মহসীন কাজী »
বুধবার খুব সকাল সকাল এসেছে। ঘুম থেকে উঠেই দেখি রাজ্জাক। আমাদের বাড়ির কবির চাচার ছেলে। চালাক-চতুর, অল্পতে আয়ত্ব করতে পারে সবকিছু। নিজের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থেকে অনেক এগিয়ে সে। রাজনীতিও বুঝে। মা ও আমার ভাই বোনদের কাছে তার যত আবদার। মন চাইলে চলে আসে আমাদের কাছে। বাড়ি থেকে এসে মধ্যরাত পর্যন্ত মনপ্রাণ উজাড় করে ছাড়ে বাড়ির খবরাখবর। স্থানীয় রাজনীতি থেকে চেয়ারম্যান, মেম্বার আত্মীয়-স্বজন কেউ বাদ যায় না। আমার দু’সন্তান দোয়া, মুনাজাত থেকে শুরু করে ঘরের সবার প্রিয় আবদুল রাজ্জাক।
এবার এসে বাড়ির লোকজনের কুশলাদি জানানোর পর দেখলাম বিষন্ন তার মন। বলল, আমাদের এলাকার (চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার হারুয়ালছড়ি গ্রাম) অবস্থা খারাপ। করোনা সংক্রমণ বাড়তে থাকলে আরও খারাপ হবে। প্রশাসন, পুলিশ ও সেনাবাহিনীর (আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের) অনুরোধ, রেডিও-টিভির প্রচার কিছুই মানুষকে মাস্ক পড়াতে পারেনি। কারও কারও মাস্ক থাকলেও তা মুখে নয়, গুঁজে রাখে পকেটে। সুযোগ মতো গায়ে গা ঘেঁষে আড্ডা করছে। কেউ কাউকে ডাক দেয়ার নেই। এমনও নাকি অনেকে বলে, করোনা ভাইরাস তাদের এলাকায় (গ্রামে) যাবে না। অথচ ফটিকছড়ির বিভিন্ন গ্রামে সংক্রমিত এখন অনেকেই। এই খবরও আছে সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ রাজ্জাকের কাছে।
করোনাকালের এই চিত্র শুধু অজ পাড়া-গাঁয়ের না। শহর এবং শহরতলীতেও এমন মানুষের সংখ্যা অনেক অনেক।
এইতো সেদিন আমার এক বন্ধু যাচ্ছিলেন বাজার করতে। রিক্সাঅলা মাস্ক ছাড়া প্যাডেল মারছিল। বন্ধুটি রিক্সাঅলাকে মমতার সূরে বললেন, মামা মাস্ক কই। প্রশ্ন কানে যেতে দেরি নেই, মামার ফিরতি জবাব- ‘মাস্ক আপনারা পড়েন। করোনা আমাদের কাছে আসবে না। গরমের ঠেলায় পালাইবো। করোনা পাইবো আপনাগো’।
নগরীর অলিগলি আর বাজারের কোথাও স্বাস্থ্যবিধি এবং সামাজিক দূরত্ব মানার বালাই নেই। যে যার মতোই চলছে। বিড়ি, সিগারেট সমানে ফুঁকছে। পুলিশ, সেনা আর প্রশাসনের পক্ষ থেকে শুরুতে অনেক গলা ফাটানো হয়েছে। উত্তম মধ্যমও দিয়েছে। কে শোনে কার কথা- এই অবস্থাই ছিল। এই শহরের মানুষ এমন- প্রথম প্রথম রাস্তায় সিটি করপোরেশনের জীবাণুনাশক পানি ছিটানোর দৃশ্য দেখতে মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়তো।
আজ (বৃহস্পতিবার) স্বাস্থ্য অধিদপ্তর করোনাকালীন সতর্কতাসহ মাস্ক পড়ার আহবান জানিয়ে বিভিন্ন সংবাদপত্রে বড় বড় বিজ্ঞাপন দিয়েছে। বলা হয়েছে- মাস্ক ছাড়া বাইরে গেলে জরিমানা করা হবে। অবশ্য মাস্ক না পড়ার কারণে ইতোমধ্যে জরিমানায় দণ্ডিত করার ঘটনাও ঘটেছে। গণমাধ্যমে সে খবর ফলাও করে প্রচার হয়েছে।
