আলমগীর মানিক, রাঙামাটি »
পাহাড়ের দুর্গম এলাকাগুলোতে অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা, সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের অপতৎপরতা, প্রয়োজনীয় পরিবহন সংকট, শিক্ষক সংকট ও শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের প্রকট আবাসন সংকটের কারণে রাঙামাটিতে কচ্ছপ গতিতে চলছে প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম। সরকারিভাবে পাহাড়ে স্কুলের অবকাঠামো উন্নয়ন, বিনামূল্যে বই প্রদান, উপবৃত্তি প্রদান, বিদ্যালয় ভিত্তিক উন্নয়ন পরিকল্পনা, আর্কষণীয় পাঠদান, মিড ডে মিল, শিক্ষকদের আন্তরিক নিবিড় তত্ত্বাবধানে পাহাড়ি জনপদের শিশুরা বিদ্যালয়মুখী হলেও প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিক্ষক ও তাদের আবাসন সংকটের কারণে পার্বত্য রাঙামাটিতে প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থার কাঙ্খিত উন্নয়ন ঘটছে না। এতে করে প্রাথমিক পর্যায়ে বিদ্যালয়ে আসা-যাওয়া করা পৌনে এক লাখ শিশু শিক্ষার্থী তাদের কাঙ্খিত পাঠ্যক্রম থেকে বঞ্চিত থাকছে।
রাঙামাটি জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের তথ্যানুসারে, রাঙামাটির ১০ উপজেলায় সর্বমোট ৭০৭টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এসব বিদ্যালয়ের মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রাক-প্রাথমিকে ১৪১৫৪, প্রথম শ্রেণীতে ১১৭৫৩, দ্বিতীয় শ্রেণীতে ১২৫৪৬, তৃতীয় শ্রেণীতে ১৩০৫৩, চতুর্থ শ্রেণীতে ১২৭০১ ও পঞ্চম শ্রেণীতে ১২৩৯৪। সর্বমোট ৭৬৬০১জন শিক্ষার্থী রয়েছে, যার মধ্যে ৩৮১০৩ জন ছাত্র ও ৩৮৪৯৮ জন ছাত্রী রয়েছে। জেলায় প্রাথমিকে ভর্তির হার ৯৫ শতাংশ এবং ঝরে পড়ার হার ৭.২৬ শতাংশ।
রাঙামাটির সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর জন্য অনুমোদিত প্রধান শিক্ষকের পদ ৭০৭, নতুন সৃষ্ট প্রাক-প্রাথমিক পদসহ সহকারি শিক্ষকের পদ রয়েছে ৩৩২৮টি। বর্তমানে এই ৭০৭টি বিদ্যালয়ের মধ্যে প্রধান শিক্ষক রয়েছে মাত্র ৩৪৩ জন, সহকারী শিক্ষক রয়েছে ২৮৮০জন। বর্তমানে রাঙামাটি জেলায় প্রধান শিক্ষকের পদ খালি রয়েছে ৩৬৪টি। সহকারী শিক্ষক পদ শূন্য রয়েছে ৪৬২টি।

এদিকে শিক্ষার প্রসারে যেমনিভাবে রয়েছে শিক্ষক সংকট। তেমনিভাবে পাহাড়ি এই অঞ্চলে বিদ্যালয় সংলগ্ন এলাকাগুলোতে আবাসন ব্যবস্থা না থাকায় চরম বিপাকে পড়ছে কর্মরত নারী শিক্ষকরা। আবাসন সংকটের কারণে প্রতিদিনই শহর বা উপজেলা সদর থেকে কর্মস্থল দুর্গম পাহাড়ি এলাকার বিদ্যালয়ে যেতে গিয়ে পরিবহণ ব্যবস্থার অপ্রতুলতার ফলে পুরো দিনই কেটে যাচ্ছে কর্মস্থলে পৌঁছাতে।
শিক্ষক সমিতির নেতা ও রানী দয়াময়ী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রনতোষ মল্লিক বলেন, দুর্গম এই পার্বত্য এলাকায় শিক্ষক স্বল্পতা দিয়ে শিক্ষার বিস্তার কখনো সম্ভব নয়। তিনি বলেন, পাহাড়ের দুর্গমতার প্রেক্ষাপটে শিক্ষকদের আবাসন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি।
বনরূপা সরকারি মডেল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা অর্চনা চাকমা বলেছেন, শিক্ষকদের আবাসন সংকট নিরসন করতে না পারলে শতভাগ পাঠদান নিশ্চিত সম্ভব নয়।

আসামবস্তি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শংকর দে বলেন, মানসম্মত শিক্ষক নিয়োগ দিলেই আমাদের মানসম্মত শিক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারবো। নয়তো শিক্ষার মানোন্নয়ন সম্ভব নয়।
