আলমগীর মানিক »
দেশের সর্ববৃহৎ উপজেলা বাঘাইছড়ির প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) মো. নুরুন্নবী সরকারের বিরুদ্ধে তৈরি হয়েছে অভিযোগের পাহাড়। এই কর্মকর্তা কর্তৃক হয়রানির শিকার হয়ে উপজেলার আইনশৃঙ্খলা সভায় প্রকাশ্যে বক্তব্যের মাধ্যমে অভিযোগ দিয়েছেন জনপ্রতিনিধিরা। তবে তার বিরুদ্ধে আনিত সকল অভিযোগ রাঙামাটির সর্বত্র চাউর হলেও এখনো পর্যন্ত বহাল তবিয়তেই রয়েছেন তিনি।
স্থানীয় জনসাধারনসহ প্রশাসনিক সূত্রগুলোর ব্যাপক ক্ষোভের বিষয়টি প্রকাশ্যে চলে আসায় পিআইও নুরুন্নবী সরকার তিনদিনের সরকারি ছুটি নেয়। তবে গত মঙ্গলবার তার ছুটি শেষ হবার পরেও রোববার পর্যন্ত তিনি অফিসে যোগদান করেননি বলে নিশ্চিত করেছেন বাঘাইছড়ি উপজেলা পরিষদের নির্বাচিত চেয়ারম্যান সুদর্শন চাকমা।
জেলার ত্রাণ অফিসের দায়িত্বশীল সূত্র নিশ্চিত করেছে, পিআইও নুরুন্নবী ছুটি নিয়ে নিজ অধিদপ্তরে তদবিরে গেছেন, যাতে করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে বাঘাইছড়ি থেকে অন্যত্র বদলি অর্ডার জারি হয়।
বাঘাইছড়ির একাধিক ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, টিআর ও কাবিখা প্রকল্পে প্রকল্প চেয়ারম্যান, স্থানীয় ওয়ার্ড মেম্বারগণ প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করে বিল বাবদ চেক নিতে উপজেলা পিআইও অফিসে আসলে সর্বনিন্ম ১৫ পার্সেন্ট কমিশন দিয়ে উক্ত বিলের চেকগুলো বুঝে নিতে হয়।
বিষয়টির সত্যতা যাচাই করতে ৩৩নং মারিশ্যা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মানব জ্যোতি চাকমা, ৩৭নং আমতলি ইউপি’র চেয়ারম্যান রাসেল চৌধুরী, ৩৬নং সাজেক ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নেলসন চাকমাসহ একাধিক ইউপি মেম্বার এর সাথে যোগাযোগ করা হলে তারা অভিন্ন তথ্য দিয়ে পিআইও কর্তৃক হয়রানি হওয়ার সত্যতা প্রতিবেদককে নিশ্চিত করেছেন।
সাজেকের ইউপি মেম্বার হিরানন্দ ত্রিপুরা, ৩৫নং বঙ্গলতলী ইউপির ২নং ওয়ার্ডের মেম্বার তরুন বিকাশ চাকমা জানান, পিআইও তার কাছ থেকে ১৫%, ৬নং ওয়ার্ডের মেম্বার নীতিশ চাকমা জানান, তার ৭৫ হাজার টাকার বিল থেকে পিআইও ২৪ হাজার টাকা অফিস খরচ বাবদ কেটে রেখেছেন।
৩৩নং মারিশ্যা ইউনিয়নের ইউপি মেম্বার (৯নংওয়ার্ড) মোফাজ্জল হোসেন, ৭নং ওয়ার্ডের মেম্বার রিপেল চাকমা, আমতলি ইউপির শমসের আলী মেম্বার সকলেই প্রতিবেদককে জানিয়েছেন, তারা নিজেরাই ১৫ শতাংশ হারে চাঁদা দিয়ে পিআইও নুরুন্নবীর কাছ থেকে তাদের টিআর-কাবিখা প্রকল্পগুলোর চেক নিয়েছেন।
