কাউছার আলম,পটিয়া »
চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার কচুয়াই ইউনিয়নের এক নং ওয়াডের ফারুকী পাড়ায় প্রবেশ করেই একটু ভিতরে গেলেই একটি পাকা বাড়ি চোখে পড়ে। বাড়ির সামনে গেলেই ভিতর থেকে আসেন এক গৃহবধূ। বাড়িটি কার জানতে চাইলে তিনি জানান মালিক আবুল কাসেম।
ওই বাড়িতে প্রায় দশ বছর ধরে বসবাস করছেন মিয়ানমারের আরকানের মংডু হতে পালিয়ে আসা আবুল কাসেমের পরিবার। আবুল কাসেম বাংলাদেশি পাসপোর্ট ব্যবহার করে পাড়ি জমিয়েছেন মালয়েশিয়া। তার দুই সন্তানকে নিয়ে স্থানীয় পরিচয়ে বসবাস করছেন তার স্ত্রী জোহরা বেগম। বড় ছেলে ইব্রাহিম ও ছোচ ছেলে তোয়ারেজ। সবার আছে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের জন্ম নিবন্ধন সনদও।
চারদিকে যখন রোহিঙ্গা নাগরিকদের অবাধ বিচরন তখনই এলাকার স্থানীয় লোকজনের মনে আবুল কাসেমের পরিবার পরিজন নিয়ে প্রশ্ন উঠে। তার দুই ছেলের দৃষ্টি কঠু চলাফেরা ও নানান অপকর্মের সাথে লিপ্ত হয়ে পড়ায় স্থানীয় সচেতন জনসাধারণ অভিযোগ করেছে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হাবিবুল হাসানের কাছে।
সেই সূত্র ধরে গত ১৯ সেপ্টেম্বর সরাসরি পুলিশ নিয়ে ঘটনাস্থল ফারুকী পাড়ায় অভিযুক্ত রোহিঙ্গা নাগরিক আবুল কাসেমের ঘরে গিয়ে তার পরিবারের লোকজনের কাছে তাদের পরিচয় ও অভিযোগের সত্যতা নিশ্চিত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় প্রশ্রয় দেয়ার অভিযোগে এসময় তার স্ত্রী জোহরা বেগম ও ছোট ছেলে তোয়ারেজকে আটক করে নিয়ে আসে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ে। সেখানেই মোবাইল কোর্ট বসিয়ে তাৎক্ষণিক মা-ছেলেকে একমাসের বিনাশ্রম কারাদন্ডের নির্দেশ দিয়ে তাদের জেল হাজতে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে।
এভাবে বিভিন্ন সময়ে মিয়ানমার থেকে এসে রোহিঙ্গারা পটিয়ার বিভিন্ন এলাকায় স্থানীয় মানুষের সাথে মিশে যাচ্ছে। অনেকের কাছেই আছে জন্ম নিবন্ধন সনদ, জাতীয় পরিচয়পত্রও। জায়গা কিনে বিল্ডিং করেও বসবাস করছে অনেক রোহিঙ্গা। অর্থের বিনিময়ে এদের সহায়তা দিচ্ছে রাজনৈতিক নেতা ও জনপ্রতিনিধিরা।

চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার বাহুলী সিকদার পড়া, গোবিন্দরখীল, দক্ষিণ শ্রীমাই, উত্তর শ্রীমাই,হাইদগাঁও, উত্তর হাইদগাঁও, দক্ষিণ হাইদগাঁও, গুচ্ছগ্রাম,পটিয়া রেল স্টেশন এলাকা,ফজুর পুল,পটিয়া মাদ্রাসার পেছনের এলাকা, ছিপাতলি,সুচক্রদন্ডী পল্লী মঙ্গল এলাকা,ব্রামনপাড়া,বিসিক শিল্প নগরীর এলাকা,কচুয়াই, কেলিশহর,পৌরসদরের ১,২,৩,৫,৮ নং ওয়াড জুড়ে রোহিঙ্গাদের নিরাপদ আবাসস্থল গড়ে উঠেছে।
ইতোমধ্যে পটিয়া থানা পুলিশ কয়েক দফায় বিশেষ অভিযানে শতাধিক রোহিঙ্গা নাগরিকে আটক করে কুতুপালং ক্যাম্পে ফেরত পাঠানো হলেও কৌশলে তারা আবার ফিরে আসে পটিয়ায় রেখে যাওয়া তাদের পরিবার পরিজনদের কাছে।