গৌধুলী আমানতবাগ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা হাসিনা আক্তার জানান, শিক্ষক হিসেবে আমাদেরকে বিদ্যালয় কেন্দ্রিক রাখা দরকার। কিন্তু বর্তমানে সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পের কাজগুলো শিক্ষকদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হচেছ। একেতো শিক্ষক সংকট তার ওপর চাপিয়ে দেওয়া বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের কাজগুলো করতে গিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠদান সম্ভবপর হয়ে উঠছে না। বিষয়গুলো দ্রুত নিরসনে উদ্যোগ নেওয়ার দাবি জানান প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকবৃন্দ।
রাঙামাটির জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মো. সাজ্জাদ হোসেন জানিয়েছেন, আমাদের ৩৫ শতাংশ প্রধান শিক্ষকের পদ সরাসরি সংরক্ষিত এবং বাকি ৬৫ শতাংশ প্রধান শিক্ষকের পদে সহকারী শিক্ষকদের পদোন্নতির মাধ্যমে দেওয়া হয়। এই লক্ষ্যে আমরা ইতোমধ্যেই আমরা সহকারী শিক্ষকদের সিনিয়ারি গ্রেডেটেশন সংক্রান্ত কাগজপত্র সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকট প্রেরণ করেছি। বিষয়টি চলমান রয়েছে। এটার পরে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয় তথা পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সুপারিশের মাধ্যমে পদোন্নতি দিয়ে প্রধান শিক্ষকের শূন্য পদগুলো পূরণ করা হবে।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সহকারী শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়াটাও চলমান রয়েছে। শিক্ষকদের আবাসন সংকট পাহাড়ে চরম বাস্তবতা মন্তব্য করে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড, রাঙামাটি জেলা পরিষদ বা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা যদি পাহাড়ের দুর্গম এলাকাগুলোর বিদ্যালয় সংলগ্ন এলাকায় আবাসন ব্যবস্থা করে দিতে পারে তাহলে নারী শিক্ষকরাসহ দূর-দূরান্ত থেকে বদলি হয়ে আসা শিক্ষকরা কর্মস্থলের পাশেই অবস্থান করে নির্দিষ্ট সময়ে পাঠদান কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে পারবে।
এদিকে কোভিডের কারণে দীর্ঘদিন রাঙামাটিতে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা যায়নি মন্তব্য করে শীঘ্রই রাঙামাটিতে প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নে শিক্ষক সংকটসহ অন্যান্য সংকট নিরসনে কাজ শুরু করা হবে বলে জানান রাঙামাটি জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অংসুই প্রু চৌধুরী।
তিনি জানান, ইতোমধ্যেই আমরা শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দিয়েছি, ইন্টারভিউ তারিখও পড়েছে, দ্রুততম সময়ের মধ্যেই আমরা নিয়োগ সম্পন্ন করতে চাই। রাঙামাটি জেলায় শিক্ষার মানোন্নয়নে অবকাঠামোগত উন্নয়নসহ মাতৃভাষায় পাঠদান নিশ্চিতকরণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়ন করছে রাঙামাটি জেলা পরিষদ।
পার্বত্য চট্টগ্রামজুড়েই সশস্ত্র তৎপরতা, চাঁদাবাজির পাশাপাশি পাহাড়ি জনপদের কোনো কোনো এলাকায় অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা, বাসস্থান থেকে বিদ্যালয়ের অধিক দূরত্ব, বিদ্যালয়ে শিক্ষক স্বল্পতা, ঢিলেঢালা পাঠদান, দারিদ্র্য, অভিভাবকদের অসচেতনতার ফলে পাহাড়ি জনপদে প্রাথমিক শিক্ষার হার কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছাচ্ছে না বলে মনে করছেন শিক্ষক ও সুশীল সমাজের নেতৃবৃন্দ।













