২৯ অক্টোবর ২০২৫

মানুষের মৃত্যু বিষাদের মধ্যে প্রকৃতিতে ফিরেছে প্রাণ

তারেক মাহমুদ »

প্রাণঘাতি করোনাভাইরাসের আতঙ্কে নীরব-নিস্তব্ধ হয়ে পড়েছে গোটা বিশ্ব। রাস্তায় নেই গণপরিবহণ, নেই লোকারণ্য। করোনা প্রতিরোধে সরকারী নির্দেশনায় মানুষ হয়ে পড়েছে গৃহবন্দী। তাই প্রকৃতিতে কমেছে দূষণের মাত্রা। বিশ্ব প্রকৃতি আস্তে আস্তে ফিরে পেতে শুরু করেছে তার নিজস্ব রুপ। কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে জলকেলি খেলছে ডলপিনের দল। সৈকতে নিশ্চিন্তে ডিম পাড়ছে লাখ লাখ অলিভ রিডলে কচ্ছপ। জনমানবশূন্য রাস্তায় দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে বুনো হরিণ, নীলগাই ও বিরল প্রজাতির সিভেট। নাগরিক দৃশ্যপট থেকে যে পশুপাখি বহুদিন আগে হারিয়ে গিয়েছিল সেই পশুপাখি যেন আবার নিজেদের জায়গা ‘ফিরে পেতে’ হাজির হয়েছে। মানুষের মৃত্যু বিষাদের মধ্যে প্রকৃতিতে ফিরেছে প্রাণ।

কক্সবাজারের স্থানীয়রা জানিয়েছেন, এক সপ্তাহ আগে হঠাৎ কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের কলাতলী পয়েন্টে ডলফিনের দেখা মেলে। ১০ থেকে ১২টি ডলফিনের এই দলটি উপকূলের একদম কাছে চলে আসে। এসময় উপস্থিত স্থানীয়রা পাড় থেকেই ডলফিনের খেলা উপভোগ করেন। একপর্যায়ে কলাতলীতে অবস্থানরত সাইমন বিচ রিসোর্টের এমডি মাহবুব রহমান রুহেল কৌতূহলবশত স্থানীয় সার্ফারদের সঙ্গে নিয়ে সাগরে নেমে পড়েন এবং কিছু ভিডিও চিত্র ধারণ করেন।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মনজুরুল কিবরয়া বলেন, ওই ভিডিওটি দেখেছি। সেখানে যে গোলাপি ডলফিনটি দেখা গেছে সেটি পূর্ণ বয়স্ক। ওই দলে থাকা অন্যগুলোও একই প্রজাতির- গোলাপি ডলফিন।

সেগুলো আরো বড় হলেই তাদের গায়ের রঙ গোলাপি হবে। এরা সচরাচর উপকূলের কাছাকাছি থাকে। তবে সৈকতের এতটা কাছাকাছি তারা আসে না। এখন নিরিবিলি থাকায় হয়ত কাছে চলে এসেছিল। বাংলাদেশে যেসব ডলফিন আছে তারমধ্যে এটি অন্যগুলোর চেয়ে কম দেখা যায়।

পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজার কার্যালয়ের উপপরিচালক শেখ মো. নাজমুল হুদা জানান, সাগরের প্রাকৃতিক পরিবেশ ডলফিনের জন্য সহায়ক ছিল না। তবে এখন সৈকত খালি হওয়াতে দূষণ কমে গেছে। অনুকূল পরিবেশ পেয়ে আবারো ফিরে আসছে ডলফিনরা। বালিয়াড়িতে ফুঠছে সবুজ লতা-পাতা। তাই আগামীতে সৈকতের জীব-বৈচিত্র্য রক্ষার্থে আলাদা জোন করার উপর গুরুত্বারোপ করেন এই কর্মকর্তা। 

এদিকে দ্য গার্ডিয়ান বলছে, করোনাভাইরাসে বিধ্বস্ত ইতালির ভেনিসের সমুদ্রতীরে বিশাল ক্রুজ শিপগুলো এখন আর এসে ভিড়ছে না। ফলে ভেনিসের ক্যানালগুলোতে আবার ডলফিন এসে খেলে বেড়াচ্ছে।

বিশ্বের সবচেয়ে বৃহত্তম কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতও বন্ধ থাকায় সেখানে ডলপিন ঝাঁকে ঝাঁকে লাফালাফি করছে। জাপানের নারা শহরের জনশূন্য রাস্তায় বিরল শিখা হরিণের দেখা মিলেছে।

