২৮ অক্টোবর ২০২৫

ফুটপাতে বসে আছে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

আকবর হোসেন রবিন  »

এক জেনারেশন বই সংগ্রহ করেন, দেখা গেল পরের জেনারেশনের বইয়ের প্রতি কোন আগ্রহ নেই। তাই ঘর পরিষ্কার করতে পুরো সংগ্রহটাই বিক্রি করে দেন। আবার কেউ কেউ বাড়ি বদল করার সময়ও বাড়তি বই বিক্রি করে দেয়। শহরের অলিগলি ঘুরে এসব পুরাতন বই কিনে আনে ফেরিওয়ালারা। তারা সেগুলো বিক্রি করে ভাঙারির দোকানে। কিন্তু বই পুরানো হয়, জ্ঞান তো পুরানো হয়না। হয়তো সেই কারণেই কিছু মানুষ ভাঙারির দোকান থেকে বেছে বেছে বই এনে বিক্রি করতে বসেন শহরের ফুটপাতে।

এমন একজন—দেওয়ানহাট কাঁচা বাজারের পাশে চট বিছিয়ে বসতেন; আসরের নামাজের পর। মধ্যবয়স্ক ওই লোকের পরনে থাকতো লুঙ্গি ও ঢিলেঢালা শার্ট। হালকা চুলের মাথায় ডানপাশ থেকে সিঁথি কাটা। দেখে বুঝা যেত—দুপুরে গোসল করার পর চুলে খুব যত্ন করে তেল মাখতেন। তবে পরিপাটির ছাপ বেশি স্পষ্ট তার সাজিয়ে রাখা বইয়ের পসরায়। এটা অনেক দূর থেকে নজর কেড়ে নিতো। ভার্সিটির ক্লাস শেষে ওই পথে ফেরার সময় মাঝেমধ্যে হাটু ভেঙ্গে বসতাম। একেকটা বই হাতে নিয়ে উল্টিয়ে-পাল্টিয়ে দেখতাম। পড়তে ইচ্ছে করলে সেটা কিনে নিয়ে আসতাম। এভাবে ওখান থেকে আমার বুক শেলফে এসেছে মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশ, এ্যানিমেল ফার্ম, রকযাত্রা, অভিলাষ ও পৃথিবীর পথে’র মতো অসংখ্য বই।

তবে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক এসেছে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। এটার পিছনে বিশেষ কারণ আছে; সুনীলের ‘সতের বছর বয়সে’ আমার পড়া প্রথম উপন্যাস। তখন ক্লাস এইট কিংবা নাইনে পড়ি। পাঠ্য বইয়ের বাইরেও যে আরও অনেক বই আছে, যেগুলো পড়লে মজা পাওয়া যায়, স্বপ্ন দেখা যায়; এই বিষয়টা তখন একদমই জানতাম না। এমন বয়সে একদিন কাজিনের পড়ার টেবিলে দেখি রঙিন মলাটের একটি বই; তাতে সুশ্রী এক মেয়ে। বইটি হাতে নেওয়ার পর মনে হলো—মেয়েটি তার টানা টানা চোখ দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে! এই তাকিয়ে থাকাটা মুহূর্তেই শরীরের মধ্যে কেমন উথাল-পাথাল ঝড় তুললো। আমি বইটি নিয়ে গোপনে পড়তে শুরু করলাম। পড়ার সময় দুই জায়গায় বারবার থেমে যেতাম। সুনীল এই দুই জায়গায় এমন ভাবে রাণুদির (উপন্যাসের প্রধান নারী চরিত্র) সৌন্দর্য্যের বর্ণনা দিয়েছে, যা বয়ঃসন্ধিকালে থাকা যেকোন ছেলেকে ফ্যান্টাসিতে ভুগাবে। আমিও ভুগেছি, রাণুদিকে নিয়ে কত কল্পনার রাজ্যে ঘুরেছি!

