৪ নভেম্বর ২০২৫

বিচারককে ‌‘চাকরি করতে না দেয়া’র হুমকি, ফেঁসে যাচ্ছেন এমপি কমল!

কক্সবাজার প্রতিনিধি »

দ্রুত বিচার আইনে এমপির আজ্ঞাবহ এক শিক্ষককে কারাগারে যেতে হলে মামলার আদেশ দেয়া বিচারককে ‘ভাত খেতে’ ও ‘চাকরি করতে দেবেন না’ বলে হুমকি স্বরূপ দাম্ভিক বক্তব্য দিয়েছেন কক্সবাজার সদর আসনের সরকার দলীয় সংসদ সদস্য (এমপি) সাইমুম সরওয়ার কমল। গত শনিবার কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি রামু উপজেলা শাখা আয়োজিত শিক্ষক মিলনমেলা, নবীনবরণ, বিদায় ও কৃতী সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ হুমকি দেন। যার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিও বক্তব্যে এমপি সাইমুম সরওয়ার কমল বলেন, রামুর একজন শিক্ষক। নাম জসিম উদ্দিন। তার বিরুদ্ধে দ্রুতবিচার আইনে মামলা হয়েছে। আমি জজ সাহেবের সঙ্গে কথা বলেছি। দ্রুত বিচার, ঘটনা মিথ্যা, কোনো ঘটনা নেই। জমি নিয়ে গণ্ডগোল। সেখানে কোনো মারামারি হয়নি। কোনো ভিডিও ফুটেজ নেই। কোনো সাক্ষী নেই। কিন্তু একজন পেশকার একজন জজকে ম্যানেজ করে একটা দ্রুতবিচার আইনে মামলা দিয়েছে।

বক্তব্যে আরও বলেন, ইনশাআল্লাহ আমি বেঁচে থাকতে তাকে (ওই শিক্ষককে) জেলে যেতে দেব না। তাকে যদি জেলে যেতে হয়, তা হলে আমি বেঁচে থাকতে যে জজ সাহেব মিথ্যা মামলা করেছে, তাকে আমি জীবনে ভাত খেতে দেব না। তাকে আমি চাকরি করতে আর দেব না। এই আমার কথা।

এরপর তিনি আরও বলেন, শিক্ষকের বিপদে শিক্ষককে আসতে হবে। একজন শিক্ষকের বিপদে সব শিক্ষককে একসঙ্গে জানাতে হবে। কোনো শিক্ষক যদি কোথাও অসম্মানিত হয়, তা হলে আমার আসনের প্রত্যেকটি স্কুল একসঙ্গে বন্ধ করে দিতে হবে।

‘শিক্ষক সমিতি, প্রতি মাসে আপনারা মিটিং করবেন। আপনাদের সম্মান রক্ষার্থে, জীবন রক্ষার্থে, সম্পদ রক্ষার্থে এই সমিতি কার্যকর ভূমিকা যাতে পালন করে।’

বিতর্কিত এ বক্তব্য বিচারককে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে আদালত অবমাননার সামিল বলে মন্তব্য করেছেন বিজ্ঞজনরা। একজন আইন প্রণেতা এমনটি বলতে পারেন না। তার এ বক্তব্যের প্রতিবাদে মানববন্ধনসহ বিক্ষোভ করেছেন কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে কর্মরত সাধারণ আইনজীবীরা।

কক্সবাজার জেলা প্রশাসক কার্যালয় কাম আদালত পাড়ায় সাধারণ আইনজীবীর ব্যানারে আয়োজিত মানববন্ধনে আইনজীবীরা দাবি করেন, কোন মামলায় গরমিল দেখলে একজন এমপি হিসেবে জেলা জজ মহোদয়কে বলে বিচার বিভাগীয় তদন্ত চাইতে পারতেন। এটাই ছিল সঠিক পথ। কিন্তু খলনায়ক ও গডফাদারের ভাষায় তিনি আদালত ও বিচারককে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিও রেকর্ড বলে দেয় সস্তা জনপ্রিয়তা নিতে এমন দৃষ্টতাপূর্ণ বক্তব্যটি দিয়েছেন। এটা সাধারণ মানুষের কাছে আদালত ও বিচারককে প্রশ্নবিদ্ধ করার শামিল। এ ঘটনায় বিচারবিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া জরুরি।

মানববন্ধনে আরো বলা হয়, শিক্ষকদের নিয়ে এত দরদ দেখানো এমপি সাইমুম সরওয়ার কমলের বিরুদ্ধে এলাকার অবসর নেয়া প্রবীণ শিক্ষককে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করার অভিযোগ আছে। লাঞ্ছনার শিকার শিক্ষক সুনীল কুমার শর্মা সংসদ সদস্য কমলকে শিশুকালে পড়িয়েছেন।

মানববন্ধন দাবি করা হয়, স্বাধীন বিচার বিভাগের বিরুদ্ধে একজন আইন প্রণেতার উদ্ব্যত্তপূর্ণ বক্তব্য বিচার বিভাগের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থার সংকট তৈরি করবে। তাই এমপি কমলকে তার বক্তব্যের জন্য নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়ে অবিলম্বে তা প্রত্যাহারের দাবি জানানো হয়েছে।