এত কিছুর পরও সংক্রমণ শুরুর তিনমাস পেরিয়ে গেলেও সচেতনতা আসেনি। এক শ্রেণির মানুষ সুরক্ষিত থাকার সব বিধি-বিধান মানছে। আরেক শ্রেণির যেন কানে তুলো। চলছে তো চলছেই। কিছুই তারা মানছে না।
প্রতিদিন দুপুর আড়াইটায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়মিত লাইভ বুলেটিনে করোনার ২৪ ঘন্টার চিত্র তুলে ধরার পর সর্বশেষ একটি সতর্ক বার্তা বলা হয়। তা হচ্ছে ‘মনে রাখবেন-আপনার সুরক্ষা আপনার হাতে’। করোনাকালে এটাই হচ্ছে মূলকথা। স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিয়ে সারা বিশ্বের মিডিয়া সরব। সমানে চলছে প্রচারণা। তবুও আমরা যেন বেমালুম। ফলে সামাজিক সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ছে। জ্যামিতিক হারে বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা। দীর্ঘ হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল।
এ তো গেল সুরক্ষা, স্বাস্থ্যবিধি, সামাজিক দূরত্ব নিয়ে প্রচারণার কথা। তার বিপরীতে স্বাস্থ্য সেবার চলমান দুর্দশা দেখে, শুনে সমূহ বিপদ থেকে রক্ষা পেতে নিজেকে নিজে যেভাবে সুরক্ষা দেয়ার কথা তাও করছে না কেউ কেউ। ভেন্টিলেটর, অক্সিজেন, ওষুধ, আইসিইউ সংকট সর্বোপরি হাসপাতালে চিকিৎসাহীনতার বিষয়টি মাথায় রেখে হলেও নিজেকে সুরক্ষিত রাখা জরুরি। চিকিৎসা না পেয়ে মৃত্যুর নজির সৃষ্টি হচ্ছে প্রতিদিনই। কি করুণ ঘটনাই না ঘটছে প্রতিদিন। পথে ঘাটে চলছে আহাজারি।
করোনার এই দুঃসময় আমাদের চারদিকে নতুন নতুন অমানবিক ঘটনার সূত্রপাত হচ্ছে। কোভিড পজেটিভ অনেককে দূরে ঠেলে দিচ্ছে আপনজন। ছেলে গ্রহণ করছে না বাবার লাশ। স্ত্রীর লাশ ফেলে পালাচ্ছে স্বামী। আক্রান্ত স্বামীর দিকে মুখ ফিরে তাকাচ্ছে না স্ত্রী। সৎকারেও কাছে থাকছে না কেউ। আপনজন তার আপনের আর্তিতে সাড়া দিচ্ছে না। আপনজন মুহূর্তেই পর হয়ে যাচ্ছে।
এসব অমানবিকতা থেকে বাঁচতে হলেও নিজেকে নিরাপদ রাখতে প্রয়োজন সুরক্ষিত থাকা। সুরক্ষিত থাকলে দূরে যাবে সংক্রমণ। বাঁচবে সবার পরিবারপরিজন, সমাজ তথা দেশ। একমাত্র সুরক্ষিত থাকাই হবে করোনা জয়ের মূলমন্ত্র।
আসুন সবাই মিলে মেনে চলি স্বাস্থ্যবিধি। অভ্যেস গড়ি সামাজিক দূরত্বের। তাহলেই আমরা জয়ী হবো করোনা যুদ্ধে।
মনে রাখা উচিত, আমরা যুদ্ধজয়ী জাতি। নয়মাস যুদ্ধ করে আমরা দেশ পেয়েছি। এবার সচেতন থেকে আমরা জয় করবো মহামারি।
লেখক : যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে)













