বাংলাধারা ডেস্ক »
ইংরেজি ক্যালেন্ডারের পাতা শেষ হয়ে এসেছে। একদিন পরেই সূর্যটি দিনের আলো ছড়িয়ে সন্ধ্যার আকাশে ডুব দেয়ার পর কালের গহ্বরে হারিয়ে যাবে ২০১৯ সাল। আর ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টে নতুন সম্ভাবনা নিয়ে শুরু হবে ইংরেজি নতুন বছর-২০২০ সাল। বিদায়ী বছরটি জুড়েই আলোচনায় ছিল জাহালামকাণ্ড, বরখাস্ত হওয়া ডিআইজ মিজানের অডিও টেপ ফাঁস, বালিশ ও পর্দাকাণ্ড, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মেডিকেল বই কেনা,বেসিক ব্যাংক দুর্নীতিসহ অবৈধ সম্পদ অর্জনের ‘শুদ্ধি অভিযানসহ নানা দুর্নীতি। একে একে বেরিয়ে আসে থলের বিড়াল। এসব ঘটনা নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন( দুদক)এর প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে উচ্চ আদালত।
জালিয়াতির মাধ্যমে সোনালী ব্যাংকের প্রায় ১৮ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ এনে ২০১২ সালে আবু সালেক নামে এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে ৩৩টি মামলা করে দুদক। এরপর সালেক নামে ওই ব্যক্তিকে তলব করে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থাটি। কিন্তু সেই চিঠি যায় টাঙ্গাইলে জাহালমের বাড়ির ঠিকানায়।
বাংলাদেশ জুট মিলের নরসিংদীর ঘোড়াশাল শাখার শ্রমিক জাহালম সে সময়ে দুদকের কার্যালয়ে হাজির হয়ে জানান, তিনি আবু সালেক নন, সোনালী ব্যাংকে তার কোনো অ্যাকাউন্টও নেই। এছাড়া ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট খোলার জন্য আবু সালেকের পরিচয়ে যে ছবি ব্যবহার করা হয়েছে, সেটিও তার নয়।
কিন্তু জাহালমকেই ‘আবু সালেক’ হিসেবে শনাক্ত করেন দুদকে উপস্থিত বিভিন্ন ব্যাংকের কর্মকর্তারা।পরবর্তীকালে ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঘোড়াশাল থেকে তাকে গ্রেফতার করে দুদক। এরপর আবারও আদালতে দুদকের পরিচয় বিভ্রাটের বিষয়টি তুলে ধরার চেষ্টা করেন জাহালম। কিন্তু নিজেকে নির্দোষ প্রমাণে তার এই দাবি মানতে কেউই রাজি হয়নি।
এক পর্যায়ে নির্দোষ হওয়া সত্ত্বেও জাহালমের তিন বছর ধরে কারাভোগের বিষয়টি সংবাদ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। পরে ২৮ জানুয়ারি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে একটি রুল জারি করে হাইকোর্ট । সবশেষে উচ্চ আদালতের হস্তক্ষেপে গত ৪ ফেব্রুয়ারি মুক্তি পান জাহালম। এরপর ১১ জুলাই আদালতে দাখিল করা নিজস্ব তদন্ত প্রতিবেদনে দুদক জানায়, তদন্ত কর্মকর্তাদের ভুলের কারণে আসামি না হয়েও জাহালমকে কারাভোগ করতে হয়েছে। এ ঘটনায় নিজেদের ১১জন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করার তথ্য পরবর্তীকালে হাইকোর্টকে জানায় দুদক।
এরপর বছরের মাঝামাঝি সময়ে পুলিশের ডিআইজি (বরখাস্ত) মিজানুর রহমান একটি অডিও টেপ ফাঁস হয়। এ নিয়ে দেশজুড়ে তোলপাড় শুরু হয়। অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধানে গিয়ে দুদকের তৎকালীন পরিচালক বাছির মিজানুর রহমানের কাছ থেকে ৪০ লাখ টাকা ঘুষ নিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠে। মিজানের এমন দাবির পরিপ্রেক্ষিতে তাদের কথোপকথনের অডিও ক্লিপও গণমাধ্যমে সরবরাহ করা হয়।
