২৪ অক্টোবর ২০২৫

ফিস্টুলা চিকিৎসায় আশা জাগিয়েছে ‘হোপ ফাউন্ডেশন’

প্রসবজনিত ফিস্টুলা রোগীদের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিতে আশা জাগিয়েছে ‘হোপ ফাউন্ডেশন কক্সবাজার’। ফিস্টুলা রোগীদের সেবায় কক্সবাজার-টেকনাফ সড়কের রামুর চেইন্দা এলাকায় ১০০ শয্যার ‘হোপ মেটারনিটি এন্ড ফিস্টুলা সেন্টার’ গড়ে তুলেছে হোপ ফাউন্ডেশন ফর উইমেন এন্ড চিলড্রেন অব বাংলাদেশ। দেশে ফিস্টুলার চিকিৎসায় এ কেন্দ্রটি একমাত্র আধুনিক রেফারেল সেন্টার হিসেবে কাজ করবে। এখানে নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিত করণ, প্রসবজনিত ফিস্টুলা’র সার্জারিসহ করা হবে দেশি-বিদেশি সার্জনদের ফিস্টুলা বিষয়ক প্রশিক্ষণ ও গবেষণাও।

মঙ্গলবার (৩০ মে) নবনির্মিত হোপ মেটারনিটি এন্ড ফিস্টুলা সেন্টারটি উদ্বোধন করা হচ্ছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালিক বিকেলে এটির উদ্বোধেনের কথা রয়েছে বলে জানিয়েছেন হোপ ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান ডা. ইফতিখার মাহমুদ।

সরকারি সমীক্ষায় দেখা গেছে, বর্তমানে দেশে প্রায় ২০ হাজার প্রসবজনিত ফিস্টুলা রোগী রয়েছে। প্রতি বছর নতুন করে যোগ হচ্ছে আরও এক হাজার ফিস্টুলা রোগী। প্রসবের সময় কিছু ক্ষেত্রে জটিলতা দেখা দেয়। প্রসব বাধাগ্রস্ত হলে প্রসবের রাস্তায় ক্ষতের সৃষ্টি হয়। গর্ভবতী মায়ের সময়মতো শিশুর প্রসব না হলে, জরায়ুতে শিশু মারা যায়, দীর্ঘ সময়ে এই অবস্থায় থাকার কারণে মূত্রথলি বা পায়ুপথ মারাত্মক ইনজুরড বা ক্ষত হয় আর এটাই হলো- প্রসবজনিত ফিস্টুলা।

আরো জানা যায়, একারণে প্রস্রাব ও পায়খানার নিয়ন্ত্রণ থাকে না। এই ক্ষত সময়মত চিকিৎসা না হলে দীর্ঘদিন থেকেই যায়। এটা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ছাড়া কোনোভাবেই চিকিৎসা দেয়া সম্ভব নয়। নিয়ন্ত্রণ না থাকায় কখনো কখনো প্রস্রাব-পায়খানা দুটোই অনবরত ঝরতে থাকে। যত দিন যায়, পরিস্থিতি খারাপের দিকে যায়। নারীর শরীর থেকে দুর্গন্ধ ছড়াতে থাকে। ফিস্টুলা রোগীরা অনেক সমস্যায় ভুগেন। তাদের প্রজনন ক্ষমতা চলে যায়। স্বামী ত্যাগ করে। সব সময় দুর্গন্ধ থাকায় সবাই তার কাছ দূরে থাকেন। এতে মানসিক, পেশাগত সমস্যা এমনকি বৈবাহিক সম্পর্কও থাকে না। নিজেরা সবসময় লজ্জাবোধ করেন। জীবিত থেকেও তারা সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন ও মানবেতর জীবন যাপন করেন।

হোপ ফাউন্ডেশনের কান্ট্রি ডিরেক্টর কে এম জাহিদুজ্জামান জানান, ফিস্টুলা রোগীদের সার্জারির দরকার হয়। এই সার্জারি অনেক ব্যয়বহুল। দক্ষ সার্জন ছাড়া সবাই সার্জারি করতে পারে না। ফিস্টুলার রোগে আক্রান্তদের কথা মাথায় নিয়ে এসব রোগীদের সেবার লক্ষ্যেই হোপ ফাউন্ডেশনের ২০১১ সাল থেকে কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। ফিস্টুলায় দেশে প্রশিক্ষিত সার্জন তৈরী করছে হোপ। দেশে যে কয়েকটি জায়গায় এই সার্জারি হয় তাদের মধ্যে হোপ ফাউন্ডেশন শীর্ষে।

