২৯ অক্টোবর ২০২৫

‘ভুল চিকিৎসায়’ মৃত্যুমুখে রোগী, ডাক্তার বললেন—‘ব্যাড লাক’

জিয়াউল হক ইমন»

আঠারো বছর বয়সী তরুণ নূর নবী। ভুগছিলেন পেট ব্যাথা নিয়ে। তাই তাকে পরিবার ভর্তি করায় বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল হাসপাতালে। যাওয়ার পর কর্তব্যরত চিকিৎসক বললেন—‘ইমার্জেন্সি’ অপারেশন করাতে হবে। কিন্তু কিসের জন্য করাতে হবে বা কি রোগ, তা জানায়নি স্বজনদেরও। অপারেশনের ঠিক তিনদিন পর ফের আরেকটি অপারেশন করেন ডাক্তাররা। এরপরই হাল বেহাল হতে থাকে নূরনবীর।

নূর নবী সুস্থ সবল ৭০ কেজি ওজনের দেহ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলেও দুই দফা অপারেশনের পর তার ওজন এসে ঠেকেছে ২৫ কেজিতে। রোগীর স্বজনদের দাবি— ‘ভুল চিকিৎসায়’ এই অবস্থা হয়ে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন নূর নবী। শুধু তাই নয়, চিকিৎসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র আটকে রেখে রোগীকে অন্য হাসপাতালেও না যেতে দেবার অভিযোগ তুলেছেন স্বজনরা।

নূর নবী চাঁদপুর জেলার শাহারাস্তি টামটা ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ডের গোলপুরা পাওটারী বাড়ির অসহায় মো. আমির হোসেনের ছোট ছেলে।

জানা যায়, পেট ব্যাথার উপসর্গ নিয়ে গত ৮ জুন নগরীর ফয়েস লেক এলাকার বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল হাসপাতালে ভর্তি হয় নূর নবী। এরপর দুই দফা অপারেশনের পর ১৫ জুন থেকে তার স্বাস্থ্যের অবনতি হতে থাকে।

সরেজমিনে রবিবার (২১ আগস্ট) বিকেলে বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল হাসপাতালের ৫ম তলায় ইউরোলজি ইউনিটে গেলে কথা হয় রোগীর স্বজনদের সঙ্গে।

এসময় নূর নবীর মা বলেন, ‘ডাক্তার এখানে আনার পর বললেন এই মুহূর্তে আর্জেন্ট অপারেশন করতে হবে। অপারেশনের ৩ দিন পর আবারও অপারেশন করেছে। কিন্তু কি অপারেশন করছে তা আমাদের বলেনি। কোন কথাই বলেনি। কি হচ্ছে বা কি—কিছুই বলেনি এ ব্যাপারে।’

তিনি বলেন, ‘দ্বিতীয় অপারেশনের পর থেকেই তার শরীরের এ অবস্থা হয়। ৭০ কেজি ওজন ছিল তার, এখন তা ২৫ কেজিতে এসে নেমেছে। এই ভুল চিকিৎসার কারণে এখন বা পাশ অবশ। ডাক্তার বলছে চিকিৎসা চলতেছে। তিনদিন আগেও বলছে সুস্থ হয়ে যাবে। সামান্য পেটে ব্যাথা নিয়ে ভর্তি করিয়েছিলাম। এ পর্যন্ত প্রায় ৮ লাখ টাকার মত খরচ করেছি। রিপোর্টের ফাইলসহ লুকিয়ে ফেলেছে তারা।’

রোগীর বোন বলেন, ‘অপারেশনের আগের দিনও আমার ভাই আমার সঙ্গে কথা বলেছে। কিন্তু অপারেশনের পর থেকে আমি আমার ভাইয়ের মুখ থেকে একটু কথাও শুনিনি। ও যত ব্যস্তই থাক সবসময় ও আমাকে ফোন দিত, কথা বলতো। কিন্তু অপারেশনের পর থেকে আমার ভাইয়ের যে কথা বলা বন্ধ হয়েছে এখন পর্যন্ত কথা বলে না। এমনকি ও আমাকেও চিনেনা।’

‘ও সুস্থ ছিল। আমি ১৫ দিন আগেও দেখে গিয়েছি আমার ভাই হাত-পা চারটাই নাড়াচ্ছে। কিন্তু এখন এসে দেখি আমার ভাইয়ের হাত-পা অবশ। আমার সুস্থ ভাইয়ের শরীর এখন একটা কঙ্কালের চেয়েও খারাপ হয়ে গেছে। কিছুই নেই শরীরে।’—বলেন তিনি।

