নিজস্ব প্রতিবেদক »
ক্রমেই বেড়ে চলেছে বালুদস্যুদের উৎপাত। যার ফলে পাল্টে যাচ্ছে মানচিত্র, ক্ষয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলনের কারণে ফেনী নদীর বাংলাদেশ অংশ ভেঙে ভারতের অংশে ভরাট হচ্ছে নদীর পাড়। এতে বিপুলসংখ্যক মানুষের বসতবাড়ি, ফসলি জমি ও সম্পদের ক্ষতি হচ্ছে। শুধু তাই নয়, বালু উত্তোলন নিয়ে মারামারি হানাহানির ঘটনাও ঘটছে প্রতিনিয়ত। যা মানবাধিকারের স্পষ্ট লঙ্ঘন বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ফেনীর সোনাগাজী, ছাগলনাইয়া ও চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার কয়েকটি প্রভাবশালী চক্র কব্জির জোর দেখিয়ে সোনাগাজীর কলমিচর থেকে দীর্ঘদিন ধরে বালু চুরি করছে। যা সঙ্গে জড়িত স্থানীয় প্রভাবশালী মহল। এছাড়াও বৈধ মহল থেকে রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করা হয়—পাওয়া গেছে এমন অভিযোগও।
এতে করে সরকার রাজস্ব বঞ্চিত হওয়ার পাশাপাশি ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছে নদী তীরবর্তী এলাকাগুলো। স্থানীয় প্রশাসন মাঝেমধ্যে অভিযানের নামে ‘আই ওয়াশ’ করেই শেষ করছে তাদের দায়িত্ব। ফলে বন্ধ হচ্ছে না বালুদস্যুদের উৎপাত। ফলে ভাঙন ঝুঁকির মুখে রয়েছে চট্টগ্রামের মিরসরাই অংশে অবস্থিত এশিয়ার সর্ববৃহৎ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শিল্পনগরের সংযোগ বেড়িবাঁধ, সড়ক ও বৈদ্যুতিক লাইন।

বালু উত্তোলন নিয়ে বিরোধে গুলিবিদ্ধ মেয়রসহ ৩ জন
এদিকে গতকাল (শুক্রবার) বেলা ১১টার দিকে ফেনী নদীতে বালু উত্তোলনকে কেন্দ্র করে দ্বন্দ্বে বারইয়ারহাট পৌরসভার মেয়র রেজাউল করিম খোকনসহ তিনজন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। মিরসরাই উপজেলার ওসমানপুর ইউনিয়নের ওসমানপুর বাজারের পশ্চিম পাশে ফেনী নদীতে এ হামলার ঘটনা ঘটে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে একটি পক্ষ অবৈধভাবে ফেনী নদীর মিরসরাই অংশে বালু উত্তোলন করছেন। এ নিয়ে পৌরসভার মেয়রের সঙ্গে তাদের দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়। বৃহস্পতিবার করেরহাট এলাকায় নির্মিতব্য বিদ্যুতের পাওয়ার প্ল্যান্টের জন্য মেয়র রেজাউলের লোকজন ওই নদী থেকে বালু উত্তোলন করতে গেলে তাদের দুটি নৌকা আটকে রাখে প্রতিপক্ষের লোকজন।
সকালে বিষয়টি মেয়র রেজাউল সমাধানের জন্য গেলে তার ওপরও হামলা চালানো হয়। এতে মেয়র রেজাউলসহ তিনজন গুলিবিদ্ধ হন।
এ বিষয়ে জোরারগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নুর হোসেন মামুন বলেন, ঘটনাস্থল পরিদর্শন করা হয়েছে। আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।
সিন্ডিকেটের সদস্য সরকার দলের প্রভাবশালী সদস্যরা
অনুসন্ধানে জানা যায়, সরকারি দলের শতাধিক সদস্যের সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে চলছে অবাধে বালু উত্তোলন। সাথে একটি প্রভাবশালী মহল এই অবৈধ কর্মকাণ্ডে লিপ্ত রয়েছে। ড্রেজার ও শ্যালো মেশিন বসিয়ে অবাধে বালু তুলায় নদের তীরে বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। বালু উত্তোলনের কারণে বিভিন্ন স্থানে ধসের সৃষ্টি হয়েছে।
স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী হওয়ায় এদের বিরুদ্ধে কেউ মুখ খোলেনা। মাঝে মাঝে প্রশাসন থেকে অভিযান চালিয়ে মেশিনপত্র জব্দ করা হলেও কিছুদিন পর আবার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যায়।
চট্টগ্রামের মিরসরাই এবং ফেনীর ছাগলনাইয়া ও সোনাগাজী উপজেলা সীমানা দিয়ে বঙ্গোপসাগরে মিলিত হওয়া এই নদীটিতে সরকারিভাবে বালু উত্তোলনের জন্য বার্ষিক ইজারা প্রথা চালু রয়েছে।
কিন্তু ইজারাদার কোনও নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে অবাধে বালু উত্তোলন করায় ফেনীর জগন্নাথ সোনাপুর, জয়পুর, জয়চাঁদপুর, মুহুরি, ধুমঘাট ব্রিজ, অলি নগরের পশ্চিমাঞ্চল, ঘোপাল ইউনিয়নের লাঙ্গমোড়া গ্রাম, ধুপঘাট ব্রিজ, শুভপুরসহ বিস্তীর্ণ এলাকায় ভাঙছে নদী। অবৈধভাবে বালি উত্তোলনের প্রতিবাদ করতে গেলেই নেমে আসছে চরম নির্যাতন।