পরবর্তীকালে পরিচালক এনামুল বাছিরকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। পাশাপাশি ঘুষ লেনদেনের অভিযোগে তাদেরকে আসামি করে মামলা করেন কমিশনের পরিচালক শেখ মো. ফানাফিল্যা। এরপর জামিন চাইতে গেলে মামলার আসামি মিজানকে পুলিশের হাতে তুলে দেয় উচ্চ আদালত। এছাড়া গত ২২ জুলাই এনামুল বাছিরকে রাজধানীর দারুস সালাম এলাকা থেকে গ্রেফতার করে দুদক।ঘুষ লেনদেনের এই ঘটনা কমিশনকে অনেকাংশেই আস্থার সঙ্কটে ফেলে দেয়। এতে নিজেদের সমালোচনা উঠলে ঘর সামালাতে নড়েচড়ে বসে দুদক।
বছরের মাঝামাঝি সময়ে দেশের সংবাদ মাধ্যমগুলোতে প্রকাশিত প্রতিবেদনে রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কর্মীদের আবাসন প্রকল্পের খরচ আর ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পর্দা কেনাকাটার ব্যয় দেখে অনেকেরই চোখ কপালে উঠে যায়।যেখানে উঠে আসে ৬২ কোটি ২০ লাখ ৮৯ হাজার টাকার অনিয়মের এক নতুন চিত্র।এর মধ্যে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের গ্রিনসিটি আবাসন প্রকল্পের ১৬ ও ২০ তলা ভবনের প্রয়োজনীয় মালামাল কেনা ও ভবনে তোলার কাজে অস্বাভাবিক ব্যয় সবার নজর কাড়ে। প্রায় ৬ হাজার টাকার একটি বালিশ ভবনে ওঠাতে এক হাজার টাকার মতো খরচ দেখানো হয়েছে। এক পর্যায়ে হাইকোর্টের নির্দেশে গত জুলাইয়ে আদালতে জমা দেয়া তদন্ত প্রতিবেদনে চোখ কপালে তোলা এই দুর্নীতির জন্য ৩৪ জন প্রকৌশলীকে দায়ী করা হয়।
পরবর্তীকালে গত ১৭ অক্টোবর ওই অভিযোগসহ আবাসন প্রকল্পের বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ অনুসন্ধানের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয় দুদক। এরই ধারাবাহিকতায় ১২ ডিসেম্বর পাবনা গণপূর্ত বিভাগের সাবেক নির্বাহী প্রকৌশলী মাসুদুল আলমসহ ১৩ জন প্রকৌশলী এবং ঠিকাদারকে আসামি করে চূড়ান্ত মামলা করা হয়। সবশেষে আদালতের শুনানিতে যাচাই-বাছাই শেষে আসামিদের কারাগারে পাঠানো হয়।
বালিশ নিয়ে তেলেসমাতি কাণ্ডের ঘোর না কাটতেই চোখে পড়ে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের একটি পর্দার দাম। যেখানে হাসপাতালের আইসিইউয়ের রোগীকে আড়াল করে রাখার এক সেট পর্দা কেনা বাবদ খরচ দেখানো হয় ৩৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা। অস্বাভাবিক ওই ব্যয় নিয়ে প্রশ্ন উঠলে উচ্চমূল্যে হাসপাতালের যন্ত্রপাতি কেনাকাটার মাধ্যমে সরকারের ১০ কোটি টাকা আত্মসাৎ চেষ্টার অভিযোগে মামলা করে দুদক।
এরমধ্যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সরকারি মেডিকেল কলেজগুলোর বই কেনার ক্ষেত্রে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। এ অভিযোগে ৫ হাজার ৫০০ টাকার বই ৮৫ হাজার ৫০০ টাকায় কেনা হয়েছে বলে দাবি করা হয়। পরবর্তীকালে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এর তদন্তে কমিটি গঠন করলেও তার অগ্রগতি সম্পর্কে আর কিছু জানা যায়নি।
বছরের শেষ দিকে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও সরকার ঘোষিত ‘শুদ্ধি অভিযান’। ১৮ সেপ্টেম্বর রাজধানীর চারটি ক্লাবে ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালায় র্যাব। বেরিয়ে আসতে থাকে অবৈধ পন্থায় সম্পদ অর্জনের নানা চিত্র। এসব কর্মকাণ্ডে যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের বেশ কয়েকজন নেতার জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে।
