২৬ অক্টোবর ২০২৫

মিরসরাই পাহাড়ের কান্না যেন মৃত্যুফাঁদ

শাহ আব্দুল্লাহ আল রাহাত »

বর্ষার মৌসুমে শ্রাবণের ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে পাহাড়ের কান্না আরো ভীষণ হয়ে রুপসি ঝর্ণায় গিয়ে ঠেকে। প্রকৃতিপ্রেমী মানুষগুলো বরাবরই ছুটে যায় রুপসী ঝর্ণার রুপের উপভোগে ভাগ বসাতে। তবে বিষাদের ঘনঘটা বেজেই চলছে মৃত্যুফাঁদে।

চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের এসব ঝর্ণাগুলো যেন ভয়ংকর মরণফাঁদ। এখানে ধারাবাহিক ঘটছে একের পর এক দুর্ঘটনা।

ইউনিভার্সিটি পড়ুয়া থেকে শুরু বহু চাকুরীজীবির তাজা প্রাণ ঝরে গেছে এসব রুপসী ঝর্ণায়। পর্যটকদের অসতর্কতায় এবং পর্যটন স্পট তৈরি না হওয়ায় ঘটেছে ভয়াবহ দুর্ঘটনা। অনেকে প্রাণে বেঁচে ফিরলেও বরণ করছেন পঙ্গুত্ব! তবে মৃত্যুর মিছিলে যোগ দিয়ে ঝরে গেছে এসব রুপসী ঝর্ণায় বেড়াতে আসা অনেক উদ্যোমী তরুণের প্রাণ।

গত ৫ বছর কিংবা ১৮২৫ দিন হিসাব করে জানা যায়, মিরসরাইয়ের বিভিন্ন ঝর্ণায় ঘুরতে এসে প্রাণ হারিয়েছেন ১১ জন পর্যটক। তাছাড়া আহত হয়েছেন শতাধিক পর্যটক। এদের মধ্যে কেউ কেউ হয়েছেন গুরুতর আহত।

গত ৪ মাস কোভিড-১৯ মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়লে নিষিদ্ধ হয়ে পড়ে ঝর্ণাগুলোতে পর্যটকদের আগমত। কিন্তু লক ডাউন শেষে ধীরে ধীরে পর্যটকদের আনাগোনা আবার বাড়তে থাকে ব্যাপকভাবে। তবে লক ডাউন শেষ হওয়ার পর গত ৩০ দিন ধরে এসব রূপসী ঝর্ণায় উপভোগের ভাগ বসাতে ভিড় করছেন হাজারো ঝর্ণা প্রেমীরা।

সারা দেশে পাহাড়ের কান্না উপভোগ করার জন্য পর্যটকের কাছে অতিপরিচিত চট্টগ্রামের মিরসরাই। নিয়মিত দেশের নানা প্রান্ত নানান বয়সী মানুষ ভীড় জমান এখানে। তবে সেই ভীড়ের মাত্রা আরো প্রকট হয় সাপ্তাহিক ছুটি কিংবা মাসিক ছুটিতে।

মিরসরাই উপজেলার খৈইয়াছড়া, নাপিত্তাছড়া, সহস্রধারা, মহামায়া, বাওয়াছড়া, রূপসী ঝর্ণা, বোয়ালিয়া ঝর্ণা, হরিণাকুন্ড ঝর্ণা, সোনাইছরি ঝর্ণাগুলো অপরুপতা পর্যটকদের আকৃষ্ট করছে বারবার। তবে ঘুরতে আসা মানুষগুলোর অসতর্কতার কমতি নেই। সামান্য অসতর্কতায় ঘটেছে ভয়ংকর সব দুর্ঘটনা।

স্থানীয়রা জানিয়েছেন, সাবধানতা মেনে চললে কিংবা সর্তকতা অবলম্বন করে চললে ঝর্ণায় দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব। তাই নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাসহ বেশ কিছু বিষয়ে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেন স্থানীয় প্রশাসন। নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছাড়া ইচ্ছেমতো গহীন জঙ্গলসহ বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে এলোমেলোভাবে বেড়াতে গিয়ে ছিনতাইয়ের কবলে পড়ছেন অনেকেই। এর জন্য অনেকেই দর্শনার্থীদের দায়িত্বহীনতা ও অসংযত আচরণকে দায়ী করছেন।

সর্বশেষ গত ৪ সেপ্টেম্বর দুপুরে উপজেলার খৈইয়াছড়া ইউনিয়নের আট স্তর বিশিষ্ট খৈইয়াছড়া ঝর্ণার উপর থেকে প্রায় ৩‘শ ফুট নীচে পড়ে নিহত হয়েছেন ফয়েজ আহমেদ প্রকাশ খাজু (৩৯)। তিনি ফেনী পৌরসভার বড়াইপুর গ্রামের মো. ইদ্রিসের ছেলে। গত শুক্রবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় নিহতের লাশ পাহাড়ের গভীর থেকে উদ্ধার করা হয়। তিনি পেশায় একজন ব্যবসায়ী।

