১৬ ডিসেম্বর ২০২৫

বিশ্ব শরণার্থী দিবসে যা বলল উখিয়ার ক্যাম্পে আশ্রিত রোহিঙ্গারা

সায়ীদ আলমগীর, কক্সবাজার »

২০ জুন বিশ্ব শরণার্থী দিবস। সে হিসেবে আজ বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও পালিত হচ্ছে দিবসটি। জাতিসংঘের ঘোষণায় ২০০১ সাল হতে প্রতি বছর দিবসটি পালন করা হচ্ছে।

জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা-ইউএনএইচসিআর’র মতে যুদ্ধ-জাতিগত সংঘাতসহ নানা কারণে সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বে শরণার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। চলমান সময়ে পৃথিবীর নানা দেশে শরণার্থীর সংখ্যা প্রায় ৮ কোটি।

এর মাঝে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্ত উপজেলা উখিয়া-টেকনাফে মানবিক আশ্রয়ে রয়েছে প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী। নিজ দেশ মিয়ানমারের আরাকান (রাখাইন রাজ্য) থেকে তারা জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত হয়ে প্রাণ রক্ষায় বাংলাদেশে ঢুকে পড়ে। বাংলাদেশ সরকার তাদের মানবিক আশ্রয় দিয়েছে।

২০১৭ সালের শেষ সময় হতে আশ্রিত জীবনের ঘানি টানলেও বিশ্ব শরণার্থী দিবস সম্পর্কে অজ্ঞ বিশ্বের সর্ববৃহৎ শরণার্থী শিবিরে আশ্রিত রোহিঙ্গারা।কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফে ৩৩টি ক্যাম্প ও নোয়াখালীর ভাসানচরে ১১ লাখের বেশী রোহিঙ্গা শরণার্থী অবস্থান।

উখিয়ার কুতুপালং মধুরছরা ক্যাম্পের বাস করা সালামত খান বলেন, ওপারে নিজেদের যা ছিল তা দিয়ে অন্য দরিদ্রদের সহযোগিতা দিয়েছি। কিন্তু এখানে আশ্রিত জীবনে নিজেরাই পরনির্ভরশীল। আশ্রিত জীবন পার করলেও বিশ্ব শরণার্থী দিবস সম্পর্কে আমারা কেউ অবগত নয়। এ দিবসের তাৎপর্য কি তাও জানি না। তবে, আমাদের চাওয়া নাগরিকত্ব ও সম্মান নিয়ে মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন। এখানে সুখে থাকলেও শান্তিতে নেই। আমাদের মন পড়ে আছে বাবা-মা স্বজনদের কবর সম্বলিত রাখাইনে। শরণার্থী দিবসের প্রতিপাদ্য যা-ই হউক আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে আমাদের দাবি আরাকানে রোহিঙ্গাদের স্বাধীনভাবে বসবাসের পরিবেশ নিশ্চিত করুন।

বালুখালী ক্যাম্পের মাঝি মুহাম্মদ ইলিয়াস বলেন, নিপীড়নের শিকার হয়ে বাংলাদেশে আসার পর হতেই শুনছি মিয়ানমার আমাদের ফিরিয়ে নিচ্ছে। সেভাবে নানা কার্যক্রমও শুরু হয়। বাংলাদেশ সরকার আন্তরিক ভাবে এগুলেও মিয়ানমারের খেয়ালিপনায় প্রত্যাবাসন নিয়ে আমরা দোলাচলে রয়েছি।

আব্দুর রহিম নামে আরেক রোহিঙ্গা নেতা বলেন, মিয়ানমারের তালবাহানা, বিশ্ব সম্প্রদায়ের সদিচ্ছার অভাব, তার ওপর মরণব্যাধি করোনাভাইরাসের কারণে ঘোর অন্ধকারে পড়েছে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন। আদৌ আমরা নিজ দেশে ফিরতে পারবো কি না তা নিয়ে সন্দেহে রয়েছি।

টেকনাফ নয়াপাড়া ক্যাম্পের আমির হামজা, লেদা ক্যাম্পের সলিম উল্লাহ, উখিয়া কুতুপালং ক্যাম্পের হাকিম আলী, জোহরা খাতুন, আহমদ কবির ও ফয়েজ মাঝিসহ অনেক রোহিঙ্গার মতে, শুধু বাংলাদেশ চাইলে হবে না, মিয়ানমারকে রাজি হতে হবে নিরাপদ প্রত্যাবাসনে। আন্তর্জাতিকভাবে মিয়ানমারকে বল প্রয়োগ করেই কেবল প্রত্যাবাসনের
পথ খোলা সম্ভব।

