বিশেষ প্রতিবেদক »
স্বর্ণদোকানের মাত্র ২ বছরের বিশ্বস্ত কর্মচারিকে বিশ্বাস করে বেকায়দায় মালিক প্রদিপ বণিক। বাংলাদেশে ব্যাংকের (বিবি) নিষেধাজ্ঞার পরও কর্মচারী সুদীপ্তকে ৪টি এটিএম কার্ড ও পিন দেওয়া অস্বাভাবিক। সুদীপ্ত ১২ লাখ টাকা আগ্রাবাদের সিএণ্ডএফ ভবনের ব্র্যাক ব্যাংকের বুথ থেকে তোলার ম্যাসেজও পেয়ে ছিলেন প্রদিপ। ম্যাসেজ পেলেও টাকা না পেয়ে টেনশনে ছিল মালিক। পুলিশ জানিয়েছে সুদীপ্তকে বান্দরবান থেকে অভিযানের পর থানায় আনা হয়েছে। কিন্তু মামলার এজাহারে মালিক কর্মচারিকে কর্ণফুলী ব্রীজ এলাকা থেকে থানায় নিয়ে এসেছে। পুলিশ ও বাদীর বিপরীতমুখী বক্তব্যে পুলিশের অভিযানটাই শেষতক প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে !
জানা যায়, আগ্রাবাদের আখতারুজ্জামান সেন্টারে স্বর্ণদোকানসহ কয়েকটি স্বর্ণদোকান, হাজারীলেনে একটি অলংকার প্রস্তুতকারী কারখানা ও অনলাইন সপসহ প্রায় ৬টি প্রতিষ্ঠানের মালিক প্রদিপ বণিক।
অভিযোগ উঠেছে, লকডাউনের এই সময়ে যেখানে সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ সেখানে তিনি কেন ১২ লাখ টাকা উত্তোলন করেছেন চারটি কার্ডের বিপরীতে? তিনি কেন প্রিভিলেজ এটিএম কার্ড নিয়েছেন। কেনইবা কর্মচারিকে মুখস্ত করিয়েছেন এটিএম কার্ডের পিন নম্বর? এর অন্তরালে অর্থ লেনদেনের কোন ব্যবসা নেইতো প্রদিপের, এমন সন্দেহের তীর পুলিশের।

বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থ নিয়ন্ত্রণ সেলের পক্ষ থেকে জানা গেছে, এ বিষয়েও অভিযোগ উত্থাপিত হতে পারে, নগদ ৫ লাখ টাকা উত্তোলন বা জমা দানের বিপরীতে বাংলাদেশ ব্যাংকের নজরদারি থাকে। এ ধরনের নজরদারী এড়াতেই কি মালিক প্রদিপ কোন কৌশল অবলম্বন করেছেন? ব্রাক ব্যাংক থেকে প্রিভিলেজ ডেবিট কার্ড নিয়েছেন কিনা। এটিএম কার্ডের পিন নম্বর যেখানে হস্তান্তর নিষিদ্ধ। এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে প্রতারণা প্রতিরোধে ও হ্যাকারদের হ্যাকিং বন্ধ করতে দেশের সকল সাবসিডিয়ারী ব্যাংকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে গত মার্চ মাসে। এমন পরিস্থিতিতে কর্মচারিকে পিন নম্বর দেয়ার কোনো নিয়ম নেই।
সেখানে প্রদিপ শুধু নিজেরই নয় তার এক পার্টনারের এটিএম কার্ড ও পিন নম্বর দিয়েছেন ওই কর্মচারিকে তা এখন প্রশ্নবিদ্ধ। ব্রাক ব্যাংকের এসব কার্ডের মধ্যে একটি কার্ড আখতারুজ্জামান সেন্টারের দি সন্দ্বীপ জুয়েলার্সের আগ্রাবাদ ব্রাঞ্চের, একটি অনলাইন বাংলা সপ নামের আগ্রাবাদ ব্রাঞ্চের, একটি অনলাইন বাংলা সপ-২ এর চৌমুহনী ব্রাঞ্চের এবং অন্যটি প্রদিপের ব্যবসায়িক পার্টনারের অনলাইন ডট কম বন্দরটিলা ব্রাঞ্চের একাউন্টের বিপরীতে থাকা এটিএম কার্ড।
