সাদমান সময় »
১২ বছর বয়সে জাহানারা হারিয়েছেন বাবা, চাচা, ফুফাতো ভাই। পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র আলাউদ্দিন হয়েছেন পিতৃহারা। রৈয়ছা বেগম হারিয়েছিলেন স্বামী। অগ্নিসংযোগে পুড়ে মারা যান জোবায়দা খাতুন। সভ্রম হারান সালমা-হাজেরা। সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ হন গ্রামের টগবগে তরুণ বজলুর রহমান। পাকিস্তানি জান্তাদের গুলিতে আহত নুরুল আলম এখনো সেই দুঃসহ স্মৃতি ভয়ে বেড়ান।
১৯৭১ এর ২০ এপ্রিল বড়তাকিয়ার সৈদালী গ্রামে পাকিস্তানী যান্তাদের হত্যাযজ্ঞে প্রাণ হারান ২২ জন নিরস্ত্র বাঙালী। স্বাধীনতার ৫০ বছর পার হয়ে গেলেও এখনো চিহ্নিত করা হয়নি এসব গণকবর। স্থাপন করা হয়নি স্মৃতিস্তম্ভ। যা নিয়ে ক্ষোভ আর হতাশার কথা ব্যক্ত করেছেন সৈদালী গ্রামের মানুষ ও শহীদ পরিবারের সদস্যরা।
এদিকে ২০১৭ সাল থেকে সৈদালী নাগরিক ফোরাম নামে একটি সংগঠন ২০ এপ্রিল দিনটিকে সৈদালী গণহত্যা দিবস হিসেবে পালন করে আসছে। সংগঠনটির নেতাদের দাবি অচীরেই সৈদালী গণহত্যা দিবসকে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি দিতে হবে।
২০১৭ সালের তৎকালীন উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ইয়াছমির আক্তার কাকলী জানিয়েছিলেন, উপজেলা প্রকৌশলী ও স্থানীয় মায়ানী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানকে নিয়ে তারা ঘটনাস্থল (সৈদালী গ্রাম) পরিদর্শন করেছেন। উপজেলা পরিষদের উদ্যোগে এডিপি’র অর্থায়নে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগের তত্ত্বাবধানে গ্রামে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এছাড়া গ্রামের গণকবরগুলো চিহ্নিত করার প্রক্রিয়াও হাতে নেয়া হবে। কিন্তু বাস্তবে তা আর দেখা মেলেনি।
সৈদালী নাগরিক ফোরামের সাধারণ সম্পাদক নাট্য নির্দেশক মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ জানান, ‘১৯৭১ সালের ২০ এপ্রিল বিকাল ৩টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী গ্রামে ঢুকে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালায়। এসময় গ্রামের ২২জন নীরিহ নারী-পুরুষকে গুলি করে পুড়িয়ে হত্যা করে তারা। অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে পুরো গ্রামকে বিরাণ ভূমিতে পরিণত করে পাক সেনারা। ওই সময় ধর্ষণের শিকার হন গ্রামের দুই গৃহবধূ। এছাড়া এলাকার একটি সম্মুখ যুদ্ধে গ্রামের একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।’
তিনি বলেন, ‘সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদনের মাধ্যমে প্রচার পাওয়ায় ঘটনাটি সরকারের দৃষ্টিগোচর হয়েছে। আমরা সৈদালীবাসী খুবই খুশি হয়েছিলাম। কিন্তু দুঃখের বিষয় কোন অজানা কারণে আজও নির্মাণ হয়নি একটি স্মৃতিস্তম্ভ, চিহ্নিত হয়নি গণকবর। আমাদের দাবি সেদিনের গণহত্যায় নিহত ২২ জনের পরিবারকে যেন শহীদ পরিবারের স্বীকৃতি দেয়া হয়।’
