সায়ীদ আলমগীর, কক্সবাজার »
দখলদারদের থাবায় অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে পর্যটন নগরী কক্সবাজারের প্রাণ হিসেবে পরিচিত বাঁকখালী নদী। এর সাথে বিপন্ন করা হয়েছে নদীর তীরবর্তী প্যারাবন। ইচ্ছেমতো তীর দখল ছাড়াও পার্শ্ববর্তী প্রায় ৬০০ হেক্টরের বন নিধন করে চলছে ভরাট ও প্লট তৈরির কাজ। নির্মাণ করা হচ্ছে একের পর এক স্থাপনা। প্রশাসন, বন বিভাগ, পরিবেশ অধিদফতর ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নখদর্পনে দখলের এ মহোৎসব বিস্ময়ের জন্ম দিয়েছে।
এসব বিষয়ে প্রশাসনের কর্মকাণ্ড নিয়ে নানা সমালোচনার পর উচ্চ আদালতের নির্দেশনার আলোকে মঙ্গলবার সকাল হতে অবৈধ দখল উচ্ছেদে অভিযান চালিয়েছে জেলা প্রশাসনের নেতৃত্বে টাস্ক ফোর্স। বিকেল পর্যন্ত শতাধিক আধাপাকা স্থাপনা, সীমানা দেয়া গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে বলো জানিয়েছেন কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম)।
প্রত্যক্ষদর্শীদের অভিযোগ, নদী দখল ও বন ধ্বংসে জড়িতদের তালিকায় এলাকার প্রভাবশালী ব্যক্তি, ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক নেতা এমনকি জনপ্রতিনিধিও রয়েছেন। স্থানীয় প্রশাসন, সংশ্লিষ্ট দফতর ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ম্যানেজ করেই দিনে-দুপুরে এসব দখল, বন ধ্বংস এবং স্থাপনা নির্মাণ চলেছে। প্রশাসনের সায় না থাকলে প্রকাশ্য দিবালোকে এ দখলযজ্ঞের সাহস পেত না কেউ।
পরিবেশবাদি সংগঠন নেতৃবৃন্দের মতে, খুরুশকুলের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের জন্য কস্তুরাঘাট পয়েন্টে বাঁকখালী নদীর ওপর নির্মাণ করা হচ্ছে ৫৯৫ মিটার দৈর্ঘের একটি সেতু। এ সেতুটি সম্পন্ন হলে খুরুশকুল ও বৃহত্তর ঈদগাঁও অঞ্চলের সঙ্গে শহরের বিকল্প সড়ক যোগাযোগ তৈরির পাশাপাশি কমে আসবে দুরত্ব। কিন্তু সেতুটিই যেন বাঁকখালী নদী ও তীরবর্তী প্যারাবনের জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেতুর জন্য সংযোগ সড়ক তৈরি হওয়ার আগেই সড়কের দুই পাশে প্যারাবন ধ্বংস করে নদী দখলের প্রতিযোগিতা চলেছে। নদী তীরের প্যারাবনের গাছপালা নিধন করে সেখানে বালু ফেলে নদী ভরাট করা হচ্ছে। ভরাট জমিতে প্লট বানিয়ে বিক্রিও শুরু হয়েছে। এভাবে সংযোগ সড়কের পাশে প্রায় ৬শ হেক্টর এলাকার প্যারাবন উজাড় করে তৈরি হয়েছে শতাধিক ঘরবাড়িসহ নানা স্থাপনা। প্রভাবশালীদের এ দখলযজ্ঞের পেছনে প্রশাসনের ভূমিকাও রহস্যজনক।
গত ডিসেম্বর মাসে পরিবেশ অধিদফতর দখলদারদের বিরুদ্ধে দুটি মামলা করেছে। এ ঘটনায় কেউ গ্রেফতার না হওয়ায়, মামলার পরও দখল কার্যক্রম থেমে নেই।
পরিবেশ অধিদফতর, জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন ও বিআইডব্লিউটিএর পৃথক প্রতিবেদনে বাঁকখালী নদী দখলের সাথে জড়িত ১৩১ জনকে চিহ্নিত হয়েছে। এর মধ্যে নবনির্মিত সেতু ঘিরে ধ্বংসাত্মক কার্যক্রমে জড়িত আছেন অর্ধশতাধিক ব্যক্তি। এদের ২৩ জনের বিরুদ্ধে আবার পরিবেশ ধ্বংসের অভিযোগে বহু আগে থেকেই একাধিক মামলা রয়েছে।