তিনি আরো জানান, কক্সবাজারের কৃতি সন্তান, যুক্তরাষ্ট্রের নেব্রাস্কা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজ অব পাবলিক হেলথে্র অধ্যাপক ডা. ইফতিখার মাহমুদ দীর্ঘদিন ধরে মাতৃস্বাস্থ্য, নবজাতক, প্রসবজনিত ফিস্টুলা ইত্যাদি বিষয়ে গবেষণা করছেন। তার জন্মস্থান কক্সবাজারেই, তিনি ১৯৯৯ সালে গড়ে তুলেছেন ‘হোপ ফাউন্ডেশন ফর উইমেন এন্ড চিলড্রেন অব বাংলাদেশ’ নামক প্রতিষ্ঠান। এটি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীন এনজিও বিষয়ক ব্যুরো কর্তৃক রেজিস্ট্রিকৃত।

তার মতে, ১৯৯৯ সাল থেকেই ‘হোপ ফাউন্ডেশন ফর উইমেন এন্ড চিলড্রেন অব বাংলাদেশ’ জেলায় মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্য সেবা কার্যক্রম শুরু করে। আর ২০১১ সাল থেকে শুরু করে প্রসবজনিত ফিস্টুলা’র চিকিৎসা সেবা। গত ১০ বছরে হোপ হসপিটাল প্রায় ৯০০ জন ফিস্টুলা রোগীকে সার্জারি ও চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আনতে সক্ষম হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় ফিস্টুলার সকল ধরণের সেবার লক্ষ্যে ২০১৬ সাল থেকে নতুন হাসপাতাল ভবন নির্মাণকাজ শুরু হয়- যা ‘হোপ মেটারনিটি এন্ড ফিস্টুলা সেন্টার’ নাম করণ করা হয়েছে।

হোপের কান্ট্রি ডিরেক্টর বলেন, ফিস্ট্রলা রোগ নিয়ে হাতেগোনা যে ক’টি প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা কাজ করে তাদের সঙ্গে সমন্বয় করেই এগুচ্ছে হোপ ফাউন্ডেশন। বর্তমানে হোপ ফাউন্ডেশন চট্টগ্রাম বিভাগ ছাড়াও বরিশাল বিভাগের শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সঙ্গে সমন্বয় করে ফিস্টুলার সার্জারি করছে। এছাড়াও বরগুনা জেলার তালতলী উপজেলায় ফুড ফর হাঙ্গরি এনজিও’র সঙ্গে পার্টনারশিপে দুইটি ক্লিনিক স্থাপনের মাধ্যমে স্বাস্থ্য সেবা কার্যক্রম পরিচালনা করছে।

মা ও শিশু বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. ইফতিখার মাহমুদ বলেন, মিডওয়াইফারি সেবার মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিক ডেলিভারি হলেই প্রসবজনিত ফিস্টুলা রোধ করা সম্ভব। সেটি মাথায় নিয়ে হোপ ফাউন্ডেশন ২০১২ সাল থেকে বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ নার্সিং ও মিডওয়াইফারি কাউন্সিলের অনুমোদনক্রমে তিন বছর মেয়াদী সম্পূর্ণ আবাসিক ‘ডিপ্লোমা ইন মিডওয়াইফারি’ কোর্সটি চালু করেছে। শুরু থেকেই কক্সবাজার জেলা ও এর পার্শ্ববর্তী জেলার ছাত্রী ভর্তির মাধ্যমে এই শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। অত্র প্রতিষ্ঠান থেকে পাশ করা মিডওয়াইফরা বাংলাদেশ সরকারের পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি) কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে সরকারি হাসপাতালে কাজ করছে এবং অন্যরা বিভিন্ন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে যথেষ্ঠ সুনামের সাথে দায়িত্বপালন করছে।

অধ্যাপক ডা. ইফতিখার মাহমুদ আরো বলেন, রামুর দক্ষিণ মিঠাছড়ির চেইন্দাস্থ ৪০ শয্যা নিয়ে যাত্রা করা হোপ হসপিটাল ইতিমধ্যেই মডেল হসপিটাল হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছে। নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিত করতেই কাজ করছে হোপ ফাউন্ডেশন। এটি কক্সবাজার জেলার মাতৃ ও শিশুর মৃত্যুর হার কমাতে অবদান রাখছে-এটাই হোপ ফাউন্ডেশনের সিগনেচার বা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। পাশাপাশি হসপিটালটি প্রসবজনিত ফিস্টুলা চিকিৎসায়ও অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছে। সম্পূর্ণ বিনামূল্যে এ ধরনের জটিল চিকিৎসা একযুগ ধরে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাথে অত্যন্ত সুনামের সাথে করে আসছে হোপ ফাউন্ডেশন। বাংলাদেশ সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে প্রসবজনিত ফিস্টুলা নির্মূলের জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ।