বর্ষাকাল ছাড়াও বছর জুড়েই চলছে ফেনী নদীর ভাঙনের তাণ্ডবলীলা। অব্যাহত ভাঙনে বদলে গেছে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তবর্তী এলাকা ফেনীর মানচিত্র। ভারতের অংশে নদীপাড় হচ্ছে ভরাট। নদী পাড়ের মানুষ জানান, মূলত ২০ থেকে ২৫ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে অবৈধভাবে বালি উত্তোলনের কারণে ফেনী নদী ভাঙছে।
হুমকির মুখে মিরসরাইয়ের জনবসতি
মিরসরাই উপজেলার ১ নং করেরহাট ইউনিয়ন ও ২নং হিঙ্গুলী ইউনিয়ন এলাকায় প্রতিনিয়ত নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করেই ফেনী নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। ফলে ফেনী নদীর ভাঙনে ছোট হয়ে আসছে মিরসরাইয়ের জনবসতি। প্রতিদিন নতুন নতুন এলাকা ভাঙনের মুখে পড়ছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, গত কয়েক বছর ধরে ফেনী নদীতে চলছে অবাধে বালু উত্তোলন। ফলে নদী ভাঙনে ছাগলনাইয়ার শুভপুর ইউনিয়নের তিলকের চর এলাকার প্রায় অর্ধেক আবাদি জমিসহ বিস্তীর্ণ জনপদ ফেনী নদীর গর্ভে চলে গেছে। মানচিত্র সংকুচিত হওয়ার ব্যাপারটি জরিপ করে দেখা হবে।
স্থানীয়রা উদ্যোগ নিলেও মেলেনা প্রতিকার
বালু তোলার প্রতিবাদে স্থানীয়রা বিভিন্ন সময় মানববন্ধনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছে। কিন্তু তাতে কাজের কাজ কিছুই হয় না। উল্টো হয়রানির শিকার হন তারা।
এ বিষয়ে ১নং করেরহাট ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান এনায়েত হোসেন নয়ন বলেন, আমরা সরকারী নিয়ম-কানুন মেনে নদীর মাঝ খান থেকে বালু উত্তোলন করার জন্য নির্দেশ দিয়ে থাকি। কেউ যদি সে নির্দেশ অমান্য করে বালু উত্তোলন করে, সে ক্ষেত্রে উপজেলা প্রশাসন এর মাধ্যমে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।
এদিকে, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টনারশীপ সেন্টার (বিডিপিসি) কর্তৃক এক জরিপে ফেনী নদীর ভাঙনকে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের ফলে নদীর গর্ভে হারিয়ে যাচ্ছে হাজার হাজার একর জমি, বিলীন হচ্ছে বাংলাদেশিদের বসতভিটা ও বন্যা নিয়ন্ত্রনবাঁধের বিভিন্ন অংশ। অপরিকল্পিত ও অবৈধভাবে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকার বালু উত্তোলন হলেও বিপুল অংকের রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। সরকারি নির্দিষ্ট সীমারেখার বাইরে গিয়ে নদীর চর এমনকি সমতল থেকেও অবৈধভাবে বালু তুলছে।
ফেনী নদী ভাঙ্গন এখন ভয়াবহ রুপ নিচ্ছে। বিলীন হচ্ছে একেরপর এক জমি। এভাবে বালু তোলায় মারাত্মক ঝুঁকিতে রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ন প্রকল্পসহ এই জনপদ।

গত কয়েক বছর ধরে সরকার দলীয় নেতাকর্মীরা নদী থেকে বালু উত্তোলন করার ফলে সড়কের পাশে বিশাল গভীরতা সৃষ্টি হয়েছে। তখন থেকে সড়কটি নিচের দিকে দেবে গিয়ে বারবার ভাঙনের সৃষ্টি হচ্ছে। তারা নদীর ভাঙন রোধে কাজের গুণগত মান ঠিক রাখতে এবং পাইল-সাপোর্টিং দিয়ে সঠিক তদারকির মাধ্যমে কাজ সম্পাদন করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল বলেন, যেকোনো একটা নদী থেকে বালু উত্তোলন করতে হলে তার আগে নদীর পানিপ্রবাহের একটি সমীক্ষা হওয়া দরকার। এটি ছাড়া বালু তুললে ভাঙন দেখা দেবেই।
উল্লেখ্য, হাইড্রোগ্রাফিক জরিপের মাধ্যমে নদীর তলদেশে কোথায় কত দূরত্বে মাটি রয়েছে, তা আধুনিক পদ্ধতিতে চিহ্নিত করা বা এর মানচিত্র তৈরি করা হয়। ডুবোচর কাটতে হলে প্রথমে হাইড্রোগ্রাফিক জরিপ করতে হয়।
অপরদিকে ২০১০ সালের বালুমহাল আইনে বলা আছে, বিপণনের উদ্দেশ্যে কোনো উন্মুক্ত স্থান, ছড়া বা নদীর তলদেশ থেকে বালু বা মাটি উত্তোলন করা যাবে না। কিন্তু এই আইন অমান্য করে বালু উত্তোলনের ফলে পানি দূষণসহ নদীগর্ভের গঠনপ্রক্রিয়া বদলে যাচ্ছে এবং নদী ভাঙছে।













