মাকসুদ আহম্মদ, বিশেষ প্রতিবেদক»
‘মেতে উঠি উৎসবে বৈশাখে আনন্দে’ এমন স্লোগানকে ঘিরে তিন বছর ধরে কোন আয়োজন নেই। চট্টগ্রামে এবার পহেলা বৈশাখকে ঘিরে নেই কোন মেলা আর নেই কোন বনেদী ব্যবসায়ী আব্দুল জব্বারের বলী খেলা। চট্টগ্রামে বাংলা সংস্কৃতির ১১৩ বছরের ধারা চলমান রয়েছে। কিন্তু ২০১৩ সালে নারী বিদ্বেষী হেফাজতে ইসলাম বাংলা নববর্ষ তথা পহেলা বৈশাখ উদযাপন অনুষ্ঠানে হামলা চালাতে পারে এমন আশঙ্কার পর থেকে অনেকটা আতঙ্কেই বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন ও আগতরা। আজ পহেলা বৈশাখ, বাংলা বছরের প্রথম দিন। এ দিন উদযাপন উপলক্ষে চট্টগ্রামের সর্ব বৃহৎ দুটি স্পটে মঙ্গলবার থেকেই মঞ্চ তৈরির কাজ শুরু হয়েছে ছোট্ট পরিসরে। রমজানের কারনে দুপুর ১টা পর্যন্ত বৈশাখ বরণের সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে। বুধবার বর্ষ বিদায়ের পরেই শুরু হয়েছে সুপ্রভাত বাংলা নববর্ষ ১৪২৯ কে বরণে সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর নানা আয়োজন।

বৃহস্পতিবার ভোরে প্রত্যক্ষভাবে দেখা গেছে, পাহাড়তলীস্থ শেখ রাসেল স্মৃতি শিশু পার্কের ফটকে তালা ঝোলানো রয়েছে। এ আঙ্গিনাটিতে বৈশাখ বরণে কোন পদক্ষেপ নেই। সিআরবি শিরীষতলার নিরাপত্তায় দেখা গেছে, প্রবেশ মুখে রেলওয়ে অফিসার্স বাংলোর নীচে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সার্চগেট আর পুলিশ সদস্যরা সন্দেহভাজনদের দেহ তল্লাশী করে দেখছেন কোন অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটার আগেই নিরাপত্তা নিশ্চিত করছেন। একটু এগিয়ে শতবর্ষী শিরীষতলায় মুষ্টিমেয় আগতদের নিয়ে অনুষ্ঠানের শুভসূচনার ঘোষণা দেওয়া হচ্ছে। নিরাপত্তার নামে দু’ চাকা থেকে চার চাকা গাড়ী চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে পলোগ্রাউন্ডের উপরিভাগে, কদমতলী মোড়ে, সিজেকেএস এর পশ্চিম কোনে বসানো হয়েছে নিরাপত্তার স্বার্থে পুলিশ সদস্যদের। তবে সিআরবি শিরীষ তলার কাছেই র্যাব সেভেনের সদস্যরা সেইফটি পোজ দিতে দেখা গেছে।

চট্টগ্রামের আদি বাসিন্দাদের নববর্ষ বরণের স্পট ডিসি হিলকে ঘিরে নিরাপত্তা বেস্টনি একটু ঢিলেঢালা। ডিসি হিলের গেটে মেটাল ডিটেক্টর সার্চওয়ে লাগানো থাকলেও তা তত্ববধান করছে ভলেন্টিয়ার সদস্য মাত্র তিনজন। পুলিশ থাকলেও তা অনতি দূরে। মূল পয়েন্টে পুলিশ না থাকায় তা কিছুটা বিতর্ক ও নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে আগতরা। এ আঙ্গিনায় অনেকটা জমজমাট আয়োজন চলছে। মুসলামানরা রোজা রাখার কারনে অনেকটা গা ছাড়া ভাব কিন্তু অন্য ধর্মের মানুষের কাটতি নেই। এ আঙ্গিনাকে নিরাপত্তারে চাদরে ঢাকতে র্যাব পুলিশের অবস্থান সমানে সমান। নিশ্চিদ্র নিরাপত্তা দিতে মূল সড়কগুলোতে মোটর চালিত যানবাহন বন্ধ করে দেয়া হয়েছে তবে পায়ে হাটা মানুষের প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। যান চলা চরে বন্ধ করা হয়েছে ডিসি হিলমুখী নেভী আবাসিক এলাকার সম্মুখস্থ ত্রীচত্ত¦রের সামনে। বসানো হয়েছে সার্চওয়ে আর ব্যারিকেড দেওয়া হয়েছে চেকপোস্ট দিয়ে। চেরাগী পাহাড়ের মোড়, নন্দনকানন কাটাপাহাড় লেন এলাকায়ও বসানো হয়েছে নিরাপত্তা চৌকি। সর্বশেষ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর স্বল্প সদস্য দিয়ে ২০১৯ সালে নগরীর তিনটি স্পটসহ নগরব্যাপী নিরাপত্তা বিধান করা হয়েছিল। যদিও র্যাব ও পুলিশের যৌথ সমন্বয়ে প্রতিবারের মত করোনাকালীন ২০২০ ও ২০২১ সাল ব্যতিত এবারও নববর্ষকে ঘিরে নগরব্যাপী নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে বিগত বছরগুলোতে।