হোপ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. ইফতিখার মাহমুদ জানান, হোপ ফাউন্ডেশন প্রসবজনিত ফিস্টুলা, ঠোঁটকাটা ও আগুনে পোড়া রোগীকে সম্পূর্ণ ফ্রিতে সার্জারি করছে। আর নারী ও শিশু চিকিৎসায় অন্যান্য সেবাগুলো ডিসকাউন্টে করা হয়। আর যাদের টাকা দেয়ার সামর্থ্য নেই তাদের জন্য সম্পূর্ণ ফ্রি চিকিৎসা সেবার ব্যবস্থা রয়েছে।

তিনি আরো জানান, প্রসবজনিত ফিস্টুলা চিকিৎসায় যারা ভালো হয়েছেন তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। সুস্থ হওয়া অনেককে ফিস্টুলা অ্যাম্বাসেডর হিসেবে নিয়োগ দিয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাদের নিয়ে আরও বড় স্কেলে কাজ করার পরিকল্পনার আছে। চট্টগ্রাম বিভাগের (কক্সবাজারের বাইরে) কয়েকটি অফিস নিয়ে বাকি জেলাগুলোতে ফিস্টুলা রোগীদের শনাক্ত করে চিকিৎসার আওতায় নিয়ে আসার পরিকল্পনা রয়েছে সংস্থাটির। ফিস্টুলা রোগী নিয়ে আরও কাজ করছে বিএসএমএমইউ, কুমুদিনী হাসপাতাল (টাঙ্গাইল), ল্যাম্ব হাসপাতাল (দিনাজপুর)। বর্তমানে হোপ হসপিটাল বছরে ১০০ সার্জারি করছে। তা বাড়িয়ে ৩০০ করার টার্গেট রয়েছে বলে হোপ ফাউন্ডেশনের।

ফিস্টুলা’র চিকিৎসা ব্যবস্থা এবং সক্ষমতা প্রসঙ্গে ডা. ইফতিখার মাহমুদ বলেন, সার্জন কম-ফিস্টুলায় সার্জনদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। আর এজন্য সরকারি, বেসরকারি ও দাতা সংস্থার সহযোগিতা দরকার। সরকারের অঙ্গিকারের কথা মাথায় রেখে ‘হোপ মেটারনিটি এন্ড ফিস্টুলা সেন্টারটি মঙ্গলবার (৩০ মে) উদ্বোধন করা হচ্ছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালিক বিকেলে এটির উদ্বোধেন করবেন।

কক্সবাজারের সিভিল সার্জন ডা. মো. মাহবুবুর রহমানের মতে, প্রসবজনিত ফিস্টুলার প্রকোপ বর্তমানে কিছুটা কমেছে। দেশে মাতৃস্বাস্থ্যের ব্যাপারে সরকার অনেক বেশি সতর্ক। বিভিন্ন যুগোপযোগী কার্যক্রম চলমান থাকায় বিগত ১০ বছরে মাতৃস্বাস্থ্যের অভূতপূর্ব অগ্রগতি হয়েছে। মিডওয়াইফরা গ্রাম-গঞ্জে কাজ করায় মাতৃ ও নবজাতকের মৃত্যু কমেছে। মাতৃ স্বাস্থ্যের উন্নতি হওয়ায় কমছে ফিস্টুলা রোগীর প্রকোপ। তবে, যেসব ফিস্টুলা রোগী আছেন তাদের চিকিৎসার আওতায় আনা একটা বড় চ্যালেঞ্জ।

তার মতে, অসচেতনতায় প্রতি বছরে হাজারো রোগী যোগ হয়। দেশে সব হসপিটাল একত্রে মিলে সার্জারি করতে পারে ৭০০ থেকে ৮০০ ফিস্টুলা রোগী। এ কারণে নম্বারটা কমছে না। এখন সমন্বিতভাবে বছরে সার্জারির এ সংখ্যাটা কয়েক হাজারে নিয়ে যাওয়াটা দরকার। দেশে ৩ থেকে ৪ গুণ ফিস্টুলা সার্জারি বাড়াতে পারলে আগামী ৫-৭ বছরে এর প্রকোপ অনেক কমে আসবে। এভাবে ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে প্রসবজনিত ফিস্টুলা নির্মূল অনেকটা সম্ভব হবে।

আরও পড়ুন