২৫ অক্টোবর ২০২৫

ভয়ঙ্কর মাদক আইস’র বিস্তার ক্রমে বাড়ছে

সায়ীদ আলমগীর, কক্সবাজার »

ইয়াবার চেয়ে ভয়ঙ্কর মাদক ক্রিস্টাল মেথ (আইস)’র বিস্তার দেশে ক্রমে বাড়ছে। চাহিদা মেটাতে মিয়ানমার থেকে কক্সবাজার ও বান্দরবান সীমান্ত পেরিয়ে আসছে এ নেশাদ্রব্য। পাহাড়, সড়ক ও সাগর পথে আসা মাদকের চালান চট্টগ্রাম হয়ে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ছে। মাদক পাচারকারি সিন্ডিকেট কক্সবাজারকে ট্রানজিট হিসাবে ব্যবহার করছে আর ইয়াবার স্থলে বাড়াচ্ছে আইসের চালান। ইয়াবার মতো পরিবহনকারী ‘চুনোপুটি’ ধরা পড়লেও মূল পাচারকারি থাকছে ধরাছোঁয়ার বাইরে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দিনে দিনে বাড়ছে আইস আসক্তের সংখ্যা। শুরুতে রাজধানী কেন্দ্রিক ধনাঢ্য পরিবারের সন্তানদের মধ্যে আইসের চাহিদা থাকলেও এখন এর চাহিদা সব শ্রেণির মাদকসেবিদের। ঢাকার মতো দেশের অন্যান্য মহানগরীতেও তৈরি হচ্ছে আইস সেবনকারী শ্রেণি। চাহিদার কারণে এ মাদকের পাচারও বাড়ছে। আর তাতে ধরাও পড়ছে একের পর এক চালান।

মঙ্গলবার (১১ জানুয়ারি) সকাল ও সোমবার (১০ জানুয়ারি) রাতে ৬-৮ ঘণ্টার ব্যবধানে একদিনেই টেকনাফে আড়াই কেজি আইস জব্দ করেছে বিজিবি ও পুলিশ। দুই কেজি ৬৪ গ্রাম আইস জব্দ করলেও বিজিবি কাউকে আটক করতে পারেনি। কিন্তু পুলিশ ৫০০ গ্রাম আইসসহ দুই রোহিঙ্গা নারী-পুরুষকে আটক করে। এসময় তাদের কাছ থেকে ৫ হাজার ইয়াবাও জব্দ করা হয়। অপর অভিযানে আরো ৬০ হাজার ইয়াবা জব্দ করেছে টেকনাফ থানা পুলিশ।

টেকনাফ-২ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল শেখ খালিদ মোহাম্মদ ইফতেখার জানান, মঙ্গলবার ভোরে মাদকের একটি চালান টেকনাফের উত্তরে নোয়াখালীপাড়া এলাকায় মেরিন ড্রাইভের সমুদ্র সৈকতের ঝাউবাগানে মজুতের খবর পেয়ে বিজিবির একটি দল সেখানে অভিযান চালায়। তল্লাশি চালিয়ে একটি প্যাকেট থেকে দুই কেজি ৬৪ গ্রাম ওজনের আইস পাওয়া গেলেও কাউ ধরা যায়নি।

অপরদিকে, টেকনাফ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হাফিজুর রহমান জানান, সোমবার রাতে টেকনাফ পৌরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ডের পুরাতন পল্লান পাড়া এলাকায় বেগমের বাড়ি নামক ভাড়াবাসার হাসিনার বসতঘরে অভিযান চালিয়ে বালিশের ভেতর থেকে ৫০০ গ্রাম আইস ও পাঁচ হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়।

এ ঘটনায় টেকনাফের হ্নীলার লেদার ২৪ নম্বর ক্যাম্প এলাকার মৃত আবুল বাশারের ছেলে একরাম উদ্দীন (২৩) এবং উখিয়ার বালুখালী ১৮ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকার মৃত ফারুকের স্ত্রী মোছাম্মদ হাসিনাকে (৩০) গ্রেফতার করা হয়েছে। এসব বিষয়ে সংশ্লিষ্ট আইনে পৃথক মামলা হয়েছে বলে উল্লেখ করেন ওসি।

কক্সবাজারে বিজিবি, র‌্যাব, পুলিশ ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের হাতে আইসের বেশ কয়েকটি চালান ধরা পড়ে। সবকটি চালান এসেছে টেকনাফ সীমান্ত হয়ে মিয়ানমার থেকে। এর কয়েকটি চালান ধরা পড়ে চট্টগ্রাম ও ঢাকাতেও। কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রাম হয়ে ঢাকায় নেয়ার পথে মিনি ট্রাকের এয়ার কুলারে লুকিয়ে নেয়া দুই কেজি ওজনের ক্রিস্টাল মেথ উদ্ধার করে পুলিশ। গত অক্টোবরে এ ঘটনায় ট্রাকের চালক ও সহকারী গ্রেফতার হরেও মূল মালিক ধরা ছোয়ার বাইরে রয়েছে।

