২৯ অক্টোবর ২০২৫

বেপরোয়া চাঁদাবাজিতে অস্থির পাহাড়

আলমগীর মানিক, রাঙামাটি »

দেশি-বিদেশি নানা মহলের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় পার্বত্য চট্টগ্রামে সশস্ত্র তৎপরতায় লিপ্ত থাকা উপজাতীয় আঞ্চলিক দলগুলোর বেপরোয়া চাঁদাবাজি ও সশস্ত্র তৎপরতা বেড়ে যাওয়ায় আবারও অস্থির হয়ে উঠছে পাহাড়ের জনজীবন। চাঁদাবাজ পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের দমনে সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষণা দেয়ার সাড়ে তিন মাস সময়ের মধ্যেই বিগত বছরগুলোর চেয়ে কয়েকগুন বেশি চাঁদার হার নির্ধারণ করে প্রকাশ্যে সশস্ত্র মহড়া দিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে বেপরোয়া চাঁদাবাজিতে নেমেছে উপজাতীয় আঞ্চলিক দলগুলো।

রাঙামাটি শহরের কোতয়ালী থানা থেকে মাত্র দুই কিলোমিটারের মধ্যেই আসামবস্তি সড়কের শুরু। এই সড়কের মাঝপথ বড় আদমে রয়েছে নিরাপত্তা বাহিনীর একটি ক্যাম্প, সড়কের শেষান্তেও রয়েছে নিরাপত্তা বাহিনীর আরও একটি ক্যাম্প। এরই মাঝে সশস্ত্র তৎপরতা চালিয়ে গুলি ফুটিয়ে চাঁদাবাজি করছে জেএসএস এর সন্ত্রাসীরা।

খোঁদ রাঙামাটি শহরের ৩০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের একটি মাত্র সড়ক থেকেই গত এক বছরে চাঁদাবাজি করে আদায় করে নিয়েছে অন্তত আড়াই কোটি টাকা। সূত্রমতে, জেএসএস এর কালেক্টর সুমন তনচংঙ্গ্যা ওরফে জেমস, সহকারী কমান্ডার বিপ্লব চাকমা, কালেক্টর রিটন চাকমা, মিল্টন চাকমা ও অপু চাকমার নেতৃত্বে আসামবস্তি-কাপ্তাই সড়কে চাঁদাবাজির এই মহোৎসব চলছে।

এলজিইডি, সড়ক বিভাগ, উন্নয়ন বোর্ড ও পিআইও অফিসের মাধ্যমে রাঙামাটিস্থ আসামবস্তি-কাপ্তাই সড়কে বাস্তবায়নাধীন প্রায় অর্ধশত কোটি টাকার উন্নয়ন কাজ চলছে। এই কাজ থেকে এবং উক্ত সড়কে চলাচলকারি যাত্রীবাহী পরিবহণগুলো থেকে জেএসএস’র বিবাদমান দুইটি গ্রুপ গত এক বছরে অন্তত আড়াই কোটি চাঁদাবাজির মাধ্যমে আদায় করে নিয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট্ দায়িত্বশীলরা নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন।

চলতি মাসেই দুই দফায় নির্ধারিত চাঁদার দাবিতে খোদ রাঙামাটি শহরেই প্রকাশ্যে দিবালোকে সশস্ত্র হামলা চালিয়েছে। মাসে শুরুতেই ২ সেপ্টেম্বর শুক্রবার এই একই আসামবস্তি কাপ্তাই সড়কের বড় আদমের তঞ্চঙ্গ্যা পাড়ায় জেএসএস এর ১০ সদস্যের একটি সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ চাঁদা পরিশোধ না করায় ৬টি সিএনজি অটোরিকশা এবং ১টি পাথরবোঝাই ট্রাক আটক করে। পরবর্তীতে সেনাবাহিনীর দুইটি টহল দল ঘটনাস্থলে গিয়ে করে সিএনজি অটোরিকশাগুলো উদ্ধার করে।

এই ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই দুই সপ্তাহের মধ্যেই গতকাল শুক্রবার দুপুরে প্রকাশ্যে দিবালোকে সিএনজি অটোরিকশা আটকিয়ে চালক কামাল উদ্দিনকে বেদড়ক মারধর করে তার অটোরিকশাটি আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেয়। এই ঘটনায় বিক্ষুব্ধ চালকরা শুক্রবার বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত রাঙামাটি-চট্টগ্রাম মহাসড়কে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ মিছিল সমাবেশ করেছে। সমাবেশে প্রশাসনকে তিন দফা দাবি বাস্তবায়নে ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম বেধে দেয় অটোচালকরা।

রাঙামাটি কোতোয়ালী থানার অফিসার ইনচার্জ মো. কবির হোসেন জানিয়েছেন, আমরা এই ঘটনায় মামলা নিয়েছি এবং প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করছি। সন্ত্রাসীদের ব্যাপারে আমরা নজরদারি বৃদ্ধি করেছি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সুইজারল্যান্ড খ্যাত রাঙামাটির আসামবস্তি কাপ্তাই সড়কটিকে ওই এলাকার পর্যটন সেক্টরের হাব হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে রাঙামাটিতে আগত পর্যটকদের কাছে এই সড়কটিকে আরো আকর্ষণীয় ও দৃষ্টিনন্দন করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে সরকারি উন্নয়ন কাজ বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠানগুলো রাস্তা-ঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণ করছে। এই সড়কের মধ্যেই স্থাপিত করা হয়েছে রাঙামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠানটি। ইতোমধ্যেই এই সড়ককে ঘিরে ওই এলাকায় স্থাপিত হয়েছে বেশ কয়েকটি রিসোর্ট ও পর্যটন স্পট ও অর্ধশত রেস্টুরেন্ট। এসব প্রতিষ্ঠান থেকেও জেএসএস’র সন্ত্রাসীরা নিয়মিতহারে চাঁদাবাজি করে যাচ্ছে।

