৪ নভেম্বর ২০২৫

‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত রোহিঙ্গা ডাকাতের বাংলাদেশী ‘স্মার্টকার্ড’ নিয়ে চাঞ্চল্য

সায়ীদ আলমগীর, কক্সবাজার »

মেয়ের রাজকীয় ‘কান ফোঁড়ানো’ অনুষ্ঠানে অঢেল উপঢৌকন পাওয়া নিয়ে গত এক সপ্তাহ ধরে সরব আলোচনার মধ্যমনি ছিলেন রোহিঙ্গা ডাকাত সর্দার নুর মোহাম্মদ (৩৬)। সাথে টেকনাফের ওয়ার্ড যুবলীগ সভাপতি ওমর ফারুক হত্যা মামলায় তার সম্পৃক্ততার কথা উঠে আসায় তীব্র সমালোচনার মুখেও পড়েন তিনি।

রোহিঙ্গা নেতার কন্যার ‘কান ফোঁড়ানো’ রাজকীয় উৎসব

সেই নুর মোহাম্মদ রোববার ভোররাতে টেকনাফের জাদীমুরা এলাকায় ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মারা গেছেন। যুবলীগ নেতা ফারুক হত্যা মামলার প্রধান আসামী হিসেবে আটকের পর অস্ত্র উদ্ধারে গেলে তার সাঙ্গপাঙ্গদের সাথে গোলাগুলির ঘটনায় নুর মোহাম্মদ মারা গেছেন বলে দাবি করেছেন টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ। এসময় ৪টি এলজি, ১টি থ্রি কোয়াটার, ১৮ রাউন্ড গুলি, ২০ রাউন্ড খালি খোসাও পাওয়া গেছে বলে দাবি করেছেন ওসি।

বন্দুকযুদ্ধে টেকনাফ থানার ওসি (তদন্ত) এবিএমএস দোহা, কনস্টেবল আর্শেদূল ও কনস্টেবল অন্তর চৌধুরী আহত হন বলেও জানিয়েছেন ওসি প্রদীপ কুমার দাশ।

এতেই নুর মোহাম্মদের অধ্যায় শেষ হতে পারত। কিন্তু মরে গিয়েও একটি চমকপ্রদ আলোচনার পথ ঝিয়ে রেখে গেছেন রোহিঙ্গা ডাকাত সর্দার নুর মোহাম্মদ। তার মৃত্যুর পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া ‘বাংলাদেশী স্মার্টকার্ড’ এ আলোচনাকে সরব করেছে। চট্টগ্রামের ষোলশহর এলাকার বাসিন্দা হিসেবে নুর আলম নামে বাংলাদেশের ভোটার হয়েছেন এবং যথারীতি স্মার্টকার্ডও সংগ্রহ করেছেন আলোচিত ডাকাত নুর মোহাম্মদ।

স্মার্টকার্ডে উল্লেখ রয়েছে, নুর মোহাম্মদের বাংলাদেশী স্মার্টকার্ডটি ২০১৭ সালের ২৩ জানুয়ারী চট্টগ্রামের সিটি কর্পোরেশনের ঠিকানায় ইস্যু করা হয়। কার্ডে তার নাম নুর আলম। পিতা, কালা মিয়া এবং মাতা সরু বেগম। জন্ম তারিখ ২৫ নভেম্বর ১৯৮৩ ইংরেজী এবং জন্মস্থান চট্টগ্রাম। এনআইডি নম্বর-৬০০৪৫৮৯৯৬৩। আর স্থায়ী ঠিকানায় লেখা আছে, বাসা/হোল্ডিং- মাস্টারের মার বাড়ী, গ্রাম/রাস্তা-বার্মা কলোনী, হিলভিউ রোড, পশ্চিম ষোলশহর (পার্ট-২), ডাকঘর- আমিন জুট মিলস-৪২১১, পাচঁলাইশ, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন।

তবে, টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান রাশেদ মাহমুদ আলী জানান, ১৯৯২ সালে মিয়ানমারের আকিয়াব এলাকা থেকে এপারে ঢুকে রোহিঙ্গা নূর মোহাম্মদ হ্নীলা ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ডের জাদিমুরা এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে বাসকরা শুরু করেন। পরে জমি কিনে বাড়ির মালিক হন। গড়ে তুলে অপরাধী বাহিনী। আর ক্যাম্পে আধিপত্য বিস্তারে টেকনাফের প্রতিটি ক্যাম্পে বিয়ে ও ঘর করেন নুর মোহাম্মদ। তাই প্রতিটি ক্যাম্পের নিয়ন্ত্রণ ও অপরাধকর্ম তার ইশারায় হতো বলে জনশ্রুতি রয়েছে। প্রচার রয়েছে নূর মোহাম্মদের মালিকানায় একটি দু’তলা, একটি পাকা ভবন, একটি টিনের ঘর এবং অপরটি বাগান বাড়িসহ ৪টি বসতঘর রয়েছে। রয়েছে একাধিক স্ত্রীও।