এদিকে, গত ২৪ জানুয়ারি বাঁকখালী নদী ও প্যারাবনের অবস্থা পরিদর্শনে যান বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। নদী দখল আর বন ধ্বংসের চিত্র দেখে বিস্ময় প্রকাশ করে তিনি সাংবাদিকদের জানান, দিনে-দুপুরে নদী দখল ও বন ধ্বংস অত্যন্ত বিস্ময়কর। এ দেশে নদী ও বন রক্ষার যে আইনগুলো আছে, প্রতিষ্ঠানগুলো আছে, উচ্চ আদালতের যে রায়গুলো আছে, সেগুলো যেন একেবারেই অর্থহীন। আদালতের রায়ে বলা হয়েছে, নদী হলো জীবন্ত সত্তা। মানুষকে হত্যা করলে যেমন শাস্তি হয়, সে রকম নদীকে হত্যা করলেও শাস্তি হবে। ব্রিজ থাকে নদীর ওপরে, এখানে ব্রিজ যেন বাড়িঘরের ওপরে হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, এখানে নদী রক্ষায় সৃজিত বিশাল প্যারাবন নিধন করা হয়েছে। প্রকাশ্যে নদী দখল, বন ধ্বংস করা হচ্ছে, অথচ এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ও দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা, পুলিশ, প্রশাসন সর্বোপরি সরকার যেন, মনে করছে যে আদালত যে নির্দেশ দিয়েছে, যে রায় দিয়েছে, সেই রায় মানতে হবে না! বিষয়টি আবারও আদালতে উপস্থাপন করার ঘোষণা দিয়েছিলেন বেলা প্রধান।
বেলার প্রধানের এ ঘোষণার পরই বাঁকখালী নদী তীর পরিদর্শনে যান কক্সবাজার সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ জাকারিয়া, সহকারি কমিশনার (ভূমি) মো. জিল্লুর রহমান, পরিবেশ অধিদফতর, বন বিভাগ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।
ইতোমধ্যে নদীর তীর দখল উচ্ছেদ নিশ্চিত করতে উচ্চ আদালত আবারও নির্দেশনা দিয়েছে। সেই নির্দেশনার আলোকে সোমবার মাইকিং করা হয়। মালামাল স্ব স্ব উদ্যোগে সরিয়ে নিতে অনুরোধ করা হয় সেই মাইকিংয়ে। ঘোষণা মতো, মঙ্গলবার (২৮ ফেব্রুয়ারি) সকাল হতে বাঁকখালী তীরের কস্তুোরাঘাট এলাকা দখলমুক্ত করতে অভিযান চালিয়েছে টাস্কফোর্স। কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) মো. আবু সুফিয়ান ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) জাহিদ ইকবালের নেতৃত্বে চলা এ অভিযানে র্যাব, পুলিশ, পরিবেশ অধিদফতর, দমকল বাহিনীসহ সংশ্লিষ্টরা অংশ নেয়। দুপুর পর্যন্ত চলা অভিযানে নির্মিতব্য বেশ কয়েকটি আধাপাকা স্থাপণা গুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। ভেঙে ফেলা হয়েছে বেশ কয়েকটি প্লটের সীমানা দেয়ালও।
নদী দখল ও প্যারাবন ধ্বংসের বিষয়ে এডিএম আবু সুফিয়ান বলেন, নদীর জীবন্ত সত্তাকে হত্যার পর বন নিধন চরম অমানবিকতা। মহামান্য হাইকোর্টের নির্দেশনা বাস্তবায়নে এসব অবৈধ দখল যেকোন ভাবে উচ্ছেদ করা হবে। এডিএম’র নেতৃত্বে ৬জন নির্বাহি ম্যাজিস্ট্রেট উচ্ছেদে দায়িত্বপালন করছেন। সাথে নদী রক্ষা কমিশন, বনবিভাগ, বিআইডব্লিউটিএ, পরিবেশ অধিদফতর, বিদ্যুৎ বিভাগ, দমকল বাহিনীসহ শৃংখলা বাহিনীর প্রতিটি শাখা স্ব স্ব ভাবে অভিযানে অংশ নিয়েছে। প্রথম দিন সকাল হতে শতাধিক স্থাপণা গুড়িয়ে দেয়া সম্ভব হয়েছে। বাকি স্থাপনাও ক্রমে সরিয়ে ফেলা হবে।