সেদিনের ৫ ঘন্টার নারকীয় তান্ডব:
প্রত্যক্ষদর্শী, নিহতদের স্বজন ও স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ১৯৭১ সালের ২০ এপ্রিল চট্টগ্রাম থেকে পাক আর্মির একটি বিশাল গাড়ি বহর ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক হয়ে (তৎকালীন ট্রাংকরোড) বড়তাকিয়া বাজার অতিক্রম করার খবরে কর্ণেল অলি আহম্মদের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা স্থানীয় ফেনাফুনি পুলের নীচে প্রতিরোধ দুর্গ গড়ে তোলে। ওইদিন সকাল ১১টার নাগাদ পাকিস্তানী বাহিনীর গাড়িবহর বড়তাকিয়া বাজার অতিক্রম করার সময় লুকিয়ে থাকা মুক্তিসেনারা আক্রমণ চালায়। থেমে থেমে বিকাল আড়াইটা পর্যন্ত চলে প্রতিরোধযুদ্ধ। পরে মুক্তিযোদ্ধাদের গোলাবারুদ ফুরিয়ে গেলে তাঁরা পিছু হটতে বাধ্য হন। এ প্রতিরোধ যুদ্ধে শহীদ হন হাবিলদার সিদ্দিক ও ল্যান্স নায়েক আবুল কালাম। অবশ্য ওই যুদ্ধে দুইশ থেকে আড়াইশ পাক আর্মি হতাহত হয়। মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্থ হয় তাদের বহনকারী সম্মুখভাগে থাকা ১০-১২টি গাড়ি।
পরে বিকাল ৩টার দিকে ক্ষুদ্ধ হানাদার বাহিনী প্রতিশোধপরায়ন হয়ে বড়তাকিয়া বাজারের পশ্চিম পাশের চারটি সড়ক হয়ে প্রবেশ করে সৈদালী গ্রামে। সেখানে তারা ঘরে ঘরে চালায় নারকীয় তান্ডব। ওইদিন রাত আটটা পর্যন্ত পাঁচ ঘন্টার তান্ডবে নিহত হন গ্রামের ২২জন নীরিহ নারী পুরুষ। ধর্ষণের শিকার হন দুই গৃহবধূ। লুটতরাজ শেষে জ্বালিয়ে দেয়া হয় গ্রামের শতাধিক ঘরবাড়ি। সেদিনের সে ঘটনায় নিহত ২২ জনের মধ্যে ২১জনকে গ্রামের ভূঁইয়া পুকুরপাড়, লতু পুকুরপাড় ও বিভিন্ন জমির গণকবরে সমাহিত করা হয়েছে। অন্য একজনের লাশ খুঁজে পায়নি স্বজনেরা।
গণহত্যায় নিহত হয়েছেন যারা:
২০ এপ্রিল সৈদালী গণহত্যার ঘটনায় নিহতরা হলেন- গ্রামের হামিদ উল্লার ছেলে মোখলেছুর রহমান, মতিউর রহমানের ছেলে আবুল কালাম হোরা মিয়া, আব্দুর রশিদের ছেলে আমীর হোসেন, আব্দুর রাজ্জাকের ছেলে খোরশেদ আলম, নুরুল হক নুনুুর ছেলে মকছুদ আহম্মদ, জিন্নাত আলী মিস্ত্রীর দুই ছেলে নজির আহম্মদ ও সুলতান আহম্মদ, আব্দুল হক মাষ্টারের ছেলে কবীর উদ্দিন, মোকাররম আলীর ছেলে শেখ আহম্মদ, আব্দুল গণির ছেলে আব্দুল মালেক, আব্দুল জব্বারের মেয়ে জোবায়দা খাতুন, আব্দুল লতিফের ছেলে তমিজ উদ্দিন, কেরামত আলীর ছেলে হাকীম বক্স, মোহাম্মদ ইসমাঈল মিয়ার ছেলে বেদন আলী, আব্দুল জব্বারের ছেলে জায়দ আলী, আহম্মদুর রহমান ভূঁইয়ার দুই ছেলে সামসুল আলম ও নুরুল আলম, আনোয়ার হোসেনের ছেলে ফকির আহম্মদ, আব্দুল লতিফের ছেলে রহীম বক্স, বদিউর রহমানের ছেলে আব্দুর রশিদ, মোকলেছুর রহমান মিস্ত্রীর ছেলে মফিজুর রহমান, খলিলের রহমান মৌলভীর ছেলে হোসেনের জামান ও দলিলের রহমানের ছেলে মুক্তিযোদ্ধা বজলুর রহমান।
বাংলাধারা/এফএস/এআর