২৪ অক্টোবর ২০২৫

বঙ্গবন্ধুর শান্তি পুরস্কার ‘জোলিও কুরী’

মাকসুদ আহম্মদ, বিশেষ প্রতিবেদক »

আমরা স্বাধীন, আমরা পরাধীনতার শৃঙ্খলমুক্ত। এই স্বাধীনতার জন্য জাতিকে পাকিদের শোষণমুক্ত করতে ও দেশ মাতৃকার টানে মুক্তিযুদ্ধের ডাক দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতা দিবসের মধ্য দিয়ে বাঙালি ফিরে পেয়েছে সুজলা সুফলা শস্যে শ্যামলা এদেশ বাংলাদেশ। আর মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পেয়েছেন শান্তির প্রতীক ‘জোলিও কুরী’ পদক। এ পদক প্রাপ্তির পর তিনি দেশবাসিকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন ‘এ পুরস্কার আমার একার জন্য নয়, যে লাখো শহীদের রক্তে আজ বাংলাদেশ মুক্ত, স্বাধীন এ সম্মান তাদেরই দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশের সাড়ে ৭ কোটি মানুষ বর্বর পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে যে সংগ্রাম করেছে তারই পুরস্কার স্বরূপ এসেছে ‘জোলিও কুরী’ শান্তি পুরস্কার’।

এদিকে, খুলশী থানাধীন পুলিশবিট সংলগ্ন সৃজনী মাঠের সামনে থাকা শহীদ মিনার থেকে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও পাকিদের হত্যাযজ্ঞে শহীদদের নামফলক উপড়ে ফেলা হয়েছে বিএনপি-জামায়াত সরকারের আমলে। ৯০-এর দশকে এসে ওই এলাকার যুদ্ধাহত ও শহীদ পরিবারের সদস্যরা পাকিস্তানিদের আবাসস্থল পাঞ্জাবি লেনের নাম মুছে দিয়ে শহীদলেন নামকরণ করা হলেও শহীদদের স্মৃতিফলক থেকে নামফলক উপড়ে ফেলেছে জামায়াত-বিএনপি চক্র।

পাকিদের হাত থেকে দেশকে হানাদারমুক্ত করলেও মীর জাফরদের কারণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাজাকারমুক্ত করতে পারেননি বাংলাদেশ। রাজাকারদের চক্রান্তেই পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট ভয়াল রাতে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। তবে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ রেহানা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশে না থাকায় প্রাণে রক্ষা পান। স্বাধীনতা রক্ষা ও মুক্তিযুদ্ধে নিহত শহীদদের স্মৃতি রক্ষায় দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বধ্যভূমিগুলো সরকারি উদ্যোগে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়। বিভিন্ন অঞ্চলের বৃহদায়তন বধ্যভূমিগুলোতে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হলেও মুষ্টিমেয় কিছু স্মৃতিস্তম্ভ এখনও নির্মাণ সম্ভব হয়নি। ফলে অরক্ষিত রয়ে গেছে স্বাধীনতাকামী শহীদদের স্মৃতি বিজড়িত স্থানগুলো।

পাকিদের হত্যাযজ্ঞের করুণ কাহিনী বর্ণনা করতে গিয়ে ওই সময়কার প্রত্যক্ষদর্শী এ কে এম আফসার উদ্দিন ‘উন্মেষ’ নামক একটি ছোট্ট সংকলনে উল্লেখ করেছেন স্মৃতির কথা। ছোট্ট এ সংকলনটি মো. শহীদুল ইসলাম সম্পাদিত ও পাহাড়তলী শাখা থেকে সূর্যমুখী কাফেলা কর্তৃক নিবেদিত এ উন্মেষ প্রবন্ধটি। আফসার উদ্দিন তার লেখায় তুলে ধরেছেন- একাত্তর সালের ১০ নভেম্বর সেদিন ছিল ২০ রমজান। সকাল সাড়ে ৫টার দিকে ফজরের নামাজের পর আকবর শাহ মসজিদ থেকে নামাজ পড়ে বের হতেই পাক হানাদাররা ঐ মসজিদের ইমাম, মোয়াজ্জিনসহ বেশ কয়েক মুসল্লিকে ধরে নিয়ে যায়।

তিনি পাহাড়ের কোল ঘেঁষে নিজেকে আড়াল করে আরও ৪ জনসহ ফয়’স লেক সংলগ্ন কাঠাল বাগানের বধ্যভূমির কাছে গিয়েছিলেন। হত্যাযজ্ঞের নির্মম চিত্র ফুটে উঠেছে তার লেখায়। ওইদিন পাক হানাদাররা শুধু মসজিদ থেকেই নয়, বাসা বাড়ি থেকে ঘুমন্ত তরুণ যুবকদের টেনে হ্যাচড়ে যেমন নিয়ে যায় জল্লাদ খানায় তেমনি পাহাড়তলী স্টেশনে আসা ট্রেন থেকে অনেক যাত্রীদের নিয়ে ধারালো অস্ত্রের আঘাতে মৃত্যু নিশ্চিত করেছে। ফলে জল্লাদ খানার পার্শ্ববর্তী সরু খালটির পানি ও রক্তে পরিপূর্ণ হয়ে যায়।

এ জল্লাদ খানায় বাঙালি নিধনযজ্ঞের বর্ণনায় আরো পাওয়া গেছে, আকবর শাহ মসজিদের পাশে থাকা একটি দোকানে মুদি ব্যবসা করতেন নোয়াখালীর একজন। ৭১-এর ১০ নভেম্বর সকাল ৬টার দিকে পাক হানাদারদের কয়েক দোসর তাকে পাহাড়ের পাশে ৩/৪টি লাশ পড়ে আছে বলে মিথ্যা অজুহাতে ওই জল্লাদ খানায় ধরে নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তাদের হাত থেকে জল্লাদ খানার পাশেই থাকা খাল সংলগ্ন সড়কের কালভার্টের নিচে ঝাপ দিয়ে পাকিদের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করেছিলেন। তখন ছিল ভরা বর্ষা। কালভাটের নিচে একটি পাটাতন ধরে দীর্ঘ সময় কাটিয়েছেন খালের অথৈই পানিতে। এ সময় তিনি দূর থেকে দেখেছেন পাকিদের হত্যাযজ্ঞের নির্মম চিত্র। তখন তিনি ছিলেন ২৯ বছরের টগবগে যুবক।

চট্টগ্রামে সবচেয়ে বৃহৎ বধ্যভূমি হচ্ছে পাহাড়তলীর ফয়’স লেক সংলগ্ন কাঠাল বাগান বধ্যভূমি। ১৯৭১ সালের ১০ নভেম্বর এ বধ্যভূমিতে পাক পশুদের নারকীয় হত্যাযজ্ঞে এলাকাবাসি হারিয়েছে ময়না, মানিক, সফিসহ শত শত তরুণ, যুবক ও প্রবীণদের। আজও মাটি খুড়লে পাওয়া যাবে শহীদদের মাথার খুলি আর হাড়গোড়। নিরবে কেঁদে যাচ্ছে এসব আত্মত্যাগী প্রাণ। বিধস্ত বাংলার ৩০ লাখ শহীদের মাঝে দেশব্যাপী শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের নামের পাশে দ্বীপশিখা হয়ে জ্বলবে এ এলাকার যুদ্ধাহত শহীদরাও।

আরও পড়ুন