জানা গেছে, বাংলা ১৪২৯ কে বরণ করতে নগরীর ডিসি হিলে রমজান না থাকলে প্রায় ৩০টি সাংস্কৃতিক সংগঠন দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালার সূচিকরণ করতো। নারী পুরুষ উভয়ের প্রতিভার বিকাশ ঘটানো হয়েছে বিগত বছরগুলোতে ডিসি হিলের পাদদেশে গড়ে তোলা বাঙালিয়ানা মঞ্চে। নববর্ষের প্রথম প্রহর শুরু হবার কথা পান্ত ইলিশ দিয়ে। এবার আর তা হয়নি রমজানের কারনে। অন্য সময়ে ভোর ৫টা থেকে শুরু করে রাত ৮টা পর্যন্ত প্রায় পনের ঘন্টার অনুষ্ঠানমালায় একের পর এক ৩০টি সাংস্কৃতিক সংগঠন তাদের পারফরমেন্স তুলে ধরার জন্য সর্বপ্রকার প্রস্তুতি শেষ করলেও এবার তা অতটা বিশালতায় নয়। স্থগিত করা হয়েছে বৈশাখী মেলা আর ২৫ এপ্রিলের জব্বারের বলী খেলা।
রমজানের কারনে এবার বিভিন্ন স্পটে ছোট্ট আঙ্গিকে মঞ্চ তৈরির কাজও শুরু হয়েছে মঙ্গলবার সকাল থেকে। যদিও ডিসি হিল নামে খ্যাত এক সময়ের এ আঙ্গিনা অবশেষে নজরুল স্কয়ারে নামকরণ হয়েছে গত কয়েক বছর আগে। তারপরও ডিসি হিল নামেই একনামে পরিচিত পাহাড়ের পাদদেশে বাঙালিদের নগরব্যাপী মিলনমেলার এই স্থানটুকু। নাচ, গান, আবৃত্তির মধ্য দিয়ে প্রায় ৫ ঘন্টার কার্যক্রম এবার চলবে মাত্র হাতে গোনা সময়ের জন্য। তথা দুপুর ২টার মধ্যে শেষ করে দিতে হবে প্রশাসনের নির্দেশনার কারনে।

এদিকে, সিআরবির শিরিষতলায়ও ছোট্ট একটা মঞ্চ নির্মাণ করা হয়েছে মঙ্গলবার। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে পালাক্রমে অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি শুরু হয়েছে সাংস্কৃতিক জোটগুলোর মাঝে। ডিসি হিলের তুলনায় অপেক্ষাকৃত ছোট মঞ্চ হলেও পরিসর অনেক বড়। কারণ তিনটি পাহাড়ের পাদদেশে প্রায় তিনশ’ বছর বয়সী শিরিষ গাছের গোড়ায় এ মঞ্চ যেন পুরো দেশকে তাক লাগিয়ে দেয়। প্রাকৃতিক আঙ্গিকে ঘেরা এ ¯পটে দর্শনার্থী ও আগতদের সমাগম হয় অনেক বেশি। কিন্তু নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে হয় এ স্পটে আগতদের চরমভাবে। কারণ ডিসি হিল একটি প্রাচীরে ঘেরা ও নিরবিচ্ছিন্ন নিরাপত্তা বেস্টনীতে আবদ্ধ থাকে সংস্কৃতিমনারা। কিন্তু শিরিষ তলায় আগতরা কোন আচ্ছাদনে ঘেরা না থাকার কারণে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে হয়। যদিও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কড়া নজরদারি ও সাদা পোশাকদারী পদচারণায় কড়া নজরদারি থাকে এ স্পটে। তবুও যেন নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টি আগতদের মাঝে কাজ করে অনেক বেশি।