পানামার সান পেলিপে শহরের সমুদ্রসৈকতের তীরে দেখা গেছে মাংসাশী প্রাণী রিকনের একটি দলকে। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া রাজ্যের ওকল্যান্ডের একটি স্কুলের মাঠে ঘুরে বেড়াতে দেখা গেছে টার্কি মুরগির ঝাঁক। থাইল্যান্ডের লোপবুরি শহরে পর্যটকদের আনাগোনা নেই।

এই সুযোগে সাবওয়েগুলো দখলে নিয়েছে বানরের দল। ভারতের রাস্তায় গাড়িঘোড়া নেই, মানুষের চলাচল নেই, দোকানপাট বন্ধ। ফলে পশুপাখি বহু দিন পর আবার স্বমহিমায় ফিরে এসেছে। ভারতীয় ফরেস্ট সার্ভিসের এক তরুণ কর্মকর্তা সুশান্ত নন্দা

গত কয়েকদিন ধরে তার টুইটার থেকে অবিরত পোস্ট করে চলেছেন এমনই অসাধারণ সব ছবি, যা রীতিমতো সাড়া ফেলে দিয়েছে গোটা বিশ্বে। অনুপ্রাণিত হয়ে গৃহবন্দি অনেক ভারতীয়ও তাদের ফ্ল্যাটের ব্যালকনি থেকে দুষ্প্রাপ্য প্রাণীদের আনাগোনার ছবি পোস্ট করতে শুরু করেছেন।

সুশান্ত নন্দা জানাচ্ছেন, লকডাউনের কারণে উড়িষ্যার উপকূলে অলিভ রিডলে কচ্ছপগুলো মানুষের নজর এড়িয়ে অনেক শান্তিতে ডিম পাড়তে পারছে। গহিরমাথা আর ঋষিকুল্যা সৈকতজুড়ে এবার প্রায় আট লাখ কচ্ছপ এসেছে, যার অর্থ ভারতের সমুদ্রতটে প্রায় ছয় কোটি অলিভ রিডলের ডিম।

কেরালার ওয়েস্টার্ন ঘাট পর্বত এক বিশেষ ধরনের ভামের বাসভূমি, যাদের নাম মালাবার লার্জ স্পটেড সিভেট। প্রায় ৩০ বছর আগে ১৯৯০ সালে এ অতিবিপন্ন প্রজাতির প্রাণীটিকে শেষবার দেখা গিয়েছিল। ধারণা করা হয়, মাত্র আড়াইশ’র মতো পূর্ণবয়স্ক সিভেট এই মুহূর্তে জীবিত আছে।

২৬ মার্চ কেরালার কালিকটের বন্ধ বাজারের মধ্যে একটি সিভেটকে রাস্তার মাঝখানে দেখা গেছে। উত্তরাখন্ড রাজ্যের দুই ব্যস্ত শহর হরিদ্বার আর দেরাদুনের বেশ কাছেই রাজাজি ন্যাশনাল পার্ক।

লকাডাউনে সবকিছু যখন সুনসান, হাইওয়েগুলো স্তব্ধ তখন সেই অভয়ারণ্য থেকে হাঁটতে হাঁটতে একপাল বড় শিংওয়ালা হরিণ চলে এসেছিল হরিদ্বার শহরে।

দেরাদুনে বাচ্চাদের ক্রিকেট খেলার মাঝে ঢুকে পড়ে তারা। চন্ডিগড়েও এক হরিণ দলকে শহরের রাস্তা পেরোতে দেখা গেছে। দক্ষিণ ভারতের বিখ্যাত তিরুপতি মন্দিরে যাওয়ার পাহাড়ি রাস্তায় এখন অবাধে বিচরণ করছে স্পটেড ডিয়ার বা চিতল হরিণের পাল।

দিল্লির সীমানাঘেঁষা শহর নয়ডার ব্যস্ততম এলাকা জিআইপি মল ও তার সংলগ্ন রাস্তা। বৃহস্পতিবার ফাঁকা সেই রাস্তায় ভরদুপুরে দাপিয়ে বেড়াল একটা বিশালদেহী নীলগাই (অ্যান্টিলোপ)।

আসাম ও অরুণাচল সীমান্তে পাসিঘাট ফরেস্ট এলাকায় নিশ্চিন্তে ও দুলকি চালে রেললাইন পেরোতে দেখা গেছে দাঁতাল হাতির বিশাল এক পালকেও।

বাংলাধারা/এফএস/টিএম

আরও পড়ুন