জিয়াউল হক ইমন »
চট্টগ্রামের বায়েজিদের বাসিন্দা মুহাম্মদ মঈন উদ্দিন আজমির। হঠাৎ তিনি জানতে পারেন ঢাকায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে হওয়া একটি মামলায় তার বিরুদ্ধে বায়েজিদ থানায় গ্রেফতারি পরোয়ানা এসেছে। পুলিশ-র্যাব তাকে গ্রেফতার করার জন্যে খুঁজছে। গ্রেফতার আতঙ্ক নিয়েই তিনি চলে যান ঢাকায়। কোর্টে গিয়ে মামলার কপি তুলে দেখতে পান, ওই মামলার আসামির তালিকায় নাম নেই তার।
এভাবেই বিচারকের স্বাক্ষর, সিল, স্মারক নম্বর সব নকল করে ‘ভুয়া’ গ্রেফতারি পরোয়ানা তৈরি করেছে একটি চক্র। যে চক্র মানুষকে হয়রানি করে এবং ফাঁদে ফেলে নানাভাবে প্রতারণা করে। এমনভাবে চক্রটি নকল করছে যে, তদন্ত ছাড়া খোদ পুলিশও বুঝতে পারছেনা আসল নকলের পার্থক্য। আর এ চক্রের কারণে পুলিশের বিরুদ্ধে উঠছে নানা সময়ে প্রতারণার অভিযোগ।
জানা যায়, ২০২০ সালের ১৪ জুন ডিএমপির খিলগাও থানায় দায়ের করা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে একটি মামলা (৩৭২/২১) দায়ের হয়। ওই মামলার প্রাথমিক তথ্য বিবরণীতে নাম ছিলনা ভুক্তভোগী আজমিরের। এমনকি ২০২১ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি আদালতে দাখিল করা অভিযোগ পত্রেও ছিলনা তার নাম।
এর আগে এরকম ১৪টি ভুয়া গ্রেফতারি পরোয়ানা তথ্য উল্লেখ করে কোতোয়ালি থানায় মামলা করে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতের নাজির আবুল কালাম আজাদ।
ভুক্তভোগী মুহাম্মদ মঈন উদ্দিন আজমির বলেন, ‘গত ৮ জুলাই। কোরবানির তখনও দুইদিন বাকি। আমি জানতে পারি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ঢাকার একটি মামলায় বায়েজিদ থানায় আমার নামে একটি গ্রেফতারি পরোয়ানা এসেছে। থানায় একজন লোক পাঠিয়ে আমি ব্যাপারটি জানার চেষ্টা করে দেখলাম, সত্যিই ওয়ারেন্ট এসেছে। এরপর আমাকে পুলিশ খোঁজা শুরু করে। এর ফলে আমি পারিবারিক চাপে পড়ে যাই এবং মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়ি। একপ্রকার গ্রেফতার আতঙ্কে দিন পার করতে থাকি, এই বুঝি আমাকে এরেস্ট করল।’
তিনি বলেন, ‘পরে আমি ঢাকায় গিয়ে ওয়ারেন্ট অনুযায়ী মামলার কপি তুলে দেখি মামলার কোথাও আমার নাম নেই। অথচ ওই মামলায় আমার নামে ওয়ারেন্ট কপি আসছে। যে মামলার আমি কোন আসামিই না।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (প্রসিকিউশন) মো. কামরুল হাসান বাংলাধারাকে বলেন, ‘আমরা যারা প্রসিকিউশনে কাজ করি, চেষ্টা করি যেন ওয়ারেন্টগুলো যথাযথভাবে থানায় পৌঁছায়। দেখা গেলো, ঢাকা বা অন্য জেলা থেকে একটি ওয়ারেন্ট আওছে। কিন্তু ওয়ারেন্টটা তাৎক্ষণিকভাবে যাচাই করার কোনো সুযোগ থাকে না। ইদানীং একটা অর্ডার এসেছে যে, ওয়ারেন্টটি কোন আদালত ইস্যু করেছে সে আদালতের নাম বা পেশকারের নাম এবং নম্বর যেন থাকে। তাহলে আমরা যাচাই বাছাই করতে পারব।’