শুক্রবার দুপুর দেড়টার পর সিএণ্ডএফ ভবনের বুথের সামনে থাকা সিকিউরিটিকে ‘কর্মচারী সুদিপ্ত সাহা টিংকু’ কে দেখেছে কিনা এমন প্রশ্নটিও অবান্তর। কারণ বুথের সিকিউরিটি কোন ব্যক্তি বুথে ঢুকলো তা চিনে রাখার কথা নয়। যদিও অভিযোগ উঠেছে প্রতিনিয়ত প্রদিপ ও সুদীপ্ত এই বুথ থেকে টাকা তোলার কারণে চিনতে পারে। তবে আখতারুজ্জামান সেন্টারের এক দোকান মালিক জানান, প্রদিপ স্বর্ণ ব্যবসার পেছনে অর্থ লেনদেন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। ফলে তার লকডাউনেও অনেক টাকার লেনদেন করতে হয়।
গত শুক্রবার বেলা সাড়ে এগারোটার দিকে ১২ লাখ টাকা তুলে আত্মসাতের ঘটনা ঘটিয়েছে এমন অভিযোগ মালিক প্রদিপের। বিকেলে ডবলমুরিং থানায় একটি অর্থ আত্মসাৎ মামলা দায়েরের পর রাতে বান্দরবান থেকে তাকে আটক করা হয় এমন তথ্য ডবলমুরিং থানা পুলিশের। কিন্তু প্রদিপ তার এজাহারে লিখেছেন, সুদিপ্তকে তিনি কর্ণফুলী ব্রীজ থেকে নিজেই ডবলমুরিং থানায় নিয়ে আসেন। ফলে প্রশ্নবিদ্ধ পুরো অভিযান।

শুক্রবার দিবাগত রাতে সুদীপ্তের বোনের বাসা থেকে এক হাজার টাকা কম ১২ লাখ টাকা ও প্রদিপের ৪টি এটিএম কার্ড উদ্ধার করেছে পুলিশ। পুলিশ তাকে আদালতের মাধ্যমে জেল হাজতে প্রেরণ করেছে শনিবার।
জানা গেছে, শুক্রবার সকালে ১২ লাখ টাকা প্রয়োজন হয় প্রদিপ বণিকের। এই টাকা উত্তোলনের জন্য প্রদিপ তার দুই বছরের বিশ্বস্ত কর্মচারি সুদীপ্তকে চারটি এটিএম কার্ড দিয়ে টাকা তুলে আনতে বলেন। সে আগ্রাবাদস্থ সিএন্ডএফ ভবনের ব্রাক ব্যাংকের বুথ থেকে প্রতিটি এটিএম কার্ডের বিপরীতে তিন লাখ টাকা করে তুলে মালিকের বাসায় নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। বুথ থেকে টাকা উত্তোলনের পর প্রদিপের মোবাইলে ম্যাসেজ চলে যায়। কিন্তু দুপুর ২টা পর্যন্ত সুদীপ্ত মালিকের বাসায় পৌছায়নি। এতে প্রদিপ চিন্তায় পড়ে যায়। বিকাল তিনটার দিকেও সুদীপ্তের মোবাইল বন্ধ পাওয়া যায়। বিকেল ৪টার দিকে সুদীপ্ত মালিকের মোবাইলে কল দেয়। তখন সুদীপ্ত বলেছিল সাতকানিয়া থানাধীন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের প্রশিক্ষণ একাডেমী ‘বায়তুল ইজ্জত’ এলাকার পাহাড়ে তাকে চোখ-মুখ বেঁধে ছেড়ে দিয়েছে ডিবি পরিচয় দানকারীরা। এসময় তাঁর কাছ থেকে ১২ লাখ টাকা ছিনিয়ে নেয়।
