারভেদে ১০০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত। কেউ কেউ আবার বিভিন্ন সংগঠনের নাম দিয়ে করছে এসব অবৈধ দোকান বাণিজ্য।

অনুসন্ধানে জানা যায়, নুর মোহাম্মদ বলী নামে এক ব্যক্তি জড়িত এই বাণিজ্যের সাথে। তিনি সমুদ্র সৈকতের হকার সমিতির সভাপতি। অবৈধ দোকানের বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি দায় অস্বীকার করে বাংলাধারাকে বলেন, ‘অবৈধ দোকান বাণিজ্যের সাথে আমি জড়িত না। এগুলো সব কিছুই ওয়াহিদ মাস্টার নিয়ন্ত্রণ করে। স্থানীয় যুবলীগ নেতা মাইনুলও এর সাথে জড়িত। তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন সংগঠনই মূলত এই চাঁদাবাজি করে। কয়েকজন লোক সেই সংগঠনের নামে দোকানগুলো থেকে টাকা আদায় করে।‘

জানা যায়, পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত দোকান মালিক সমবায় সমিতির সভাপতি ওয়াহেদুল আলম মাস্টার প্রকাশ ওয়াহিদ মাস্টার।

তার ওপর আনা সকল অভিযোগ মিথ্যে বলে তিনি জানান, ‘চাঁদাবাজির অভিযোগটি ষড়যন্ত্রমূলক। নুর মোহাম্মদ এবং মুসা নেতৃত্বেই এই চাঁদাবাজি হচ্ছে। প্রতি দোকান থেকে তারা প্রতিদিন ১০০ থেকে ৩০০ টাকা করে চাঁদা তুলছে। শুধু চাঁদাবাজিই নয় নেয়া হয় অগ্রিম টাকাও। সমুদ্র সৈকত দোকান মালিক সমবায় সমিতি দোকানীদের সুবিধার জন্যেই কাজ করেছে। আমরা সবসময় অবৈধ বিষয়গুলোর বিপক্ষে ছিলাম। একারণেই তারা আমাদের বিরুদ্ধে এই ষড়যন্ত্র করে আঙ্গুল তুলেছে।‘

সরেজমিনে দেখা যায়, একদিকে যেমন প্রভাবশীলরা করছেন দোকান বাণিজ্য অন্যদিকে ট্যুরিস্ট পুলিশও যেন দাঁড়িয়ে আছে জমিদারের ভূমিকায়। ওয়ালটনের দেওয়া ট্যুরিস্ট পুলিশ বক্সটি তারা দিয়েছেন ভাড়ায়। সেই বক্সটি এখন পরিনত হয়েছে ক্যান্টিনে।

বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন করা হলে প্রথমে অস্বীকার করলেও পরবর্তীতে ট্যুরিস্ট পুলিশের পতেঙ্গা সাব জোনের ইনচার্জ ঈসরাফিল মজুমদার দোকান ভাড়া দেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, ‘দোকানটি ক্যান্টিন হিসেবে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। যতটুকু জানি, এক বছর ধরেই সেটি ভাড়ায় চলছে। আমি এখানে জয়েন করেছি চার মাস, আমি এসে এভাবেই দেখেছি।‘

দোকান ভাড়ার প্রসঙ্গে প্রশ্ন করলে তিনি জানান, দোকান ভাড়ার সম্পূর্ণ টাকা পুলিশের কল্যান ফান্ডে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ট্যুরিস্ট পুলিশের সহায়তায় সৈকত এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে চাঁদাবাজি করে আসছে সক্রিয় দুটি গ্রুপ। একটি গ্রুপের নেতৃত্বে রয়েছে স্থানীয় ওয়ার্ডের যুবলীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি মুছা, নুর মোহাম্মদ ও তাজুল । অন্যদিকে অপর গ্রুপটিকে নেতৃত্ব দিচ্ছে পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত দোকান মালিক সমবায় সমিতির সভাপতি ওয়াহিদুল আলম মাস্টার এবং স্থানীয় ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি মাইনুল ইসলাম।

পতেঙ্গা সৈকত ম্যানেজমেন্ট কমিটির সদস্য ও সিডিএ’র প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস বলেন, ‘সৈকতে শৃঙ্খলা ফেরাতে ও পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতকে বিশ্বমানের পর্যটন কেন্দ্র করা লক্ষ্যে এটিকে ইজারা দেওয়া সহ নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। উদ্যোগগুলো বাস্তবায়িত হয়ে সৈকতে শৃঙ্খলা ফিরে আসবে। তখন আর এমন বিশৃঙ্খলতা থাকবে না।‘

চট্টগ্রামের অন্যতম পর্যটন স্পট চাঁদাবাজি এবং অবৈধ দোকানে ভীড়ে সৌন্দর্য্য হারাচ্ছে বলেই অভিযোগ পর্যটক ও স্থানীয় বাসিন্দাদের। দ্রুত এর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিয়ে পুনিরায় সৈকতের সুস্থ পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে দায়িত্বশীলদের প্রতি আহ্বান করেন তারা।

আরও পড়ুন