রোহিঙ্গা অধ্যুষিত পালংখালী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন চৌধুরী বলেন, রোহিঙ্গারা আমাদের জন্য বিষফোঁড়া হয়ে দেখা দিয়েছে। তারা মাদকের ব্যবসাসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছে। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধান হওয়া নিয়ে আমরা সন্দিহান। আন্তর্জাতিক কিছু সংগঠন নিজ স্বার্থে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। রোহিঙ্গা দেখিয়ে সুবিধা আদায় করছে তারা।

এদিকে, বাংলাদেশ সরকার ও আন্তর্জাতিক মহলের দীর্ঘ প্রচেষ্টা সত্ত্বেও নিরাপদ ও সম্মানজনক প্রত্যাবাসন পিছিয়ে গেছে বারবার। বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস নিয়ে দাতা দেশগুলো ব্যস্ত হয়ে পড়ায় চাপা পড়ে আছে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের সব কার্যক্রম। একই কারণে সব ধরনের জবাবদিহিতা থেকেও পার পেয়ে যাচ্ছে মিয়ানমার সরকার।

কক্সবাজার শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার শাহ্ রেজওয়ান হায়াত বলেন, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কাজ করছে। আমরা মাঠ পর্যায়ে রোহিঙ্গাদের প্রস্তুুত করছি। যখনই প্রত্যাবাসনের ডাক আসে, তখনই যেন সাড়া দিতে পারি সেভাবে প্রস্তুতি রয়েছে আমাদের।

তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের আমরা বোঝাচ্ছি এটি তাদের দেশ নয়, ডাক আসলে রাখাইনে ফিরে যেতে হবে। রোহিঙ্গারা মানসিকভাবে প্রস্তুত রয়েছে। একই সাথে এটাই বলছি,বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গাদেরকে যেনতেনভাবে মিয়ানমারে ফেরৎ পাঠাবে না। রোহিঙ্গাদের অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করেই প্রত্যাবাসন করবে।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন মুঠোফোনে এ প্রতিবেদককে বলেন, সরকারের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য একটাই; রোহিঙ্গাদের দ্রুত প্রত্যাবাসন করা। সে চেষ্টা আমরা অব্যাহত রেখেছি।

তিনি বলেন, ক্যাম্পে পাহাড় ধসে অনেক রোহিঙ্গার মৃত্যু হয়েছে। আবার অনেকে মানব পাচারসহ নানা অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে। এ কারণে আমরা কিছুসংখ্যক রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে সরিয়ে নিচ্ছি তাদের জীবন বাঁচানোর জন্য। সরকার চায় রোহিঙ্গারা যতদিন এ দেশে আছে ভালোভাবে নিরাপদ থাকুক, যোগ করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন।

প্রসঙ্গত-রোহিঙ্গা শিবির থেকে এক লাখ রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে সরিয়ে নেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এরই অংশ হিসেবে ইতোমধ্যে ১৯ হাজারের বেশি রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে সরিয়ে নিয়েছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।

উল্লেখ্য, রোহিঙ্গা আগমন ১৯৭৮ সালে শুরু। এরপর থেকে কারণে-অকারণে দলে দলে অনুপ্রবেশ করে রোহিঙ্গারা। সর্বশেষ ২০১৬ সালের ৯ অক্টোবর ও ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর থেকে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের আগমন বানের স্রোতের মতো ঘটে। রাখাইনে সহিংস ঘটনায় প্রাণবাঁচাতে পালিয়ে আসে সাড়ে ৭ লাখ রোহিঙ্গা। নতুন-পুরাতন মিলিয়ে ১১ লাখ ১৮ হাজার ৫৫৭জন রোহিঙ্গা কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের ৩৩টি ক্যাম্প ও ভাসানচরে আশ্রয় নিয়ে সব ধরণের সুযোগ সুবিধা পাচ্ছেন।

বাংলাধারা/এফএস/এআই

আরও পড়ুন

এ সম্পর্কিত আরও

সর্বশেষ