ঘুরে অনেক লম্বা সময় পার করে দিলাম। ধীরে ধীরে বড়ও হয়েছি। এরমধ্যে কত কত বই পড়েছি, ভুলেছি; তবে সেই স্মৃতিটুকু আজও ভুলিনি। বিশেষ করে যখন সুনীলের নাম দেখি তখন এই স্মৃতি একদম তাজা হয়ে চোখের সামনে ভেসে আসে। এমনই ভেসে আসা এক বিকেলে বিক্রেতাকে সুনীলের সাথে আমার পরিচয়ের গল্প শেয়ার করলাম। এরপর থেকে ভদ্রলোক তার সংগ্রহের সকল সুনীল সাহিত্য আমার জন্য আলাদা করে রাখতে শুরু করলেন; বইয়ের পসরা থেকে খানিক দূরে, কাগজের প্যাকেটে মুড়িয়ে। আমি উনাকে হতাশ করতে পারতাম না। বোধহয় সেজন্য সুনীলের অনেক নিরস বই আমার বুক শেলফে জায়গা পেয়েছে।

অনুরূপভাবে কিছু জায়গা দখল করেছে জহির রায়হান। তার ‘শেষ বিকেলের মেয়ে’ আমি হারিয়ে ফেলেছি, বেহালা শিক্ষকের বাসায়। একসময় প্রতি মঙ্গলবার বিকেলে কাঁধে বেহালা ঝুলিয়ে বাসা থেকে বের হতাম। এরপর একটা ধূলোয়মাখা জার্নি ও কিছু অনুগল্প নিয়ে হাজির হতাম গরীবুল্লাহ্ শাহ মাজারের পাশে এক গলিতে, ওখানে আমার স্যার প্রিয়তোষ বড়ুয়ার বাসা। প্রায় প্রতি ক্লাসে পোঁছাতে আমার দেরি হয়ে যেত। কখনোই নির্ধারিত সময়ে উপস্থিত হতে পারতাম না। এজন্য কোন কোন দিন স্যার দু-চার কথা শুনিয়ে দিতেন। আমি তখন তাকিয়ে থাকতাম স্যার যে জায়গায় বসতো তার পিছনের দেওয়ালে। ওখানে ফ্রেমে বন্দি স্যারের বাবা—প্রখ্যাত কবিয়াল ফণী বড়ুয়া। তার চেহারায় খুব বিনয়ী ভাব। তবে উপস্থিত অনেক শিক্ষার্থীর সামনে কড়া কথা শুনে আমার চেহারা থাকতো মলিন। স্যার এটা খেয়াল করতেন। হয়তো সেজন্য শুরুতে আমার বেহালা নিয়ে সুর ঠিক করে দিতেন। তারপর দেখাতেন তাল-রাগ। শুরুতে ভূপালী, পরে ভৈরবী। আর যেদিন স্যারের হাতে সময় থাকতো, সেদিন একের পর এক বেহালায় তুলতেন রবীন্দ্র-হেমন্ত সংগীত। তবে আমার বেশি ভালো লাগতো সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের মধুমালতী। এটা শুনলে এক ধরনের ঘোর তৈরি হত। এর রেশ থেকে যেত স্যারদের গলি পার হওয়া পর্যন্ত।

ওই গলি থেকে বের হলে ডানে গরীবুল্লাহ্ শাহ মাজার, বামের রাস্তা দিয়ে অনেক জায়গায় যাওয়া যায়। আমি কোনদিন একে খান, কোনদিন জিইসির দিকে রওনা হতাম। তবে এর আগে কিছুটা সময় কেটে যেত একটা ভ্যানের সামনে দাঁড়িয়ে। স্যারদের গলি থেকে বের হলেই পঞ্চাশোর্ধ বয়স্ক এক লোকের দেখা মিলতো। সে ভ্যানে বইয়ের পসরা সাজিয়ে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকে। তার সংগ্রহে বেশি ছিলো ‘তুমিও জিতবে’ টাইপের বইগুলো।

একদিন উনার ভ্যানের কাঁছে দাঁড়িয়ে ছিলাম। বেশকিছু সময় কেটে যাওয়ার পর ওই লোক জিঙ্গেস করলেন, ‘কোন বই খুঁজছেন?’

বললাম, আমার ‘শেষ বিকেলের মেয়ে’ হারিয়ে গেছে। যদি পাওয়া যায়, তাহলে যত্ন করে নিয়ে যাব।

উনি মাথা নাড়িয়ে জানালেন—বইটি নেই। পরে বস্তা থেকে একটা বান্ডিল বের করে আমার হাতে জহির রায়হানের তিনটি বই ধরিয়ে দিলেন। আমি সেগুলো নিয়ে বাসায় ফিরলাম। আর এভাবেই—আমার বুক শেলফে দাঁড়িয়ে গেলেন জহির রায়হান।

বাংলাধারা/এফএস/এআর

আরও পড়ুন