২ নভেম্বর ২০২৫

প্রীতিলতার আত্মাহুতি দিবস আজ

প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার। বাংলার প্রথম বিপ্লবী এ নারী চট্টগ্রামের ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণ শেষে দেশের জন্য আত্মদানের আহ্বান রেখে আত্মাহুতি দেন। বাঙালি নারীকে তিনি শিখিয়েছিলেন নারীরাও দেশের জন্য লড়াই করতে পারে, শিখিয়েছেন বিপ্লবের জন্য স্বাধীনতার জন্য কী করে হার না মেনে চালিয়ে যেতে হয় এক জীবন। এক জন্মের কর্মে কেমন করে থেকে যেতে হয় মানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায়। বাঙালি নারী চিরকাল কেবল অবলা নয়। যে বাঙালি নারী আজীবন গৃহের কোণে থাকে কেবলই সাংসারিক কাজকর্মে। সেই নারীকে তিনি চিনিয়েছেন দেশের জন্য, বিপ্লবের জন্য একটি জীবনকে কতোখানি মহিমান্বিত করা যায়। কী করে গর্জে ওঠা যায় শোষকের বিরুদ্ধে।

প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার ঠিক ভুলে যাওয়ার মতো বিপ্লবী নন। কিন্তু তারপরও তিনি তার জন্মভূমি বাংলাদেশে এই প্রজন্মের কাছে তেমন পরিচিত নন যেখানে তিনি ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সক্রিয়ভাবে যুদ্ধ চালিয়ে তার জীবন অতিবাহিত করেছিলেন।

প্রীতিলতা বাংলাদেশের চট্টগ্রামের ৫ মে ১৯১১ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি একজন প্রতিশ্রুতিশীল ও মেধাবী ছাত্রী ছিলেন। তিনি তার স্কুলের সময়গুলো তার নিজের শহরেই কাটিয়েছিলেন। তার বাবা জগবন্ধু চট্টগ্রাম পৌরসভার একজন কেরানি হিসেবে তাদের সন্তানদের জন্য সর্বোত্তম শিক্ষার ব্যবস্থা করার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি প্রীতিলতাকে চট্টগ্রামের ডা. খাস্তগীর সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ে ভর্তি করান।

প্রীতিলতার স্কুলের একজন শিক্ষক, যাকে ছাত্র ছাত্রীরা স্নেহভরে ঊষা’দি বলে ডাকত, তিনি রানী লক্ষ্মীবাইয়ের গল্প শুনিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে একধরনের জাতীয়তাবাদের অনুপ্রেরণা জোগাতে চেষ্টা করতেন।

প্রীতিলতার সহপাঠী কল্পনা দত্ত তার জীবনীতে লিখেছেন, ‘স্কুল জীবনে আমাদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কোনো স্পষ্ট ধারণা ছিল না। তখন ঝাঁসির রানী ও তার উদাহরণ দিয়ে আমাদের কল্পনাকে আকাশে উড়িয়ে দিলেন। তাই মাঝে মাঝে আমরা নিজেদেরকেও ভাবতাম নির্ভীক …।’

শিল্প ও সাহিত্য প্রীতিলতার প্রিয় বিষয় ছিল। তিনি ডা. খাস্তগীর সরকারি বালিকা বিদ্যালয় থেকে ১৯২৮ পাস করে ১৯২৯ সালে ঢাকার ইডেন কলেজে ভর্তি হন। ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায়, তিনি ঢাকা বোর্ড থেকে সেই বছর অংশগ্রহণকারী সকল শিক্ষার্থীদের মধ্যে থেকে প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন।

ইডেন কলেজের ছাত্রী থাকাকালীন, প্রীতিলতার ব্রিটিশবিরোধী অনুভূতিগুলো নিজের কাছে আরও ভিন্ন রূপ নিতে শুরু করে, কারণ সে আস্তে আস্তে বিপ্লবী দলের নেতৃত্বদানকারী অন্যান্য মহিলাদের সাথে পর্যায়ক্রমে যোগাযোগ গড়ে তোলে। এমনই একজন ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী লীলা নাগ, যিনি সুভাষ চন্দ্র বসুর সহযোগী হিসেবে দীপালী সংঘ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এটি একটি বিপ্লবী গোষ্ঠী ছিল যা মহিলাদের যুদ্ধের প্রশিক্ষণ প্রদান করত।