রোহিঙ্গা ঢলের শুরু থেকেই কক্সবাজারে জন্মনিবন্ধন কার্যক্রমই বন্ধ রয়েছে। শরণার্থী হিসেবে বায়োমেট্রিক নিবন্ধনের আগে রোহিঙ্গারা যাতে এদেশের জাতীয় পরিচয়পত্র না পায় এজন্যই মূলত এই সিদ্ধান্ত নেয়া। এ কার্যক্রম চালু থাকায় কক্সবাজার জেলার বাসিন্দারা জন্মনিবন্ধনসহ নানা সেবা থেকে বঞ্চিত রয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে মানবিকতার খাতিরে আশ্রয় পাওয়া সাধারণ রোহিঙ্গা ও নূর মোহাম্মদের মতো চিহ্নিত অপরাধীরা কিভাবে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভূক্ত হলো এবং স্মার্টকার্ড পেলো। নূর মোহাম্মদ হয়তো তার সাঙ্গ পাঙ্গদেরও স্মার্টকার্ডের আওতায় এনেছেন।

কক্সবাজার সিভিল সোসাইটির সভাপতি আবু মোরশেদ চৌধুরী খোকা বলেন, এভাবে যদি রোহিঙ্গারা জাতীয় পরিচয়পত্র, স্মার্টকার্ড বা পাসপোর্ট পেতে থাকে তাহলে তাদেরকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো সম্ভব হবে না। দীর্ঘমেয়াদে এর খেসারত বাংলাদেশকেই দিতে হবে। রোহিঙ্গা ডাকাত নূর মোহাম্মদরা আশ্রিত রোহিঙ্গাদের খাবার দিয়ে সহযোগিতা করা হ্নীলার যুবলীগ নেতা ওমর ফারুককে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। সরকারদলীয় নেতারাও যেখানে রোহিঙ্গাদের নির্মমতা থেকে রেহাই পাচ্ছে না, সেখানে স্থানীয় সাধারণ মানুষতো আরো অসহায়। তাই রোহিঙ্গাদের ভোটার হতে এবং স্মার্টকার্ড পেতে সহযোগিতাকারিদের সনাক্ত করে কঠোর শাস্তির মুখোমুখী করা দরকার।

কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মো. ইকবাল হোসাইন বলেন, এভাবে দূর্ধর্ষ রোহিঙ্গা অপরাধীদের বাংলাদেশী স্মার্টকার্ড পাওয়া চরম দু:খজনক। লোভের বসে কিছু অসাধু ব্যক্তি রোহিঙ্গাদের ভোটার হতে এবং পাসপোর্ট পেতে সহযোগিতা করে। এটা যে নিজেদের পায়ে কোঁড়াল মারার চেয়ে ক্ষতি তা বুঝে না লোভী মানুষগুলো। সহযোগিতাকারিদের মাঝে যারা ধরা পড়ে তারা শাস্তির মুখোমুখী হন। কিন্তু এভাবেতো চলতে পারে না। নিজ নিজ অবস্থান থেকে আমাদের আরো সচেতন হওয়া দরকার। পাশাপাশি দরকার এই অপরাধ নির্মূলে কঠোর পদক্ষেপ। আমরা সেই পথে হাটছি।

উল্লেখ্য, শনিবার (৩১ আগস্ট) দুপুরে টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের উলুচামরী পাহাড়ী এলাকা থেকে কুখ্যাত রোহিঙ্গা ডাকাত সর্দার নুর মোহাম্মদকে আমান উল্লাহ নামে অপর একজন সহযোগীসহ আটক হন। তাকে আটকের বিষয়টি শৃংখলা বাহিনী গোপন রেখে তার ভান্ডারে থাকা অস্ত্র উদ্ধারে অভিযানে যায় একইদিন রাতে। সেখানেই বন্দুকযুদ্ধে মারা যান নুর মোহাম্মদ।

গত ২২ আগস্ট রাতে যুবলীগ নেতা ওমর ফারুককে (৩০) গুলি করে হত্যা করা হয়। একদল রোহিঙ্গা ফরুককে বাসার সামনে থেকে তুলে নিয়ে পাশের একটি পাহাড়ে তুলে গুলি করে হত্যা করে। এ ঘটনায় বিক্ষুব্ধ জনতা টায়ার এবং প্লাস্টিকের বক্স জ্বালিয়ে টেকনাফ পৌরসভা থেকে লেদা পয়েন্ট পর্যন্ত পাঁচ কিলোমিটার সড়ক তিন ঘণ্টা অবরোধ করে। রোহিঙ্গা ডাকাত নূর মোহাম্মদের বাড়িও জ্বালিয়ে দেয়া হয়।

২৩ আগস্ট দিনগত রাতে জাদিমুরা পাহাড়ের পাদদেশে ওমর ফারুক হত্যাকান্ডে জড়িত জাদিমুরা রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা মো. শাহ ও আবদুর শুক্কুর ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন। ২৬ আগস্ট একই ভাবে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন আরেক অভিযুক্ত মো. হাসান। আর সর্বশেষ ১ সেপ্টেম্বর রোববার ভোররাতে মারা গেছেন প্রধান অভিযুক্ত ডাকাত সর্দার নুর মোহাম্মদ।

বাংলাধারা/এপএস/এমআর

আরও পড়ুন