বাঁকখালী দখলে যাদের নাম—
পরিবেশ অধিদপ্তর, জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন ও বিআইডব্লিউটিএ’র পৃথক প্রতিবেদনে বাঁকখালী নদী দখলে জড়িত ১৩১ জনকে চিহ্নিত করা হয়েছে। যার মধ্যে নতুন নির্মিত সেতুকে ঘিরে দখলে জড়িত রয়েছেন আরও ৫০ জনের মতো, যাদের মধ্যে ২৩ জনের বিরুদ্ধে পরিবেশ অধিদপ্তর মামলাও করেছে।
এই প্রতিবেদনে যাদের নাম উঠে এসেছে তারা হলেন- শহরের বদরমোকাম এলাকার জসিম উদ্দিন, হোটেল তাজসেবার খাইরুল ইসলাম জিসান, নতুন বাহারছড়ার গিয়াস উদ্দিন, মাসেদুল হক রাশেদ, ঝাউতলার মোহাম্মদ আলী মুন্না, নতুন বাহারছড়ার জনি, মেয়র মুজিবুর রহমান, বদর মোকাম এলাকার কফিল উদ্দিন এ্যানি, রুমালিয়ারছড়ার মো. ইসমাইল, ঝাউতলা এলাকার আনিস মোহাম্মদ টিপু, শাহীনুল হক, নেত্রকোনা থেকে আসা ওমর ফারুক, রামুর হেলালুর রশিদ, টেকনাফের মোহাম্মদ ইউনুচ বাঙ্গালী, শফিক মিয়া, ঝিলংজার নুরুল আলম, বাহারছড়ার শহীদুল হক, কাইসার, মেহেদী, নুরপাড়ার তায়েফ আহমদ, তাইছাদ সাব্বির, সিটি কলেজ এলাকার আবদুল মালেক ইমন, পাহাড়তলীর আরিফুল ইসলাম, খুরুশকুলের নুরুল আমিন, মহেশখালীর কুতুবজোমের মেহেরিয়াপাড়ার রোকন উদ্দিন, মহেশখালী পৌরসভার চরপাড়ার মো. ইউসুফ, সাতকানিয়া কাঞ্চনার শরিফুল আলম চৌধুরী, মহেশখালী পুটিবিলা এলাকার জাহেদুল ইসলাম শিবলু, বদরমোকাম এলাকার মো. কামাল ওরেফে কামাল মাঝি, সাতকানিয়া পশ্চিম ডলুর জসিম উদ্দিন, বাঁশখালী চনুয়ার জিয়া মো. কলিম উল্লাহ, লোহাগাড়া চৌধুরীপাড়াস্থ উত্তর হরিয়া এলাকার খোরশেদ আলম চৌধুরী, মনোহরগনজয়ের দক্ষিন সরসপুর বাতাবাড়িয়া এলাকার ফিরোজ আহমদ, বদর মোকাম এলাকার মিজানুর রহমান, চট্টগ্রামের চাদগাঁও এলাকার মাহমুদুল করিম, কক্সবাজারের লালদিঘীপাড় এলাকার আশিক, কক্সবাজার সদর উপজেলার হাজীপাড়ার আমীর আলী, রামু চাকমারকুলের মোস্তফা কামাল, বৈল্যাপাড়ার আমিন, রুমালিয়ারছড়াস্থ এবিসি ঘোনা এলাকার মো. ইসলাম ওরফে খোল বাহাদুর, বদরমোকাম এলাকার মো. ইব্রাহীম, পানবাজার সড়কের মারুফ আদনান, কস্তুরাঘাটের ইশতিয়াক আহমেদ, ইকরা রিয়েল এস্টেট হাউজিং এর মালিক আমিনুল ইসলাম আমান, খুরুশকুল মনুপাড়ার মোহাম্মদ সেলিম প্রকাশ বার্মাইয়া সেলিম, কক্সবাজার শহরের হোটেল তাজসেবার মাহবুবুর রহমান, মধ্যম বাহারছড়ার মো. রানা, লালদীঘির পাড় এলাকার ঝুমা ও মহেশখালীর শাপলাপুরের দীনেশপুর এলাকার ইকবাল হাসান।
এদের বিরুদ্ধে যথাযত আইনী ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানিয়েছেন সচেতন মহল। এটি দৃশ্যমান না হলে, দখল আরো প্রসারিত হবে বলে মন্তব্য তাদের।