ঢাকার পড়াশোনা শেষ করার পর তিনি কলকাতার বেথুন কলেজে পড়েন। পরবর্তীতে প্রীতিলতা দর্শনশাস্ত্রে স্নাতক সম্পন্ন করেন। এই কলকাতা শহরেই প্রীতিলতাকে বিপ্লবী নেতা সূর্য সেনের সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়, যাকে সহযোগীরা সবাই স্নেহের সাথে ‘মাস্টারদা’ বলে ডাকতেন। সূর্য সেন দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে, প্রীতিলতা শীঘ্রই তার আন্ডারগ্রাউন্ড গ্রুপে যোগ দেন।

১৩৩০ সালের এপ্রিল মাসে চট্টগ্রামে আর্মরি অভিযানের সময় সূর্য সেন, গণেশ ঘোষ, লোকনাথ বল, অম্বিকা চক্রবর্তী, আনন্দ প্রসাদ গুপ্ত, ত্রিপুরা সেন, বিধুভূষণ ভট্টাচার্য, কল্পনা দত্ত, হিমাংশু সেন, বিনোদ বিহারী চৌধুরীসহ ২০ বছর বয়সী প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, সুবোধ রায়, মনোরঞ্জন ভট্টাচার্যসহ কমপক্ষে ৬৫ জনের একটি দল ব্রিটিশ বাহিনীর অস্ত্রাগারে অভিযান চালায়। তারা টেলিগ্রাফ এবং টেলিফোন লাইন ধ্বংস করার পরিকল্পনা করেছিলেন। যদিও দলটি অস্ত্রাগার শনাক্ত করতে সক্ষম হয়নি, তারা টেলিগ্রাফ এবং টেলিফোন লাইন নষ্ট করতে সফল হয়েছিল। দলের অনেক সদস্য তখন খুব ছোট ছিল, সুবোধ রায় মাত্র ১৪ বছর বয়সে সবচেয়ে ছোট সদস্য হিসেবে দলে যোগ দিয়েছিল।

টেলিগ্রাফ এবং টেলিফোন লাইন নষ্ট করার পর পুলিশের অভিযানে যখন দলের কিছু সদস্য ধরা পড়ে এবং গ্রেপ্তার হয়, তখন প্রীতিলতা এবং আরও কয়েকজন পরের কয়েক মাসে পালিয়ে যান এবং পুনরায় সংগঠিত হতে সক্ষম হন।

১৯৩২ সালে সূর্য সেনের চট্টগ্রামের পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ করার মূল পরিকল্পনা অনুসরণ করে এই গ্রুপটি প্রীতিলতাকে এই দায়িত্বের জন্য নেতা হিসেবে নিয়োগ দেয়। ইউরোপীয়দের জন্য সামাজিক ক্লাবটি বিশেষভাবে লক্ষ্য করা হয়েছিল কারণ ভারতীয়দের প্রতি বর্ণবাদী ও বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে, বিশেষ করে সাইনবোর্ডের ব্যবহৃত লেখা ‘কুকুর এবং ভারতীয়দের অনুমতি নেই’ যা তাদের আন্দোলনকে আরও উজ্জীবিত করেছিল।

প্রীতিলতার নেতৃত্বে, ১০ জনের একটি দলকে অস্ত্র ব্যবহারের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল এবং প্রয়োজন পড়লে কীভাবে পটাশিয়াম সায়ানাইড সেবন করতে হয় তা শেখানো হয়েছিল।

১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের সময় গুড ফ্রাইডের কারণে ক্লাব বন্ধ থাকায় পাহাড়তলী ইউরোপীয়ান ক্লাব আক্রমণ করা সম্ভব হয়নি। ১৯৩২-এর ১০ আগস্ট শৈলেশ্বর চক্রবর্তীর নেতৃত্বে সাতজনের একটা দল আক্রমণ করতে ব্যর্থ হলে শৈলেশ্বর চক্রবর্তী পটাশিয়াম সায়ানাইড খেয়ে আত্মহত্যা করেন। পুনরায় মাস্টারদা ১৯৩২-এর সেপ্টেম্বর মাসে ক্লাবে নারী বিপ্লবীদের নেতৃত্বে হামলা করার সিদ্ধান্ত নিলেন। কিন্তু সাত দিন আগেই পুলিশের হাতে পুরুষবেশী কল্পনা দত্ত ধরা পড়ায় আক্রমণে নেতৃত্বের ভার পড়ে প্রীতিলতার উপর। শুরু হলো কাট্টলীর সাগর পাড়ে অস্ত্রশিক্ষা ও মহড়া। মহড়ায় রিভলভার, পিস্তলের গুলির শব্দ সাগরের গর্জনের সাথে মিশে গিয়েছিল।