এছাড়াও ৩২নং বাঘাইছড়ি ইউপি’র মেম্বার প্রিয় বিকাশ চাকমা ও জমির আলী মেম্বার জানিয়েছেন, অফিস খরচ দিয়েই বিলের চেক নিতে হয়। ৩৪নং রূপকারি ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ডের মেম্বার আব্দুল হামিদ জানিয়েছেন, আমার কাছে নগদ অর্থ না থাকায় আমি অনেক বুঝিয়ে পিআইও’র কাছ থেকে চেক বুঝে নিয়ে ব্যাংক থেকে সেটি ভাঙিয়ে পরে ১৫ পার্সেন্ট টাকা পিআইওকে দিয়েছি।
আমতলি ইউপি চেয়ারম্যান রাসেল চৌধুরী জানান, তিনি বাধ্য হয়েই বাঘাইছড়ির জনৈক ব্যবসায়ি শাহালমের মাধ্যমে ২০ হাজার টাকা পিআইওকে পাঠাই। ব্যবসায়ি শাহালম প্রতিবেদকের মুঠোফোন কলে বিষয়টি স্বীকার করেছেন।
জনপ্রতিনিধিদের সকলেই জানিয়েছেন, পিআইও নুরন্নবী সরকার ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে বাঘাইছড়ি উপজেলায় “অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচী”র আওতায় ৪০দিনের মধ্যে ৩০দিনের মজুরি দিয়ে বাকি ১০দিনের মজুরির অর্থ নিজে রেখে দেন।
আমতলি ইউপি চেয়ারম্যান রাসেল অভিযোগ করে বলেন, গত ২২-০৯-২০২০ তারিখে বাঘাইছড়ি উপজেলায় অনুষ্ঠিত মাসিক সভায় পিআইও নুরুন্নবী সরকার তার দপ্তর ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগ কর্তৃক আমতলীতে ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে তিনটি ব্রীজ শতভাগ অগ্রগতি হয়েছে বলে তথ্য উপস্থাপন করলেও আমতলিতে মাত্র দুইটি ব্রীজ হয়েছে। বাকি একটি ব্রীজের কোনো অস্থিত্বই নেই। এই ব্রীজের অর্থ পিআইও নিজেই আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগ করেছেন চেয়ারম্যান।
এদিকে বাঘাইছড়ি উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান কাইয়ুম জানিয়েছেন, পিআইও নিয়মনীতি অনুসরন না করে গুচ্ছ গ্রামের কিছু রেশন কার্ড অন্যত্র অন্যদের নামে বরাদ্ধ দিয়েছেন। এটা নিয়ে স্থানীয় গুচ্ছ গ্রামের বাসিন্দাদের মাঝে চরম অসন্তোষ বিরাজ করছে। হতদরিদ্র একজনের রেশন কার্ড বাতিল করে পিআইও নিজের বাসার কাজে মেয়ের নামে বরাদ্ধ দিয়েছেন বলেও অভিযোগ করেছেন অন্য এক জনপ্রতিনিধি। গুচ্ছগ্রাম নিয়ে সরকারের সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকলেও পিআইও সেটির একটি অক্ষরও অনুসরন করেন না বলে অভিযোগ তুলেছেন আমতলী ইউপি চেয়ারম্যান।
এছাড়াও পাহাড়ে সশস্ত্র তৎপরতায় লিপ্ত উপজাতীয় আঞ্চলিকদলের জন্য পিআইও নিজেই চাঁদা কেটে রাখেন এবং বিচ্ছিন্নতাবাদী এইদলগুলোর সাথে পিআইও’র একান্ত যোগাযোগ রয়েছে যার ফলশ্রুতিতেই গত ২৪শে ফেব্রুয়ারি ইউপি মেম্বার সমর বিজয় চাকমাকে গুলি করে হত্যা করেছে সশস্ত্র পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা। এমন অভিযোগ মাসিক সভায় উত্থাপন করে পিআইওর বিরুদ্ধে তদন্ত করার দাবি জানিয়েছেন আমতলী ইউপি চেয়ারম্যান রাসেল চৌধুরী।
ইউপি চেয়ারম্যানের এই ধরনের সরাসরি অভিযোগে বিষয়টি সংশ্লিষ্ট আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গুরুত্বসহকারে দেখা উচিত বলে মন্তব্য করেছেন বাঘাইছড়ি উপজেলা চেয়ারম্যান সুর্দশন চাকমা।