তিনি বলেন, ‘একটি সংঘবদ্ধ চক্র ভুয়া ওয়ারেন্ট বানিয়ে হয়রানির কাজ করে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। এটা আজকের কোন ইস্যু না কিন্তু। এটা নিয়ে আমরা পুলিশরাও কাজ করছি এবং সামনে আরও ডিজিটালাজ্ড হচ্ছে। সামনে এ ধরণের প্রতারণা কমে আসবে। এরকম কম-বেশি অভিযোগ আমরা এর আগেও পেয়েছি। আমরা চক্রটিকে খুঁজে বের করার চেষ্টা চালাচ্ছি।’
চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট জিয়া উদ্দিন বাংলাধারাকে বলেন, ‘এই সিন্ডিকেট কিন্তু জানে যে কাকে পাঠানো হচ্ছে এই ভুয়া ওয়ারেন্টটা। আসামির আর্থিক অবস্থা এবং যাবতীয় সবকিছুর তথ্য তাদের কাছে থাকে। এভাবে নিরীহ মানুষদের ভুয়া ওয়ারেন্টের মাধ্যমে ডেকে এনে বলে, আপনার মামলা আছে। আমরা জামিনের আবেদন করিয়ে দিব। আপনি চিন্তা করিয়েন না। এভাবে নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা দাবি করে তারা সেই টাকা আত্মসাৎ করে।’
তিনি বলেন, ‘এর সাথে আমাদের কোর্টগুলোর কর্মচারিও জড়িত আছে। এ বিষয়ে আমি মনে করি যে, সবার সমন্বিত প্রচেষ্টা থাকতে হবে। এরকম ভুয়া ওয়ারেন্টের ব্যাপারগুলো আমিও বহুবছর ধরে দেখছি। তবে এই ভুয়া ওয়ারেন্ট যখনই আসে এটা কোন কোর্ট থেকে ইস্যু হইছে বিষয়টা তদন্ত হওয়া দরকার। এরপরই প্রকৃত ঘটনা বেরিয়ে আসবে।’
বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস্ ফাউন্ডেশ চট্টগ্রাম শাখার সভাপতি অ্যাডভোকেট জিয়া হাবিব আহসান বলেন, ‘নিরপরাধ লোক জেলে যাওয়া মানেই সেটা মানবাধিকার লঙ্ঘন। এজন্য আমাদেরকে রাষ্ট্র, আইন কর্মকর্তা, পুলিশ, সাংবাদিক সবাইকে সচেতন হতে হবে। আমাদের দেশ কিন্তু পুরোপুরি ডিজিটাল হতে পারেনি। যে ওয়ারেন্টগুলো কোর্ট থেকে জারি হয় সেগুলো যদি অনলাইনে ডাটাবেইজের মাধ্যমে প্রকাশ করা যায় তাহলে একটা ওয়ারেন্ট থানায় যখন যায় সেটা চেক করে দেখতে পারে। এখন দেখা যায় সিল স্বাক্ষর নকল করে ভুয়া সিল ছাপ্পর মেরে কিছু জাল ওয়ারেন্ট ইস্যু করা হয়।’
জিয়া হাবিব আহসান বলেন, ‘এই ওয়ারেন্ট গুলা একটা চক্র করে থাকে। এই কারসাজির সাথে অভ্যন্তরীন লোকরাই জড়িত। কারণ একটা ওয়ারেন্ট ৪-৫ টেবিল পার হয়ে যাচ্ছে। কোনো না কোন জায়গায় এটা ধরা পড়ার কথা। কিন্তু এটা ধরা না পড়ে কিভাবে একজন নিরীহ লোককে পুলিশ ধরে নিয়ে আসছে? এর যাচাই বাছাই হচ্ছে না। এজন্য আমি মনে করি এটা ডিজিটালাইজড হওয়া দরকার।’
বাংলাধারা/আরএইচআর