দিনটা ছিল, ২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৩২ সাল। প্রীতিলতা মালকোঁচা দেয়া ধুতি আর পাঞ্জাবি, পায়ে রবার সোলের জুতা। চুল ঢাকা দেবার জন্য মাথায় সাদা পাগড়ি পরিধান করেছিলেন। পাঞ্জাবিদের কোয়ার্টার পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাবের খুব নিকটে ছিল তাই সন্দেহ এড়ানোর জন্য পাঞ্জাবি ছেলেদের মতো পোশাক পরিধান করা হয়েছিল। ২৩ সেপ্টেম্বর সকাল বেলা বিপ্লবী দলটি মাস্টারদা ও তারকেশ্বর দস্তিদারকে অভিবাদন জানান।

দলের অন্যান্য সদস্যরা হলেন- ধুতি আর শার্ট পরা কালীকিংকর দে, বীরেশ্বর রায়, প্রফুল্ল দাস, শান্তি চক্রবর্তী এবং লুঙ্গি আর শার্ট পরা ছিলেন মহেন্দ্র চৌধুরী, সুশীল দে আর পান্না সেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী ইংরেজদের আচরণে বিক্ষুব্ধ মনসুর বাবুর্চির টর্চলাইট জালিয়ে ও জয়দ্রথ নিশানা দেখিয়ে আক্রমণ শুরু করার ইশারা প্রদান করেন। প্রীতিলতা হুইসেল বাজালে রাত আনুমানিক ১০টা ৪৫ মিনিটে মাস্টারদার পরিকল্পনা অনুযায়ী, বিলিয়ার্ড হলে বীরেশ্বর রায়, প্রফুল্ল দাস ও পান্না সেন আক্রমণ করেন। ক্লাবের হল ঘরে আক্রমণ করেন প্রীতিলতা, কালীকিংকর দে ও শান্তি চক্রবর্তী। দরজা ও জানালায় পাহাড়ায় থাকেন মহেন্দ্র চৌধুরী, সুশীল দে। ওয়েবলি রিভলবার, বোমা, তরবারি, রাইফেল ও ৯ ঘড়া পিস্তল নিয়ে আক্রমণ শুরু হয়। ঘন ঘন গুলি আর বোমার আঘাতে পুরো ক্লাব কেঁপে উঠছিল।

ক্লাবের সব বাতি নিভে যায় এবং কয়েকজন ইংরেজ অফিসার রিভলবার নিয়ে পাল্টা আক্রমণ করেন। ইংরেজ অফিসারের রিভলভারের গুলিতে প্রীতিলতার বাঁ-পাশে আঘাত লাগে। প্রীতিলতার নির্দেশে আক্রমণ শেষ করে বিপ্লবী দল পুলিশ ক্লাব থেকে ১০০ গজ এগিয়ে আসেন। আহত প্রীতিলতা ইংরেজদের কাছে লাঞ্ছিত হওয়ায় চেয়ে মৃত্যু শ্রেয় বলে সিদ্ধান্ত নেন। রিভলবারটা কালীকিংকর দে’র নিকট দিয়ে পটাশিয়াম সায়ানাইড মুখে পুরে দেন।

পটাশিয়াম সায়ানাইড খেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়া প্রীতিলতাকে বিপ্লবী দল শ্রদ্ধা জানিয়ে সবাই স্থান ত্যাগ করে।
পুলিশের রিপোর্ট অনুযায়ী সেদিনের এই আক্রমণে মিসেস সুলিভান নামে একজন নিহত হয় এবং চারজন পুরুষ এবং সাতজন মহিলা আহত হয়।

প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন প্রীতিলতাকে প্রত্যেক নারীর জন্য আদর্শ বলে আখ্যায়িত করেন।

আরও পড়ুন

এ সম্পর্কিত আরও

সর্বশেষ