গত বছরের ১৫ আগস্ট উপজেলার বড় কমলদহ রূপসী ঝর্ণায় কূপে ডুবে নিহত হয় মেহেদী হাসান প্রান্ত (২১)। মেহেদী হাসান নাটোর জেলার নাটোর উপজেলার জালালাবাদ গ্রামের মো. নুরুল আমিনের ছেলে। একই বছরের ২৬ জুলাই খৈইয়াছড়া ঝর্ণা দেখতে এসে ঝর্ণার উপর থেকে পা পিছলে পড়ে নিহত হয়েছেন আবু আল হোসাইন মেমোরী (২৯)। তার বাড়ি বগুড়া জেলার সদর থানায়। তিনি ঢাকার টিকাটুলি এলাকায় সেইফটি কনসালটেন্ট বিডি প্রতিষ্ঠানের আর্কিটেকচার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

একই বছর ২৮ জুন খৈইয়াছড়া ঝর্ণায় আনোয়ার হোসেন নামে এক পর্যটক উপর থেকে পড়ে নিহত হন। তিনি ফেনী সদরের আব্দুল মজিদের ছেলে। একই বছরের ২ এপ্রিল খৈইয়াছড়া ঝর্ণার উপর থেকে পড়ে মো. আশরাফ হোসেনের (৩০) মৃত্যু হয়েছে। নিহত আশরাফ ফটিকছড়ি উপজেলার জাফরনগর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মৃত নাজিম উদ্দিনের ছেলে। ১৭ জুলাই মহামায়া লেকে পানিতে ডুবে নিখোঁজ হয় শাহাদাত হোসেন (২২) নামে এক যুবক। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ১৯ জুলাই পানিতে খুঁজে শাহদাতকে মৃত অবস্থায় উদ্ধার করে। তার বাড়ি মিরসরাই উপজেলার সদর ইউনিয়নে।

২০১৮ সালের ১৫ আগস্ট নয়দুয়ারিয়ার নাপিত্তাছড়া ঝর্ণার কূপে ডুবে অনিমেষ দে (২৭) নামে এক পর্যটকের মৃত্যু হয়েছে। তিনি ফটিকছড়ি উপজেলার নিরঞ্জন দে’র ছেলে। একই বছরের ২৪ আগস্ট বড়কমলদহ রূপসী ঝর্ণায় উপর থেকে পড়ে নিহত হন সাইফুল ইসলাম নামে এক যুবক। তার বাড়ি সীতাকুন্ড উপজেলার বাঁশবাড়িয়া এলাকায়।

২০১৭ সালের ১০ নভেম্বর উপজেলার নাপিত্তছড়া ঝর্ণায় সাঁতার কাটার সময় চট্টগ্রাম প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএ শিক্ষার্থী শাহাদাত হোসেন মামুন (২২) মৃত্যু হয়। তিনি ফেনী জেলার শৈর্শদী এলাকার মতিউর রহমানের ছেলে।

জানতে চাইলে খৈইয়াছড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জাহেদ ইকবাল চৌধুরী বলেন, মূলত দায়িত্বহীনতা ও অসাবধানতার কারণে দুর্ঘটনা ঘটে। অনেকে ঝর্ণার উপরে উঠে সেলফি তুলতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে যায়। আমি ঘুরতে আসা পর্যটকের বিনীত অনুরোধ করবো আপনার সতর্ক হোন। নিজের জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলবেন না।

মিরসরাই ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্সের স্টেশন অফিসার মো. তানভির আহম্মদ বলেন, ঝর্ণাগুলোতে প্রশাসনের নজর দেয়া প্রয়োজন। পর্যটকদের গাইড দিতে হবে কোন স্থানে গেলে দুর্ঘটনা ঘটবে, কোন স্থানে গেলে নিরাপদ তাহলে দুর্ঘটনা রোধ করা সম্ভব হবে। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলো চিহ্নিত করে সেসব স্থানে উঠা নিষেধ অথবা সতর্কতামূলক সাইনবোর্ড টাঙ্গিয়ে দিলে কিছুটা ঝুঁকিমুক্ত হওয়া সম্ভব।

মিরসরাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ রুহুল আমিন বলেন, মিরসরাইয়ের বিভিন্ন পাহাড়ে সৃষ্ট ঝর্ণা দেখতে ছুটে আসেন শত শত পর্যটক। আমরা পর্যটকদের সতর্ক করে সাইনবোর্ডে অনেক নির্দেশিকা লিখে দিয়েছি। পাশাপাশি গাইডের ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু পর্যটকরা নির্দেশনা মানছেন না। ফলে দুর্ঘটনা ঘটছে। আমরা আবারো উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে দুর্ঘটনায় নিহত পর্যটকদের ছবি দিয়ে শীঘ্রই সর্তকতামূলক সাইনবোর্ড টাঙাবো।

মিরসরাই রুপসী ঝর্ণার কান্নার সাথে মানুষের কান্না ও যেন দিন দিন দীর্ঘ হয়েছে। পাহাড়ের কান্নায় যেন জমে আছে মৃত্যুফাঁদ। তবে সর্তকর্তা কিংবা সচেতনা এবং সংযত আচরণের মাধ্যমে কমিয়ে আনা যাবে এসব ভয়ংকর সব দুর্ঘটনা।

বাংলাধারা/এফএস/এএ

আরও পড়ুন