পরবর্তীকালে গত ৩০ সেপ্টেম্বর থেকে এমনভাবে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগের অনুসন্ধানে নামে দুদক। গঠন করা হয় অনুসন্ধান দল, যাতে প্রধান করা হয় দুদকের পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেনকে।অনেক প্রভাবশালী নেতাকে গ্রেফতারের পর তাদের বিরুদ্ধে মাদক ও অবৈধ অস্ত্র রাখা এবং অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে বিত্তবান হওয়া মোট ১৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়।
এর মধ্যে দুদকের জালে আটকা পড়েন ঢাকা দক্ষিণ যুবলীগের সাবেক সভাপতি ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট ও তার সহযোগী এনামুল হক আরমান, বহিষ্কৃত যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া, আলোচিত ঠিকাদার জি কে শামীম, অনলাইন ক্যাসিনো হোতা সেলিম প্রধান, বিসিবি পরিচালক লোকমান হোসেন ভূঁইয়া, কলাবাগান ক্রীড়া চক্রের সভাপতি ও কৃষক লীগ নেতা শফিকুল আলম ফিরোজ,আওয়ামী লীগ নেতা এনামুল হক এনু ও তার ভাই রুপন ভূঁইয়া।তালিকায় যোগ হয় ঢাকার তিন কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান মিজান, তারেকুজ্জামান রাজীব ও এ কে এম মমিনুল হক সাঈদ,যুবলীগ নেতা জাকির হোসেন, যুবলীগের দপ্তর সম্পাদক আনিসুর রহমান ও তার স্ত্রী সুমি রহমানের নাম। পরবর্তীকালে তাদের কয়েকজনকে রিমান্ডে পেয়ে জিজ্ঞাসাবাদও করেছে দুদক।
সবশেষে আওয়ামী লীগের তিন সংসদ সদস্য নূরুন্নবী চৌধুরী শাওন, মোয়াজ্জেম হোসেন রতন ও সামশুল হক চৌধুরী সহ সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের প্রায় ২০০ জনের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান চালায় দুদক।
এরপর বনানী এলাকার কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউয়ের এফআর টাওয়ারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর ভবনটির নকশা জালিয়াতির বিষয়টি প্রকাশ পায়। পরে ভবন মালিক, নির্মাতা প্রতিষ্ঠান রূপায়ন গ্রুপের চেয়ারম্যান ও রাজউকের সাবেক দুই চেয়ারম্যানসহ মোট ২৩ জনের বিরুদ্ধে দুটি মামলা করে দুদক। সবশেষে নকশা জালিয়াতির একটি মামলায় গত নভেম্বরের শুরুতে আদালতে অভিযোগপত্র দেয়া হয়।
আর বছরের শেষ ভাগে এসে সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার বিরুদ্ধে ঋণ জালিয়াতির মামলায় আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয় দুদক। ফারমার্স ব্যাংকের গুলশান শাখা থেকে ব্যবসায়ী পরিচয়ে দু’ব্যক্তির কাছ থেকে ঋণের ৪ কোটি টাকা এস কে সিনহা নিজের অ্যাকাউন্টে নিয়ে গেছেন বলে অভিযোগের সূত্র থেকে জানা গেছে।
দীর্ঘ তদন্তের পর গত ১০ জুলাই সিনহাসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন দুদকের পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেন। পরবর্তীকালে ৪ ডিসেম্বর অর্থ আত্মসাতে সিনহার জড়িত থাকার প্রমাণ মিললে অভিযোগপত্র অনুমোদন করে কমিশন। সবশেষে ১০ ডিসেম্বর অভিযোগপত্রটি আদালতে জমা দেয়া হয়।এছাড়া বিদায়ী বছরটিতে বিভিন্ন সময়ে স্বাস্থ্য খাতসহ বেশ কয়েকটি খাতে দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান চালায় দুদক।
বাংলাধারা/এফএস/টিএম