এলজিইডি ও ঠিকাদারদের একটি বিশ্বস্ত সূত্র জানিয়েছে, সাম্প্রতিক সময়ে রাঙামাটির কাপ্তাই, রাজস্থলী, রাইখালী, বাঙ্গালহালিয়া, বিলাইছড়ি ঘাগড়া ও মানিকছড়ি এলাকায় জেএসএস’র সশস্ত্র আধিপত্য বৃদ্ধি করা হয়েছে। এই এলাকাগুলোতে বাস্তবায়নাধীন বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প ইতোমধ্যেই বন্ধ করে দিয়েছে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানগুলো। তারমধ্যে অন্যতম একটি প্রকল্প হলো কারিগর পাড়া হয়ে বিলাইছড়ি পর্যন্ত সড়ক নির্মাণ প্রকল্পটি। কয়েকটি গ্রুপে প্রায় একশো কোটি টাকা ব্যয়ে এই সড়কটি বাস্তবায়ন করছে এলজিইডি কর্তৃপক্ষ। জেএসএস এর জুম্ম চাঁদাবাজদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে ইতোমধ্যেই এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন কাজ বন্ধ রেখেছে সংশ্লিষ্টরা।

অপরদিকে, রাঙামাটিতে প্রায় পৃথক পৃথকভাবে দুইশো কোটি টাকার সড়ক উন্নয়ন কাজ বাস্তবায়ন করছে রাঙামাটি সড়ক বিভাগ। বৃহৎ একটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এই প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করা হলেও বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটি শহরের বাইরের কাজগুলো বন্ধ রেখেছে। কারণ অনুসন্ধানে জানা গেছে, জেএসএস’র পক্ষ থেকে এই (ন্যাশনাল…) প্রতিষ্ঠানটির কাছে ৫ কোটি টাকা চাঁদা দাবি করেছে। এই টাকা না পেয়ে উক্ত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটির মানিকছড়ি ও দেপ্পোছড়ির সাইটে দুইবার আগুন লাগিয়ে দিয়ে ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে।

জেএসএস এর সন্ত্রাসী কালেক্টর সুমন তনচংঙ্গ্যা ওরফে জেমস ও তার সহযোগি মিল্টন ও অপু চাকমার প্রত্যক্ষ নেতৃত্বে এই অপকর্মটি সম্পাদন করা হয় বলে সূত্র জানিয়েছে। ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানটির একজন ঘনিষ্টজন জানিয়েছেন, ইতোমধ্যেই রাঙামাটির কাজগুলো গুছিয়ে তারা চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

রাঙামাটির একাধিক ঠিকাদার জানিয়েছেন, মূলত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও জিওসি’র বক্তব্যকে চ্যালেঞ্জ করেই নিজেদের সশস্ত্র তৎপরতা বৃদ্ধি করছে অত্রাঞ্চলের আঞ্চলিক দলগুলো। নিয়মিত চাঁদা দেওয়ার পরেও বর্তমানে রডের মূল্যবৃদ্ধিতে ঠিকাদারদের দিশেহারা অবস্থা, বেড়েছে অন্যান্য নির্মাণ সামগ্রীর দামও। এরই মধ্যে অফিসের কর্তাবাবুদের জন্য নির্ধারিত এক পার্সেন্ট কমিশন। প্রকল্প পিডির জন্য এক পার্সেন্ট কমিশন। সর্বোপরি সশস্ত্র পাহাড়ি চাঁদাবাজদের পক্ষ থেকে এখন দ্বিগুন হারে চাঁদা দাবির ঘটনায় পুরোদমে হাঁপিয়ে উঠছে পাহাড়ের ঠিকাদার, ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে পরিবহণ ব্যবসায়ী, অটোরিকশা চালক, সাধারণ বাসিন্দারা।

বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক মন্তব্য করে রাঙামাটি চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি আব্দুল ওয়াদুদ বলেছেন, পাহাড়ে মূলত চাঁদাবাজিকে কেন্দ্র করেই তথাকথিত আঞ্চলিকদলের নামে সন্ত্রাসী সংগঠন সৃষ্টি হয়েছে। এদের প্রধান কাজই হলো চাঁদাবাজি। পাহাড়ের চলমান এই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের প্রধান লক্ষ্য হলো সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বন্ধ করে দেওয়া। এসকল সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে প্রশাসনের আরো কঠোর হতে হবে, অন্যথায় সরকারের জন্য এসব সন্ত্রাসী নির্ভর উপজাতীয় আঞ্চলিক দলগুলো বিষফোঁড়া হয়ে দাঁড়াবে।

আরও পড়ুন