অপরদিকে, রমজান না থাকলে চট্টগ্রামের পতেঙ্গাস্থ সমুদ্র সৈকত থাকতো পর্যটকদের ভিড়ে ঠাসা। কর্ণফুলীর মোহনায় গত তিন বছর ধরে তথা করোনাকালীন দুবছরের বাদে স্থানীয় এমপি এম এ লতিফ সাংসদের তত্বাবধানে আরেকটি বৈশাখ উদযাপন স্পট । নদীর ওপরই মঞ্চ তৈরি করে দর্শনার্থীদের আকর্ষণের চেষ্টা চালানো হয় এ স্পট থেকে। ব্যতিক্রমী এ স্পট বৈশাখ বরণের জন্য অন্যতম একটি স্থান। কারণ কর্ণফুলীর পাড় ঘেঁষে গড়ে তোলা ভিআইপি সড়কে প্রতিদিনই হাজার খানেক বিনোদনপ্রেমীর সমাগম হয়। বৈশাখকে ঘিরে এ স্পটটি তৈরি হওয়ায় আনন্দের মাত্রা আরেকটু বেড়ে গেছে।
এদিকে, চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমান বন্দরের পাশেই রয়েছে প্রাকৃতিক অভয়ারণ্য হিসেবে খ্যাত বাটারফ্লাই পার্ক। একের ভেতরে তিন এমন একটি ভাবধারা কাজ করে আগতদের মাঝে। কারণ পতেঙ্গা সী বিচ, বাটার ফ্লাই পার্ক ও কর্নফুলীতে বৈশাখী মঞ্চ- এ তিনটি একই সঙ্গে উপভোগ করা যেত। আবার কেউ কেউ এক ঢিলে দুই পাখি মারার মত বাটার ফ্লাই পার্ক ও কর্ণফুলীতে বৈশাখী মঞ্চের বিনোদন উপভোগ করে ঘরে ফিরেছেন বিগত বছরগুলোতে।

আইনশৃঙখলা বাহিনীর পক্ষ থেকে জানা গেছে, অন্য বছরের ন্যায় এ বছরও পুলিশ ও র্যাব সদস্যের নজরে থাকবে এ স্পটগুলো ছাড়াও নগরীর বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠা ছোটখাট বৈশাখী উৎসব। দেশের সার্বিক পরিস্থিতি অনুযায়ী নিরাপত্তার বিষয়টি আরও গভীরভাবে দেখার চেষ্টা করলেও সদস্য সঙ্কটের কারণে হচ্ছে না। তবে নগরবাসিকে আরেকটু সচেতন হয়ে অপরাধ চক্রকে ধরতে সহায়তা করার জন্য বলা হয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে।
এ ব্যাপারে সিএমপির এক উর্ধতন কর্মকর্তা বাংলাধারাকে জানিয়েছেন, অন্যান্য বছরগুলোতে এ ধরনের বর্ষবরণকে কেন্দ্র করে জঙ্গী সংগঠনের উপর কড়া নজরদারি রাখা হয়েছিল। ২০১৩ সালে হেফাজতের ঘোষনার পর জামায়াত-শিবির ও হেফাজতে ইসলামসহ তাদের সমর্থনকারী দলগুলোকেও কড়া নজরদারিতে রাখা শুরু করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। পুলিশসহ সকল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যকে সচেষ্ট থাকতে বলা হয়েছে। কারণ ২০১৩ সালের ৮ মার্চের হেফাজতের লংমার্চে নারীকে পুরুষের পাশাপাশি না দেখার যে ঘোষণা দেযা হয়েছে তা নববর্ষ পালনকে প্রভাবিত করতে পারে এমন শঙ্কায়।