ফরিদা আকতার বসবাস করছেন পটিয়া উপজেলার ৮ নং ওয়াডের গোবিন্দরখীল ছিপাতলীর জাকের কলোনিতে। ফরিদা জানান, ১৬ বছর আগে আমরা মায়ানমার হতে এ দেশে আসি। দু’ছেলে ১ মেয়ে নিয়ে বসবাস করছি। স্বামী করিম উল্লাহকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। তাদের দুই ছেলে পটিয়া মাদ্রাসায় হেফজ খানায় পড়ে।
গোবিন্দরখীলের কুদ্দুস কলোনীতে কথা হয় রোহিঙ্গা নাগরিক আবদুর রহমানের সাথে সে জানায় ২২ বছর আগে এ দেশে আসে। পেশায় সে কাঠুরে। তার সাথে কথা বলার সময় উঠে আসে ভোটার হওয়ার প্রসঙ নিয়ে। সেও জানায় ভোটার হওয়ার কথা বলতেই কৌশলে ভোটার কার্ডটি আনতে বলি। ভোটার কার্ডটি হাতে নিতেই চোখে পড়ে তার নাম নুরুল আমিন। প্রশ্ন করা হলো নাম নিয়ে মিথ্যে কথা কেন বললেন। কোন উত্তর না দিয়ে বাসার পেছন দিয়ে সটকে পড়ে।
গোবিন্দরখীল ছিপাতলী এলাকায় পটিয়া পৌর কাউন্সিলর আব্দুল মান্নানের বাড়ির কলোনিতে পাওয়া যায় কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্প হতে পালিয়ে আসা আনোয়ার শাহ নামের একজন কে। তাকে প্রশ্ন করা হলে তিনি জানান, এখানে পরিচিত জনের কাছে বেড়াতে এসেছে। এসময় যে ঘরে তাকে পাওয়া যায় সে ঘরের ভাড়াটিয়া আবু সুফিয়ানকে তার পরিচয় জানতে চাইলে সে তার স্মার্টকার্ডটি এনে দেখায় তাতে দেখা যায় তার বাড়ি কক্সবাজার ঈদগাঁও। তার কতার্বাতা ও সন্দেহজনক।
তবে এলাকাবাসীর অভিযোগের তীর পটিয়া পৌরসভার ৮ নং ওয়াডের কাউন্সিলর আব্দুল মান্নানের দিকে। তাৎক্ষণিক আব্দুল মান্নানকে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে আমি সবসময় প্রতিবাদ করে আসছি। আমি মৌখিক ভাবে প্রশাসনকে ও জানিয়েছি।
নিজ বাড়ির কলোনিতে রোহিঙ্গাদের বসবাস এমন প্রশ্নে তিনি জানান, আমি শহরে বসবাস করি বলে মোবাইলের সংযোগ কেটে দেন।
এসময় স্থানীয়রা জানান, পুলিশ অভিযান চালিয়ে পুরুষ রোহিঙ্গাদের ধরে নিয়ে গেলেও তাদের পরিবার পরিজনদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছেনা, তাই ঘুরে ফিরে নানা কৌশলে তারা আবার ফিরে আসে। যদি তাদের সবাইকে ধরে ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয় তাহলে তাদের উপদ্রপ কিছুটা কমবে বলে ধারনা করা হচ্ছে।

এ ব্যাপারে পটিয়া থানার ওসি বোরহান উদ্দিন জানান, এ পর্যন্ত অভিযান পরিচালনা করে শ’খানেক রোহিঙ্গাদের আটক করে কুতুপালং ক্যাম্পে ও অবৈধভাবে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের দায়ে মামলা রজু করে জেল হাজতে পাঠানো হয়েছে। আমাদের এ অভিযান অব্যাহত থাকবে।
জানা যায়, ১৯৯২ সালের পর থেকে রোহিঙ্গা নাগরিকরা বিভিন্ন কৌশলে পটিয়ায় প্রবেশ করতে থাকে। তাদের মধ্যে অনেকে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের ম্যানেজ করে নিয়েছেন জন্মসনদ। জাতীয়তা সনদ নিয়ে বিদেশে পাড়ি দিয়েছেন অনেখে।
পটিয়া পৌর সদর সহ বিভিন্ন এলাকায় বার্মা কলোনি নামে কয়েকটি কলোনি রয়েছে। পটিয়া সদরের অসংখ্য রিকশা চালক ও সিএনজি চালক, দিনমজুর ছাড়াও অনেকে আবার বাসা বাড়িতে কাজের লোক হিসেবে ও কাজ করছেন নির্বিঘ্নে।
কচুয়াই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ইনজামাম উল হক জসিম বলেন, আমি নির্বাচিত হওয়ার আগে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশের নাগরিক বানানো হয়েছে। আমি দায়িত্ব গ্রহণের পর কাউকে জন্ম নিবন্ধন সার্টিফিকেট দেওয়া হয়নি। আমার পরিষদের সকল সদস্য এবং কর্মকর্তারাও সতর্ক আছে। আগে যারা এসে এলাকায় স্থায়ী বসতি গড়েছেন তাদের ব্যাপারে সরকার যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন তা বাস্তবায়নে আমরা তৈরি আছি।
কচুয়াই ইউনিয়নের স্থানীয় বাসিন্দা নুরুল কাদের জানান, এলাকায় বাসা ভাড়া দেওয়ার সময় সরকারি নিয়মে প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট দেখা হয় না। যে যার মতো ঘর ভাড়া দেয়। এলাকায় অনেকে আত্মীয়-স্বজন করে ওদের আশ্রয় প্রশ্রয় দিচ্ছেন। তাদের সংখ্যা ধারণার চেয়ে অনেক বেশি।
এ বিষয়ে পটিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) হাবিবুল হাসান বলেন, রোহিঙ্গারা যাতে ক্যাম্পের বাইরে থাকতে না পারে সেজন্য আমরা সতর্ক আছি। ইতোমধ্যে যাদের পেয়েছি আমরা ক্যাম্পে ফেরত পাঠিয়েছি। উপজেলা মাসিক আইন শৃঙলা কমিটির সভায় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের স্ব-স্ব এলাকায় রোহিঙ্গাদের অবস্থান নিশ্চিত করতে মাইকিং করার জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
তবে দীর্ঘদিন বসবাসের কারণে স্থানীয়দের সাথে মিশে যাওয়া রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে কোন তথ্য নেই বলে জানান তিনি। তবে তথ্য পেলে ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও জানালেন তিনি।
পটিয়া উপজেলা নির্বাচনী কর্মকর্তা ছৈয়দ আবু সাঈদ জানান, উপজেলায় ভোটার তালিকা হালনাগাদ শেষ হয়ে গেছে। আর কোন নতুন ভাবে ভোটার হওয়ার সুযোগ নেই। তবে শর্ষের মধ্যে যদি ভূত থেকে যায় তাহলে তা যাচাই বাছাই করে আইনানুগ ব্যবস্থা হেয়া হবে।
উল্লেখ্য, স্বাধীনতার পর ১৯৭৬ সালে সর্বপ্রথম রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ ঘটে বাংলাদেশে। এরপর অনিয়মিতভাবে নানা সময়ে রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ ঘটেছে। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রোহিঙ্গা ১৯৯২ সাল এবং ২০০৩ সালে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে। সর্বশেষ ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর নির্যাতনের মুখে আরাকান থেকে সাত লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। বর্তমানে কক্সবাজারের বিভিন্ন ক্যাম্পে প্রায় ১২ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বসবাস করছে। তবে রোহিঙ্গাদের বিশাল একটা অংশ দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়েছে।
বাংলাধারা/এফএস/এমআর