নূর নবীর বোন বলেন, ‘আমি ডাক্তারকে এটা পর্যন্ত বলছি যে—স্যার, আমি আমার ভাইকে অন্য জায়গায় নিয়ে যেতে পারব? নিয়ে গেলে ভালো চিকিৎসা হবে। উনি আমার সরাসরি বারণ করেছে। বললেন, না না। এই হাসপাতালের চেয়ে ভাল চিকিৎসা তুমি কোথাও পাবা না।’

এদিকে হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডাক্তার মো. বদিউল আলম রোগীর স্বজনকে এটা নিয়ে বাড়াবাড়ি না করতে হুমকি দিয়েছেন জানিয়ে রোগীর বোন বলেন, ‘তুমি কোর্ট থেকে অর্ডার নিয়ে আসো । কোর্ট থেকে অর্ডার নিয়ে আসলে আমি তোমাকে কাগজপত্র দিয়ে দিব। তুমি কি করতে পারো করো। আমার কোন সমস্যা নেই। আমার আরও দুইটা হাসপাতাল আছে। আমার টাকা-পয়সার অভাব নেই। তুমি কি করবা? যা করার করো।’

তিনি বলেন, ‘এরপর আমি শেষবারের মতো ওনাকে জিজ্ঞেস করলাম, স্যার আপনি কি আমার ভাইয়ের চিকিৎসার কাগজপত্র দিবেন না? উনি উত্তর দিল—না, এটা আইনে নাই। হাসপাতালের রেকর্ড আমি দিব না। আমি প্রধানমন্ত্রী চাইলেও কাগজ দিব না। প্রধানন্ত্রীও আমার কাছে কাগজ চাইতে হলে কোর্টে যেতে হবে।’

এ বিষয়ে উপস্থিত ইনর্টান ডাক্তারদের কাছে জানতে চাইলে তারা এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলবেন না জানিয়ে ইমার্জেন্সি মেডিকেল অফিসারের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।

পরে দায়িত্বে থাকা ইমার্জেন্সি মেডিকেল অফিসারের সাথে কথা বলতে তার রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ দেখা যায়। এসময় একাধিকবার নক করেও সাড়া মেলেনি কারও।

তবে হাসপাতালের এনেসথিয়া ডির্পার্টমেন্টাল হেড ডা. কামরুল হাসানের দাবি তাদের চিকিৎসায় ভুল নেই এবং রোগীর এই অবস্থা ‘ব্যাড লাক’।

ডা. কামরুল হাসান মুঠোফোনে বাংলাধারাকে বলেন, ‘এটাকে যদি ওরা বলে ট্রিটমেন্ট দেওয়া হয়নায়, কেন ভাল হয়নায়, ওজন কমে গেছে কেন… এগুলি একটার পর একটা হবেই। এখানে ট্রিটমেন্টের কোন অবহেলা নেই। আমার দেখা মতে, এ ধরণের ৬০-৭০ শতাংশ রোগী মারা যায় যদি দেড়িতে অপারেশন করতে আসে।’

তিনি বলেন, ‘কিছু কিছু রোগী ভাল হয়। তিন-চার অথবা পাঁচ মাস হাসপাতালে থাকলে তাদেরও হাড্ডি শুকিয়ে পাতলা হয়ে যায়। এখানে ট্রিটমেন্টে কোন সমস্যা নেই। আর আমরা কোন টাকা-পয়সাও নেইনি। তার ইনফেকশন ছড়িয়ে পড়ে সেখান থেকে আস্তে আস্তে… আমরা বলব এটা একটা সিকুয়েন্সের ‘ব্যাড লাক’ যে রিকোভার হচ্ছেনা।’

ডা. কামরুল বলেন, ‘এখন আমার উপদেশ থাকবে যদিও সময় কম, এখনও যদি তারা মনে করে আমরা টাকা-পয়সা খরচ করে আরও কোথাও যদি মেডিকেলে যাই ট্রিটমেন্টের জন্য, তারা দরকার হলে যাবে। এখানে হাউকাউ করলে রোগীর ইমপ্রুভমেন্ট হবেনা।’

বাংলাধারা/আরএইচআর

আরও পড়ুন