১২ নভেম্বর ২০২৫

পাহাড়কে মৃত্যুকূপ বানাচ্ছে ভূমিদস্যুরা

মাকসুদ আহম্মদ, বিশেষ প্রতিবেদক »

পাহাড়কে মৃত্যুকূপ বানাচ্ছে ভূমিদস্যুরা। জেলা প্রশাসন কাগজে কলমের কমিটিতেই সীমাবদ্ধ। বিভাগীয় কমিশনার দফতরও মিটিংয়ে বিভিন্ন সরকারী সংস্থাকে ডেকে কাগুজে নির্দেশনায় শেষ। বৃষ্টি এলেই তোড়জোড় চলে মাইকিং আর উচ্ছেদ এবং উদ্ধার অভিযানের। পরিবেশ অধিদফতর নিশ্চুপ মাসোয়ারায়। পুলিশ প্রশাসন ম্যানেজ অর্থ লেনদেনে। ওয়াসা ও পিডিবি ব্যবহার সুবিধায় অবৈধ টাকা কামাচ্ছে। বিভিন্ন এনজিও সহায়তা প্রকল্পের নামে পাহাড়ে থাকতে উদ্বুদ্ধ করছে নিম্ন আয়ের মানুষকে। ভূমিদস্যুরা নিম্ন আয়ের মানুষকে কাজে লাগিয়ে পাহাড়কে সমতলে রূপ দিচ্ছে। বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলন বুলি আউড়িয়েই ক্ষান্ত।

মূলত, পাহাড় রক্ষার কেউ নেই, মৃত্যুকূপ বানাতে মরিয়া ভূমিদস্যুরা। সর্বশেষ গত সপ্তাহে ফিরোজশাহর বরিশাল ঘোনায় পাহাড়ের মাটি চাপায় মারা গেল ৪ জন।

অভিযোগ রয়েছে, বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ে পাহাড় ব্যবস্থাপনা সাব কমিটি ৩৬ সুপারিশ নিয়ে বসে আছে। ২০১৯ সালে খাতা কলমে ১৭টি ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড় চিহ্নিত করলেও কার্যকর কোনে ব্যবস্থা নেই। এসব পাহাড়ে বসবাসরত ৮৩৫টি পরিবারকে তিন বছর আগেই উচ্ছেদ করার কথা থাকলেও দীর্ঘ সময়ে তা পারেনি। বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয় থেকে আইওয়াশ উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা ভূমিদস্যু পাহাড় খেকোদের প্রশ্রয় দিচ্ছে। ফলে অভিযান হলেও তা ঢিমেতালে।

আরও অভিযোগ রয়েছে, কয়েকদিনের টানা বৃষ্টির কারণে কাটা পাহাড়গুলোর মাটি নরম হলেই ধসের আশঙ্কা করছে জেলা প্রশাসন। ফলে পাহাড়ে বসবাসকারীদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিতে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে দফায় দফায় মাইকিং করা হলেও কোনো পরিবর্তন নেই পাহাড়ে বসবাসকারীদের।

টাইগারপাস পুলিশ বক্সের উত্তর ও পূর্ব পাশে পাহাড়ের পাদদেশে এবং মাঝামাঝিতে গড়ে উঠা কাঁচা ঘর, তুলাতুলি ও ফয়স লেক এলাকার ১, ২ ও ৩ নং ঝিল এলাকায় পাহাড়ের কোলঘেঁষে গড়ে উঠেছে কাঁচা ও সেমি পাকা ঘর। এসব ঘরে বসবাস করছে শত শত পরিবার। ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় এসব পরিবারের লোকজনকে কম ভাড়ায় থাকতে সহায়তা করছে বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের ব্যানারে থাকা ভূমিদস্যুরা। ফলে পাহাড়ের পাদদেশে থাকা হত দরিদ্র শ্রেণির উপর যেকোনো মুহূর্তে পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটতে পারে। ঠেকানো যাবে না মৃত্যুর মিছিল।

কাগজে কলমে থাকা ঝুকিপূর্ণ পাহাড়ের তালিকায় থাকা সেই ১৭টি পাহাড় হলো– আমবাগানে এ.কে.খান কোম্পানীর পাহাড়, বায়তুল আমান সোসাইটির হারুন খানের পাহাড়, কৈবল্যাধামস্থ বিশ্বকলোনীর পাহাড়, আকবরশাহ রেলওয়ে হাউজিং সেসাইটির পাহাড় ও কবরস্থানের পাহাড়, পরিবেশ অধিদফতর সংলগ্ন সিটি কর্পোরেশনের পাহাড়, চট্টগ্রাম পলেটেকনিক কলেজ সংলগ্ন পাহাড়, ফয়সলেক সংলগ্ন মধুশাহার পাহাড়, এম আর সিদ্দিকের পাহাড়, ভেড়া ফকিরের পাহাড়, আমীন কলোনী সংলগ্ন ট্যাংকির পাহাড়, বায়েজিদের মিয়ার পাহাড়, মুরাদপুরের ফরেস্ট্রির পাহাড়, লেকসিটি আবাসিক এলাকার পাহাড়, ফয়সলেক আবাসিক এলাকার পাহাড় ও পূর্ব ফিরোজশাহ কলোনীর ১নং ঝিল সংলগ্ন পাহাড়। গত এক সপ্তাহের টানা বৃষ্টিতে এসব পাহাড় থেকে ঝুঁকিপূর্ণদের সরিয়ে নেয়ার কথা থাকলেও জেলা প্রশাসন সরাতে পারেনি।

