২৩ অক্টোবর ২০২৫

ভাইরাল টিকটিকি ‘সান্ডা’: কৌতুকের আড়ালে প্রবাসীদের বাস্তবতা ও ধর্মীয় বিতর্ক

সম্প্রতি ‘সান্ডা’ নামের একটি মরু প্রাণী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনার কেন্দ্র বিন্দুতে রয়েছে। এটি একটি নিরীহ মরুপ্রাণী—দেখতে টিকটিকির মতো, লেজটা মোটা ও খাঁজযুক্ত। নাম তার ‘সান্ডা’। এই প্রাণীটি বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এমন এক ট্রেন্ডের জন্ম দিয়েছে, যার কেন্দ্রে রয়েছে হাস্যরস, রসিকতা, বিতর্ক এবং এক গভীর বাস্তবতা।

সোশ্যাল মিডিয়ার খোলা মঞ্চে ভাইরাল হওয়া এই প্রাণীটিকে ঘিরে এখন চলছে তুমুল আলোচনা, ট্রল, মিম আর রিলসের বন্যা। মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত বাংলাদেশি প্রবাসীরা সান্ডা শিকারের ভিডিও পোস্ট করে নেট দুনিয়ায় এনে দিয়েছেন এক নতুন ‘প্রবাহ’। কেউ বলছেন, “ভাই, সান্ডা না ধরতে পারলে চাকরি যাবে”, আবার কেউ কৌতুক করে লিখছেন, “কফিল বলছে, সান্ডা না পেলে ভিসা ক্যানসেল!”

কিন্তু এই কৌতুকে ভরা ভিডিওর আড়ালেই লুকিয়ে আছে এক কঠোর বাস্তবতা। মরুর উত্তপ্ত বালির মধ্যে দৌড়ে সান্ডা ধরছেন যেসব প্রবাসী, তারা কেউ নিছক আনন্দের জন্য নয়, বরং হয়তো কর্মসংস্থান রক্ষার নিরব যুদ্ধ লড়ছেন।

সান্ডা: বিজ্ঞান, বিশ্বাস ও বিভ্রান্তির ত্রিমুখী গল্প

সান্ডা, যার বৈজ্ঞানিক নাম Uromastyx, মূলত আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের মরু অঞ্চলে বসবাসকারী একধরনের সরীসৃপ। এটি নিরীহ, তৃণভোজী এবং আত্মরক্ষার্থে এর খাঁজযুক্ত লেজ ব্যবহার করে। বহু বছর ধরে মরুর বেদুইনরা এই প্রাণীকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে আসছে।

তবে প্রশ্ন উঠেছে—সান্ডা খাওয়া কি ইসলামে বৈধ? ইসলামি শরিয়াহ মতে, এ বিষয়ে ভিন্ন মত রয়েছে। হাদিসে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) নিজে সান্ডা খাননি, তবে সাহাবিদের খেতে নিষেধও করেননি। সাহাবি খালিদ বিন ওয়ালিদ (রা.) দব খেয়েছিলেন।

হানাফি মাজহাব অনুসারে, যেহেতু দব বা সান্ডা সরীসৃপ শ্রেণির প্রাণী, তাই তা খাওয়া মাকরুহ বা অপছন্দনীয়, অনেক সময় হারাম হিসেবেও বিবেচিত হয়। তবে অন্যান্য মাজহাব-এর মতানুসারে, যেহেতু এটি হারাম বলা হয়নি, তাই এটি খাওয়া হালাল।

দারুল ইফতা বাংলাদেশ এবং ইসলামিক ফাউন্ডেশন-এর মতে, সান্ডা খাওয়া হারাম বলা যাবে না। রাসুল (সা.) নিষেধ করেননি, তাই এটি সম্পূর্ণভাবে অশুদ্ধ নয়। যারা অভ্যস্ত, তারা খেতে পারেন, আর যারা অপছন্দ করেন বা যাদের মাজহাবে নিষিদ্ধ, তাদের জন্য পরিহার করাই উত্তম।

সান্ডা তেল: বিশ্বাস না বিভ্রান্তি?

আরেকটি বহুল আলোচিত বিষয় হলো—‘সান্ডা তেল’। এটি নিয়ে প্রচলিত আছে যে, এটি যৌন শক্তি বৃদ্ধি করে। যদিও এই বিশ্বাসের পেছনে বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই, তথাপি ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে এখনো কিছু হাটবাজারে এই তেল বিক্রি হতে দেখা যায়। অনেকেই একে আয়ুর্বেদিক চিকিৎসার অংশ মনে করেন।

বাংলাদেশে প্রতিক্রিয়া ও সাংস্কৃতিক অভিঘাত

বাংলাদেশে এই ভাইরাল ট্রেন্ড ঘিরে সৃষ্টি হয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। কেউ এটিকে নিছক মজার বিষয় হিসেবে দেখছেন, কেউ বলছেন, এটি প্রবাসীদের ছোট করে দেখানোর চেষ্টা। তবে অনেকে এটিকে দেখছেন এক নতুন সাংস্কৃতিক প্রতীক হিসেবে যেখানে সান্ডা হয়ে উঠেছে প্রবাসীদের হাস্য-কান্না, কষ্ট ও সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি।

ফেসবুক, টিকটক কিংবা ইউটিউবে এখন চোখ রাখলেই দেখা যাচ্ছে ‘সান্ডা শিকার’, ‘সান্ডা বিরিয়ানি’, এমনকি ‘সান্ডা তেল’ সংক্রান্ত ভিডিও। মিম ও রিলসের এই বন্যার মধ্যে হাস্যরস থাকলেও লুকিয়ে আছে জীবন সংগ্রামের কঠিন বাস্তবতা।

শেষ কথা: সান্ডা শুধু এক প্রাণী নয়—এক প্রতীক

সান্ডা এখন শুধু একটি মরুপ্রাণী নয়, বরং এক সামাজিক প্রতীক। এটি যেমন সোশ্যাল মিডিয়ার হাসির উপাদান, তেমনি এক শ্রেণির মানুষের জীবনের প্রতিচ্ছবি। এই প্রাণীটির মাধ্যমে যেমন উন্মোচিত হয় প্রবাসী জীবনের রূঢ় বাস্তবতা, তেমনি ধর্মীয় বিতর্কও উঠে আসে নতুন আলোচনায়।

তবে আমাদের প্রত্যেকের উচিত—মজা বা ট্রেন্ড অনুসরণের পাশাপাশি একটি মানবিক ও শ্রদ্ধাশীল দৃষ্টিভঙ্গি বজায় রাখা। কারণ, ভাইরাল ভিডিওর পেছনেও থাকে একজন মানুষের জীবন, পরিশ্রম আর আশা-নির্ভর গল্প।

আরও পড়ুন