তিনি জানান, আমরা নিজেরা উপজেলা পরিষদের পক্ষ থেকে ইউএনও সহ সকলকে নিয়ে উক্ত বিষয়ে নিজস্বভাবে তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছি। শীঘ্রই পিআইও’র উদ্বর্তন কর্তৃপক্ষের নিকট পত্রের মাধ্যমে বিষয়গুলো জানানো হবে বলেও প্রতিবেদককে জানিয়েছে উপজেলা চেয়ারম্যান।
এদিকে বাঘাইছড়ির পিআইও নুরুন্নবী সরকারের এতো অপকর্মের বিরুদ্ধে জানতে চাইলে জেলার ত্রাণ কর্মকর্তা মো. রোকনুজ্জামান বলেন, আমার কাছে কেউ কোনো অভিযোগ দেয়নি। এছাড়া পিআইওদের উদ্বর্তন কর্তৃপক্ষ হলো উপজেলার ইউএনওগণ। এসব অভিযোগের ব্যাপারে ইউএনও’র সাথে যোগাযোগের পরামর্শও দেন তিনি।
বাঘাইছড়ি উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শরিফুল ইসলামের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, পিআইও’র বিরুদ্ধে আমাদের কাছে কেউ লিখিত অভিযোগ দেয়নি; তারপরও মাসিক সভায় যেহেতু বিষয়গুলো উঠেছে সেটি আমরা খতিয়ে দেখছি।
উপরোক্ত বিষয়গুলো নিয়ে পিআইও নুরুন্নবীর দুইটি মোবাইল নাম্বারে একাধিক কল দিয়ে রিসিভ না করলে তাকে মুঠোফোনে এসএমএস এর মাধ্যমেও উত্তর চাওয়া হয়। কিন্তু তিনি কোনো প্রকার উত্তর দেননি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বহুল বিতর্কিত পিআইও নুরুন্নবী সরকার তার পূর্বের কর্মস্থল গাইবান্ধায় থাকাকালীন সময়েও একাধিক অপকর্মের সাথে জড়িত ছিলেন বলে সম্প্রতি নিশ্চিত করেছে দুর্যোগ ও ত্রাণ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর কর্তৃপক্ষ। সেখানে তার বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগের ভিত্তিতে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে গাইবান্ধা জেলার সুন্দরগঞ্জ থেকে রাঙামাটি জেলার বাঘাইছড়িতে বদলি করা হয়েছে।
ইতিমধ্যেই চলতি মাসের মাঝামাঝি সময়ে পিআইও নুরুন্নবী সরকারের বিরুদ্ধে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ অধিদপ্তর তার অনিয়ম ও দুর্নীতি যাচাই বাছাইপূর্বক তার সকল অনিয়ম ও দুর্নীতি অসৎআচারণের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তাকে পিআইও থেকে পদ অবনতি করা হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা রুজু করা হয়েছে। এছাড়াও একই সংঙ্গে স্থায়ীভাবে লঘুদন্ড হিসেবে তার বেতন গ্রেডের নিন্মতর ধাপে অবনতি করে দশম গ্রেডের প্রারম্ভিক বেতন প্রদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে অধিদপ্তর কর্তৃপক্ষ। দুর্যোগ ও ত্রাণ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক (প্রশাসন-১) উপসচিব লুৎফর নাহার স্বাক্ষরিত অফিস আদেশে এই তথ্য নিশ্চিত করা হয়েছে।
বাংলাধারা/এফএস/এআর