প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছেন, মাইকিং কিংবা অভিযান করে কোনো লাভ হচ্ছে না। কারণ এদের স্থায়ীভাবে পুনর্বাসন করা না গেলে এ ধরনের মৃত্যুর মিছিল বন্ধ হবে না। খোদ পরিবেশ অধিদফতরের একশ’ গজের মধ্যেই বিএস ৭৮ দাগে পাহাড় আর টিলা কাটাচ্ছে ফারহানা ইয়াসমিন নামের এক নারী।

সূত্রে জানা যায়, মোটা অঙ্কে পরিবেশ অধিদফতরকে ম্যানেজ করে পাহাড়কাটা ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে ম্যানেজ করে অবৈধ ভবন নির্মাণ করা হয়েছে এই সরকারি পরিত্যক্ত জায়গায়। এছাড়াও আকবরশাহ মাজারের পাশেই পাহাড় কেটে প্লট বানিয়ে ও কাঁচাঘর নির্মাণ করে ভাড়া বাণিজ্য চালিয়ে আসছে নুরুজ্জামান নামের আরেক ভূমিদস্যু।

এছাড়া জেলা প্রশাসনের মালিকানাধীন জায়গাও নুরুজ্জামানের দখলে রয়েছে। ভূমিদস্যুদের কাছ থেকে সরকারি পরিত্যক্ত ৩ একর ১৩ শতক জায়গা উদ্ধারের বিষয়ে সরকারের কোনে মাথা ব্যথা নেই। কারণ এসব সম্পত্তি থেকে কাট্টলী ভূমি অফিসের কর্মকর্তারা অবৈধ অর্থ লেনদেনে নিশ্চুপ।

এদিকে, পরিবেশ দফতরের অপরপ্রান্তে পাহাড়ের পশ্চিম দিকের একটি অংশ কেটে ফেলায় পূর্বদিকে থাকা পিডিবির খুলশী সাব-স্টেশন ঝঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে। যেকোনো মুহূর্তেই বড় ধরনের অঘটন ঘটতে পারে।

সরেজমিনে দেখা যায়, বায়েজিদ লিংক রোডে কেউ কেউ পাহাড়ের ঢালে মাটির বস্তা দিয়ে আবাসগৃহ ঠেকানোর চেষ্টা করছে। টানা বৃষ্টির কারণে পাহাড়বাসীদের মধ্যে চরম আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। ফলে বিভিন্ন এলাকায় ধসের ঘটনা ঘটে কাটা পাহাড়গুলোতে। এক্ষেত্রে পাহাড় খেকোরা পাহাড়ের চূড়ায় গর্ত করে পাহাড় কাটার চেষ্টা করে যাচ্ছে।

সরেজমিনে আরও দেখা যায়, নগরীর মতিঝর্ণা ও বাটালী হিল সংলগ্ন পাহাড়ে অবৈধভাবে বিদ্যুৎ ব্যবহার করছে ২০০ পরিবার। বিভিন্ন সময়ে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হলেও কোনো লাভ নেই। প্রশ্ন উঠেছে বিদ্যুৎ সংযোগ অবৈধভাবে লাগালেও মিটার স্থাপন করেছে পিডিবি’র খুলশী বিক্রয় ও বিতরণ কেন্দ্রের অসাধু লোকজন।

লালখান বাজার বাগঘোনা এলাকার জামেয়াতুল উলুম ইসলামিয়া মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষের অবৈধ দখলে থাকা পাহাড়েও প্রায় ১’শর পরিবার ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে। নগরীর লালখান বাজার ও মতিঝর্ণা এলাকা থেকে প্রায় ৬’শর বেশি পরিবার ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে আছে, আকবরশাহ হাউজিং সোসাইটি, নাছিরাঘোনা, সুন্দরীর পাহাড় মিলে প্রায় ২’শ পরিবার, টাইগার পাসের বাটালী লি, একেখানের পাহাড়ে রয়েছে শতাধিক পরিবার, বায়েজিদের রৌফাবাদের মিয়ার পাহাড়ে রয়েছে প্রায় ৭৫ পরিবার, আকবরশাহ’র রেলের পাহাড়ে রয়েছে প্রায় অর্ধশত পরিবার। টাইগারপাস রেলের পাহাড় তথা বাটালী হিল, আকবরশাহর বেলতলী ঘোনা ও রেলের পাহাড় এবং মতিঝর্ণা এলাকায় থাকা রেলের পাহাড়ের পাদদেশে থাকারা অন্যত্র সরে যেতে নারাজ।

 

 

আরও পড়ুন

এ সম্পর্কিত আরও

সর্বশেষ