সুদীপ্ত পুলিশকে বলেছে, সকাল সাড়ে ১১ টার দিকে টাকা তুলে আসার সময় একটি কালো রঙের মাইক্রো থেকে কয়েকজন তাকে ডিবি পরিচয় দিয়ে গাড়ীতে তুলেছে। গাড়িতে উঠার পরপরই ৪/৫ জন লোক তার কাছ থেকে ১২ লাখ টাকা ছিনিয়ে নেয়। এমনকি তার কাছে ইয়াবা আছে বলে গাড়িটি বান্দরবানে নিয়ে যায় চক্রটি। হাত-পা বেঁধে তাকে পাহাড়ে ছেড়ে দেয় । পরে সেখান থেকে মোবাইলে প্রদিপকে সব কিছু জানায় সুদিপ্ত। কিন্তু পুলিশ ট্র্যাকিংয়ের মাধ্যমে বান্দরবান নিশ্চিত করতে পেরেছে সুদিপ্তের অবস্থান যদিও মাইক্রোটির কোনো ভিডিও ফুটেজে পায়নি।

এ ব্যাপারে সিএমপি’র অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (পশ্চিম) বাংলাধারাকে বলেন, মামলার পর আমরা অভিযানে নামার নির্দেশ দেই। প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে সুদিপ্ত বান্দরবান থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়। থানায় এনে জিজ্ঞাসাবাদের পর তার বোনের বাসা থেকে উদ্ধার করা হয় লুটে নেয়া টাকা। অর্থ আত্মসাতের বিষয়টি সে স্বীকার করেছে। তাকে জেল হাজতে প্রেরণ করা হয়েছে।
ডবলমুরিং থানা পুলিশ জানিয়েছে, অভিযান টিম সুদীপ্তকে থানায় নিয়ে আসার পর পুলিশের ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদে সে স্বীকার করেছে, চট্টগ্রাম থেকে বান্দরবান পর্যন্ত সম্পূর্ণ তার সাজানো নাটক। তবে কালো গাড়ীতে তাকে টেনে হেঁচড়ে তোলার কোন সত্যতা না পাওয়ায় পুলিশ সুদীপ্তকে সন্দেহ করে। রাত একটার দিকে সুদীপ্ত স্বীকার করে লুটে নেয়ার বিষয়টি। পরে নগরীর পাথরঘাটা এলাকায় থাকা তার বোনের বাসা থেকে টাকাসহ ব্যাগটি উদ্ধার করা হয়। এসময় ব্যাগে পাওয়া গেছে ১১ লাখ ৯৯ হাজার টাকা। পুলিশ তা জব্দ করে।
এ ব্যাপারে মালিক প্রদিপ বণিক বাংলাধারাকে জানান, ৪টি এটিএম কার্ডের পিন নম্বর সুদিপ্তের জানা ছিল। কারণ সবসময় ওই সকল কার্ড দিয়ে বুথ থেকে টাকা তোলে বিভিন্ন দেনা মেটানোর জন্য। সুদিপ্ত টাকা তুলেছে সে ম্যাসেজ আমার মোবাইলে আসে এটিএম কন্ট্রোল থেকে। বেলা ১১ টায় সুদীপ্ত আমার বাসায় আসার কথা ছিল। কিন্তু দুপুর ২টার বেজে যাওয়ার পরও না আসায় আমার সন্দেহ হয়। তাকে ফোন করি, কিন্তু বন্ধ পাওয়া যায়। তবে বিকেল ৪টায় সুদীপ্ত সে আমাকে ফোন করে জানায় ৪/৫ জনের একটি দল ডিবি পুলিশ পরিচয়ে তাকে বান্দরবানে নিয়ে যায় এবং টাকা লুটে নেয়। পরে থানায় গিয়ে আমি মামলা দায়ের করি।
এ ঘটনায় পুলিশ সুদিপ্ত সাহা টিংকুকে গ্রেফতার দেখিয়েছে। সে রাঙ্গুনিয়ার ৩নং ওয়ার্ডস্থ মহাজন বাড়ীর অসীম সাহার ছেলে। নগরীর গোসাইলডাঙ্গাস্থ কালী বাড়ি সংলগ্ন নিধু পালিত ভবনের ৫ম তলায় পরিবার নিয়ে থাকতো।
বাংলাধারা/এফএস/এআই