আইনজীবী মাহবুবুর রহমানের সঞ্চালনায় মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেন, সিনিয়র আইনজীবী আমির হোছাইন, নুর মুহাম্মদ মামুন, খোরশেদ আলম, নুরুল ইসলাম নুরু, মাহবুবুর রহমান, আবদুর রহিম, রিদুয়ান আলী, মুহাম্মদ শাহীন প্রমূখ।মানববন্ধনে নারী আইনজীবীসহ শতাধিক আইনজীবী অংশগ্রহণ করে।

মাস্টারের মামলায় আদালতের বিচারককে নিয়ে হুমকিমুলক বক্তব্যের বিষয়ে জানতে এমপি সাইমুম সরওয়ার কমলের মুঠোফোনে একাধিকবার কল দেয়া হয়। এমপির ব্যবহৃত দুটি মুঠোফোনের একটি নাম্বারে কল না ঢুকলেও অপর নাম্বারে রিং হয়। কিন্তু তিনি ফোন রিসিভ না করায় বক্তব্য জানা যায়নি।

উল্লেখ্য, ২০১৮ সালের ১৬ জানুয়ারি দুপুরে রামুর জোয়ারিয়ানালায় নির্মিতব্য বিকেএসপি মাঠ এলাকায় জনসম্মুখে প্রবীণ শিক্ষক সুনীল কুমার শর্মাকে লাঞ্ছিত করেন এমপি কমল।

রামুর চৌমুহনী এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা শিক্ষক সুনীল কুমার শর্মা সে সময় গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, প্রতিদিনের মতো দুপুর দেড়টার দিকে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরছিলাম। এ সময় জোয়ারিয়ানালা বাজারের দক্ষিণ পাশে বিকেএসপির নির্মিতব্য মাঠে মাটি ভরাট কাজ উদ্বোধন উপলক্ষ্যে স্থানীয় এমপি সাইমুম সরওয়ার কমলসহ অন্যদের দেখে গাড়ি থেকে নামি। সবার সঙ্গে কাজ উদ্বোধনী মোনাজাতে অংশ নেন।

মোনাজাত শেষ করে এমপি কমল তার দিকে এগিয়ে এসে স্যার সম্বোধন করে কুশল বিনিময় করেন। স্কুল থেকে ফিরছি শুনে হঠাৎ বলেন, তোর ছেলে সুজন ঢাকায় আমার বিরুদ্ধাচরণ করছে। আমার মতের বাইরে যাওয়া আমি একদম পছন্দ করি না। তাকে সাবধান করে দিস। নইলে গায়েব করে ফেলব।

শিক্ষক সুনীল কুমার শর্মা বলেন, আমি হতভম্ব হয়ে ‘তুই-তোকারি’ করে কথা বলার কারণ জানতে চাইলে তিনি আরও কাছে এসে গলায় হাত দিয়ে ধাক্কা মারেন। এরপর পাঞ্জাবি টেনে ধরে বলেন, ‘তোর ছেলেকে সাবধান করবি। নইলে খবর আছে।’ উপস্থিত সবাই আশ্চর্য হয়ে বিষয়টি চেয়ে চেয়ে দেখেছে। কেউ এমপি কমলের অপকর্মের প্রতিবাদ করেনি।

সুনীল কুমার শর্মা বলেন, প্রবীণ শিক্ষক হিসেবে এলাকার সবাই আমাকে সম্মান করে। আমি কোনো রাজনীতির সঙ্গেও জড়িত নই। আমার ছেলে সুজন শর্মা ঢাকায় রামু সমিতির সাধারণ সম্পাদক। সমিতির অভিষেকে অতিথি দাওয়াত নিয়ে সুজনের সঙ্গে কমলের বিরোধ হয়েছে। ছেলের সঙ্গে বিরোধের জন্য প্রকাশ্যে আমারই ছাত্র এমপি কমল আমাকে লাঞ্ছিত করে।

তিনি আরও বলেন, এটি বড়ই লজ্জার। ভাবতেও আমার গা শিউরে ওঠে। আমি রামু শহরের মণ্ডলপাড়ার বাড়িতে গিয়ে কমলকে পড়িয়েছি। এখন কমল সংসদ সদস্য। এটা নিয়ে গর্ব হয়। তাই আসার পথে উন্নয়নকাজের উদ্বোধন করছে দেখে আনন্দিত হয়ে গাড়ি থেকে নেমেছিলাম। এখন মনে হচ্ছে, নিজেই নিজের লাঞ্ছনা হাতে ধরে এনেছি। লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করে।

এখন আবার আজ্ঞাবহ এক শিক্ষক অন্যের জমি দখল করতে গিয়ে দ্রুত বিচার আইনে মামলার আসামী হওয়ায় বিচারক ও আদালত নিয়ে উদ্ব্যত্তপূর্ণ বক্তব্য দিয়েছেন। সেই মামলায় এমপি কমলের হয়ে প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ কারী হিসেবে পরিচিত তপন মল্লিক, আজিজ মেম্বারসহ ১২ জন প্রত্যক্ষ আসামী হওয়ায় বেসামাল হয়ে এমপি কমল বতর্কিত এ বক্তব্য দিয়েছেন বলে মন্তব্য স্থানীয়দের।

আরও পড়ুন