২১ নভেম্বর ২০২৫

ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে চট্টগ্রাম বন্দর; বিশেষজ্ঞদের সতর্কবার্তা

দেশে ৩০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বড় ভূমিকম্প হয়েছে আজ শুক্রবার সকালে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা (ইউএসজিএস) জানায়, ভূমিকম্পটির গভীরতা ছিল ১০ কিলোমিটার।

আজকের এই ভূমিকম্পের পর দেশের প্রধান সামুদ্রিক প্রবেশদ্বার চট্টগ্রাম বন্দর ভূমিকম্পের উচ্চ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে বলে জানিয়েছেন ভূতাত্ত্বিক ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞরা।

সাম্প্রতিক ভূকম্পন পর্যবেক্ষণ, টেকটনিক প্লেটের অস্বাভাবিক নড়াচড়া এবং উপকূলীয় মাটির গঠন বিশ্লেষণ করে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, যেকোনো সময় বড় ধরনের ভূমিকম্প এ অঞ্চলের অর্থনীতি ও লজিস্টিক ব্যবস্থাকে বড় ধাক্কা দিতে পারে।

বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি (বুয়েট), চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং সিসমিক পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের গবেষণা বলছে, পূর্বাঞ্চলীয় সক্রিয় ফল্ট লাইনের সঙ্গে চট্টগ্রাম অঞ্চলের অবস্থান অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। বিশেষত সীতাকুণ্ড থেকে কক্সবাজার উপকূল পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলে বারবার ক্ষুদ্র কম্পন ধরা পড়ছে, যা বড় ভূমিকম্পের ইঙ্গিত হতে পারে।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানান, বন্দরের পুরোনো জেটি, বেশ কিছু গুদামঘর এবং নদীর তীরবর্তী স্থাপনাগুলো শক্তিশালী ভূমিকম্প মোকাবিলায় সক্ষম নয়। “আমাদের প্রতিদিনের কার্গো হ্যান্ডলিং ক্ষমতা ৬০–৭০ হাজার টন। বড় ধরনের ভূমিকম্প হলে এসব স্থাপনা ভেঙে পড়লে দেশের বাণিজ্য কয়েক সপ্তাহের জন্য স্থবির হয়ে যেতে পারে,” বলেন তিনি।

ভূতাত্ত্বিক বিশেষজ্ঞরা উল্লেখ করেন, কর্ণফুলী নদীর আশপাশের মাটি নরম ও পানিনির্ভর হওয়ায় ভূমিকম্প হলে লিকুইফ্যাকশন (মাটি তরল হয়ে যাওয়া) দেখা দিতে পারে। এতে বন্দর এলাকার অবকাঠামো ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। এছাড়া কনটেইনার ইয়ার্ড, ক্রেন, রেললাইন ও ট্রানজিট সড়কগুলোও নিরাপত্তা হুমকিতে পড়তে পারে।

সিসমিক গবেষকদের দাবি, জরুরি ভিত্তিতে বন্দরের ভূমিকম্প-সহনশীলতা যাচাই, অবকাঠামোর শক্তিবৃদ্ধি, ভূমিকম্প-পরবর্তী জরুরি পরিকল্পনা, নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্র এবং আধুনিক সিসমিক সেন্সর স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।

চট্টগ্রামের স্থানীয় ব্যবসায়ী ও আমদানিকারকরা বলছেন, বন্দরটির দীর্ঘমেয়াদি নিরাপত্তা নিশ্চিত না করলে দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যে বড় ধরনের অস্থিরতা তৈরি হতে পারে। কারণ দেশের মোট আমদানি–রপ্তানির প্রায় ৯০ শতাংশই এই বন্দরের ওপর নির্ভরশীল।

সরকারের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ঝুঁকি নিরূপণে একটি পূর্ণাঙ্গ সিসমিক অডিটের কাজ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের সহায়তায় বন্দরের অবকাঠামোর নিরাপত্তা জোরদার করার পরিকল্পনা নেওয়া হবে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, “চট্টগ্রাম বন্দর শুধু একটি অর্থনৈতিক স্থাপনা নয়; এটি দেশের প্রাণরেখা। ভূমিকম্পের ঝুঁকি মোকাবিলায় এখনই প্রস্তুতি না নিলে ভবিষ্যতে এর মূল্য অনেক বেশি দিতে হতে পারে।”

প্রসঙ্গত, আজ শুক্রবার সকাল ১০টা ৩৮ মিনিটে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় তীব্র ভূমিকম্প অনুভূত হয়। কয়েক সেকেন্ডের দুলুনিতে মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে রাস্তায় নেমে আসে আতঙ্কে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা কেন্দ্র জানিয়েছে, ভূমিকম্পটির উৎপত্তিস্থল ছিল নরসিংদীর মাধবদীতে এবং উৎপত্তিস্থলে এর মাত্রা ছিল রিখটার স্কেলে ৫.৭।

সারা দেশে ভূমিকম্পে নিহত হয়েছেন ১০ জন এবং আহত হয়েছেন অন্তত ৬৫২ জন। এর মধ্যে রাজধানীর বংশালের কসাইটুলীতে পাঁচতলা ভবনের রেলিং ভেঙে নিচে পড়ে মুহূর্তেই ঝরে গেছে তিনটি প্রাণ। এদিকে মুগদার মদিনাবাগ এলাকায় নির্মাণাধীন ভবনের রেলিং ধসে পড়ে প্রাণ হারিয়েছেন এক নিরাপত্তাকর্মী।

নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে ভূমিকম্পের সময় একটি টিনশেড বাড়ির দেয়াল ধসে পড়ে এক বছরের শিশু মারা যায়। নরসিংদীর গাবতলী এলাকায় বাড়ির সানশেড ভেঙে প্রাণ হারায় শিশু ওমর (১০) এবং তার বাবা দেলোয়ার হোসেন উজ্জ্বল।

অন্যদিকে নরসিংদীর পলাশ উপজেলার মালিতা গ্রামে মাটির দেয়াল ধসে মারা গেছেন কাজেম আলী ভূঁইয়া (৭৫)। একই জেলার কাজীরচর নয়াপাড়ার নাসির উদ্দিন (৬৫) এবং শিবপুরের জয়নগর ইউনিয়নের ফরকান মিয়াও প্রাণ হারিয়েছেন।

আরও পড়ুন

এ সম্পর্কিত আরও

সর্বশেষ