বিজিবির টেকনাফ-২ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল শেখ খালিদ মোহাম্মদ ইফতেখার জানান, মঙ্গলবারের ২ কেজির চালান ছাড়াও ২০২১ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ডিসেম্বর পর্যন্ত টেকনাফের স্থল ও নৌপথের সীমান্ত অতিক্রম করে আনা ৯ কেজি ২২১ গ্রাম ক্রিস্টাল মেথ (আইস) জব্দ করা হয়। গত এক বছরে সীমান্ত এলাকায় অভিযান চালিয়ে ৬১ লাখ ৩৪ হাজার ৩৯৯ পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়। এসব ঘটনায় বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন পাঁচ জন। এ বিষয়ে ৪২৯টি মামলায় ৪১৩ জনকে গ্রেফতার হলেও পলাতক রয়েছেন ৯জন। এসময়ে আরও অভিযানে ১৪ কেজি ৪৪৫ গ্রাম গাঁজা, ১৬৬ বোতল ফেনসিডিল, পাঁচ হাজার ৭৫১ ক্যান বার্মিজ বিয়ার, ৬৯৮ বোতল বিদেশি মদ, ২৩৮ লিটার চোলাই মদ জব্দ করা হয়। এসব ঘটনায় ৭২টি মামলায় গ্রেফতার হন ৩৭ জন আর দুইজন পলাতক। আর ৯৫ দশমিক ২৮ গ্রাম স্বর্ণ উদ্ধারের ঘটনায় তিনটি মামলায় একজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

অপরদিকে, টেকনাফ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) সহকারী পরিচালক সিরাজুল মুস্তফা মুকুল জানান, সদ্য বিদায়ী বছরে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর টেকনাফের বিশেষ জোন বিভিন্ন সময়ে অভিযান চালিয়ে দুই কেজি ৮৬৫ গ্রাম ক্রিস্টাল মেথ আইস জব্দ করে। এসময় ৯ লাখ ৪৮ হাজার ৯১ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট, পাঁচ কেজি ৭৬২ গ্রাম গাঁজা, ১২৬ বিয়ার ক্যান, ৮০ হাজার ৫৩৫ লিটার চোলাই মদ, ১৬ দশমিক ৮শ লিটার বিদেশি মদ ও ১ দশমিক ৪ কেজি সন্দিগ্ধ মাদকদ্রব্য উদ্ধার করা হয়।

কক্সবাজারে মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্র ‘নোঙ্গর’র নির্বাহি পরিচালক দিদারুল আলম বলেন, সব ধরণের মাদকের চালান জব্দকালে আটকরা বহনকারিই থাকে। এদের বিরুদ্ধে মামলা হয়ে কারাগারে গেলেও মূল মাদক ব্যবসায়ীরা আড়ালে থাকায় নতুন পরিবহনকারি সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে মাদক আসা বন্ধ না হয়ে উল্টো বাড়ছে।

কক্সবাজার সিভিল সোসাইটি ও চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজ’র সভাপতি আবু মোরশেদ চৌধুরী খোকা বলেন, মাদক দেশের সম্ভাবনাময় প্রজন্ম ধ্বংস করছে। তাই মাদকের বিস্তার রোধ করতে চাইলে মাদকের মূল কারবারিকে সনাক্ত করে আইনের আওতায় আনা খুবই জরুরি।

কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মো. হাসানুজ্জামান বলেন, যদিও শৃংখলা নিয়ন্ত্রণ ও নিরাপত্তা নিশ্চিতই পুলিশের মূল কাজ এরপরও মাদকের বিরুদ্ধেও জিরো টলারেন্স নীতি বজায় রাখছে পুলিশ। গত বছর দেশের সর্ববৃহৎ ইয়াবার চালান (প্রায় ১৮ লাখ) কক্সবাজার জেলা পুলিশ জব্দ করে। সেই মামলায় মূল মাদক কারবারিদেরই আইনের আওতায় আনা হয়েছে। একই ভাবে এখনো মাদক উদ্ধার ও মামলা করা হচ্ছে। সমাজের সর্বস্তরের লোকজন এগিয়ে না এলে শুধুমাত্র প্রশাসন একা কখনো মাদক নিয়ন্ত্রণ করতে পুরোপুরি সক্ষম হবে না। সামাজিক ও পারিবারিক ভাবেই মাদক ব্যবসায়ীদের বয়কট করতে হবে।

চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, কয়েকটি চালান উদ্ধারের তথ্য পর্যালোচনা করে নিশ্চিত হওয়া গেছে কক্সবাজার ও বান্দরবান সীমান্ত পথেই আইস ও ইয়াবা আসছে। এ ভয়ঙ্কর মাদক যাতে কোনভাবেই দেশে আসতে না পারে সে জন্য পুলিশসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে নির্দেশনা দেয়া আছে। চট্টগ্রাম, কক্সবাজার এবং বান্দরবানের সীমান্তবর্তী এলাকায় মাদক বিরোধী অভিযান জোরদার রয়েছে। বিভিন্ন সময় গ্রেফতার হওয়াদের জিজ্ঞাসাবাদ করে চক্রের মূলহোতা এবং তাদের সহযোগিদের ধরার উদ্যোগ চলছে।

মাদক আইস কি?

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর সূত্রমতে, ইয়াবায় এমফিটামিন থাকে পাঁচ ভাগ আর ক্রিস্টাল মেথ বা আইসের পুরোটাই এমফিটামিন। আইসে ইয়াবার মূল উপাদান এমফিটামিনের পরিমাণ অনেক বেশি থাকে। মানবদেহে ইয়াবার চেয়েও বহুগুণ ক্ষতি করে আইস। এটি সেবনের ফলে অনিদ্রা, অতি উত্তেজনা, স্মৃতিভ্রম, মস্তিষ্ক বিকৃতি, স্ট্রোক, হৃদরোগ, কিডনি ও লিভার জটিলতা এবং মানসিক অবসাদ ও বিষণ্নতার ফলে আত্মহত্যার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। শারীরিক ও মানসিক উভয়ক্ষেত্রে এটির নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে। এ মাদকের প্রচলনের ফলে তরুণ-তরুণীদের মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে ও অস্বাভাবিক আচরণ পরিলক্ষিত হয়। এ মাদকে আসক্ত হয়ে তরুণ-যুবকরা বিভিন্ন অপরাধে জড়িত হয়ে পড়ছে।

আরও পড়ুন