ভালো থেকো; দেখা হবে জান্নাতে

প্রফেসর ডা. সৈয়দ গোলাম মহিউদ্দিন»

সৈয়দ আফসার উদ্দিন। পরিবার ও স্বজনদের কাছে মিঠু নামেই যার পরিচিতি। ব্রিটেনের গণমাধ্যমের অত্যন্ত পরিচিত ও প্রিয়মুখ, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, ব্রডকাস্টার এবং কমিউনিটি কর্মী। অন্য আর দশজনের মত অফুরন্ত প্রাণ নিয়ে এসেছিল এই দুনিয়ায়। তাঁর মৃত্যু চুরমার করে দিয়েছে আমার ভেতরটা। এই ব্যথা কাউকে বোঝানোর না। আমার গর্ব করার জায়গাটা হারিয়ে ফেলেছি। তুমি চলে যাওয়ার পরে ভাবী (প্রয়াত সৈয়দ আফসার উদ্দিন মিঠুর স্ত্রী) আম্মাকে বলেছে, ‘আপনি অনেক ভাগ্যবতি যে আপনার ছেলে মা ছাড়া কিছুই বুঝতো না। আল্লাহ্ যেন সকল মাকে আপনার এই ছেলের মতো সন্তান দান করেন।’ তুমি জীবনের চেয়েও বড় ছিলে। তুমি ছিলে ভালবাসায় ভরা একটা মানুষ। তুমি তোমার ক্যান্সারকে পরাজিত করে প্রায় ৯ বছর আমাদের সময় ও ভালবাসা দিয়েছো। কথা আর লেখা দিয়ে তোমার ভালবাসার ঋণ কখনও শোধ হবে না। আমরা কাছের অনেকেই তোমাকে সঠিক মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ হয়েছি, আমাদের ক্ষমা করে দিও।

তুমি না থাকলে আমার জাপান থেকে ইংল্যান্ডে আসা হতো না। আমার কোয়ালিফিকেশন ও প্রফেশন নিয়ে তুমি ছিলে গর্বিত, যেমন করতা গর্ব তোমার দুই ভাতিজা ও ভাগ্না-ভাগ্নিকে নিয়ে। তোমার কাছ থেকে অনেক শিখেছি, ধন্যবাদ। তুমি আমাদের নিয়মিত হাসিয়েছিলে এবং জীবনকে মজার বানিয়েছিলে। তুমি ছিলে আমাদের যে কোন পারিবারিক অনুষ্ঠানের তারকা। তোমাকে কখনো একজন বাবা হিসেবে, কখনো একজন স্বামীর ভূমিকায়, কখনো সন্তান, ভাই, চাচা, মামা, খালু এবং ফুফা হিসেবে দেখে অনেক শিখেছি। তুমি সর্বদাই তোমার সন্তানদের বুকে রেখেছিলে। মা-বাবার প্রতি তোমার শ্রদ্ধা ও ভালবাসা ছিলো অতুলনীয়। এমন দিন নেই যে তুমি আম্মাকে ফোন দাওনি। তোমার সমান কখনো হতে পারবো না, কখনও না।

আল্লাহর প্রতি তোমার অনেক অনেক ভয় ছিলো। এই ভয়কে কাজে লাগিয়ে তোমাকে কিছু বোঝানো ছিলো আমার জন্য পানিভাত। একটি মানুষ তোমার বিরুদ্ধে পেলাম না -এটা ছিলো তোমার বিরাট অর্জন। তুমি আল্লাহর একজন প্রিয় বান্দা ছিলে – তুমি জুম্মার রাতে দুনিয়া ছাড়তে চেয়েছিলে, মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আল আমীন তা কবুল করেছেন। তুমি অনেক বিনয়ী ছিলে। মূলত আমি ছিলাম তোমার আদরের ছোট ভাই। কিন্তু তোমার অতি বিনয়ের কারণে আমি বড় ভাইয়ের ভুমিকা রাখতাম। আমরা দুজন বন্ধুও ছিলাম বটে! আরো ছিলাম দুজনে দুজনার ভায়রা ভাই। আমাদের ভুল বোঝাবুঝি একটা ফোন কলে শেষ হয়ে যেতো। তোমার খবর পড়ার স্টাইল ছিলো ইউনিক। আমার চোখে, আপনি কেবল যুক্তরাজ্যের সেরা বাংলা সংবাদ পাঠক ছিলেন। খবর পড়ার প্রতি তোমার উৎসর্গ বলে শেষ হবে না। তিন দশকেরও অধিক সময় ধরে বিলেতে বাংলাদেশি কমিউনিটিতে বাংলা ভাষা শিক্ষা এবং ব্রিটিশ বাংলা মিডিয়াতে অসাধারণ অবদান রাখার স্বীকৃতস্বরূপ আজীবন সম্মাননা প্রদান করা হয়।

চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার চিনকি আস্তানার তাকিয়া বাড়ি (সৈয়দ বাড়ি) এই সন্তানের জন্ম ও বেড়ে ওঠা ঢাকায়। আমরা ছয় ভাই-বোনের মধ্যে তুমি তৃতীয়। ১৯৯৯ সালে ব্রিটেনের প্রথম স্যাটেলাইট বাংলা টিভি চ্যানেল, বাংলা টিভিতে সংবাদ পাঠক হিসেবে তিনি নিজেকে সংযুক্ত করেন। বাংলাদেশে থাকাকালীন সংবাদ ও সাংবাদিকতার সাথে যুক্ত ছিলেন। ইত্তেফাক গ্রুপের স্পোর্টস রিপোর্টার হিসেবে কাজ করেছেন। বাংলাদেশ টেলিভিশনে ক্রিকেট ধারাভাষ্যকার ও উপস্থাপক হিসেবে কাজ করেছে। বাংলাদেশ ক্রীড়া লেখক সমিতির সক্রিয় সদস্য ছিলেন। ব্রিটেনে বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিস রেডিওতে কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স, খেলাধুলা এবং ম্যাগাজিন প্রোগ্রামে কাজ করেছেন আট বছর। চার বছরের জন্য ভয়েস অফ আমেরিকা রেডিওর লন্ডন প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেছেন।

শিক্ষকতায় তাঁর রয়েছে ত্রিশ বছরের অভিজ্ঞতা। বাংলাসহ পাঁচটি বিষয়ে ইয়ার সেভেন থেকে  এ লেভেল পর্যন্ত শিক্ষা দেয়ার পাশাপাশি তিনি দীর্ঘদিন হেড অব ইয়ার এবং ডাইরেক্টর অফ স্কুল হিসেবে কাজ করেন। শারীরিক অসুস্থতার কারণে বছর তিনেক আগে বাধ্য হয়ে তাঁকে অবসরে যেতে হয়। পাশাপাশি জিসিএসই বাংলার পরীক্ষক হিসেবে একিউএ এক্সাম বোর্ডের সাথে যুক্ত ছিলেন ১৯৯৬ সাল থেকে।
সন্ধ্যাকালীন চাকুরী হিসেবে ১৯৯৩ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত তিনি ইএসওএল লেকচারার হিসেবে টাওয়ার হ্যামলেটস্ কলেজে কাজ করেন।
তোমার প্রতি তোমার সহকর্মীদের প্রাণ ভরা ভালবাসা দেখে প্রাণ ছুঁয়ে গেছে। আত্বীয়-স্বজন ও তোমার দেশ-বিদেশের বন্ধুরা তোমাকে হারিয়ে পাগল প্রায়।

আমার নিয়মিত খোঁজ নেওয়ার কিংবা আবেগ দেখানোর আর কেউ রইলো না। কেউ আর জানতে চাইবে না, কবে আবার ব্রিস্টল থেকে লন্ডনে যাবো, কিম্বা লন্ডন থেকে বাসায় গিয়ে ঠিকঠাকমতো ফিরেছি কিনা। ঘণ্টার পর ঘণ্টা আর কথা বলা হবে না। অভিমান অভিযোগও আর কেউ করবে না। হাসপাতালে আমার কপালে দেওয়া তোমার শেষ চুমু আজীবন আমার সঙ্গে থাকবে। মহান আল্লাহ্ তোমাকে বেহেস্ত নছিব করুন। তোমার মত ভালো লোকদের আল্লাহতা’আলা অবশ্যই মূল্যায়ন করবেন। ইনশাল্লাহ্ তোমার সঙ্গে দেখা হবে জান্নাতে। আমীন!

লেখক : চিকিৎসক ও বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা