২৬ অক্টোবর ২০২৫

মুক্তি পায়নি অনুদানের অর্ধেকের বেশি সিনেমা

বাংলাধারা  ডেস্ক » 

সরকারি অনুদান নিয়ে সিনেমা না বানানোর ঘটনায় চলচ্চিত্র নির্মাতা ও কবি টোকন ঠাকুরের গ্রেপ্তারের বিষয়টি আলোচনা তৈরি করেছে দেশের সংস্কৃতি অঙ্গনে। এদিকে তথ্য মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানিয়েছে, সরকারি অনুদান নিয়ে অর্ধেকের বেশি সিনেমা এখনো মুক্তি পায়নি। ২০০৭ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত মোট ৪১টি চলচ্চিত্রের জন্য অনুদান দেওয়া হয়েছে। কিন্তু মুক্তি পেয়েছে মাত্র ১৫টি ছবি।

চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সিনেমা নির্মাণ করতে না পারার জন্য গ্রেপ্তার হওয়ার বিষয়টি সমর্থনযোগ্য নয়, তবে সিনেমা নির্মাণ করতে না পারার জন্য অবশ্যই জবাবদিহিতা কঠোর হওয়া উচিত।

২০১২-১৩ অর্থবছরে ‘কাঁটা’ নামের একটি সিনেমা নির্মাণের জন্য অনুদান পেয়েছিলেন টোকন ঠাকুর। সেই সিনেমার কাজ সাত বছরেও শেষ করতে পারেননি তিনি। সরকারি টাকা তছরুপের অভিযোগে গত ৩ অক্টোবর তথ্য মন্ত্রণালয়ের মামলায় টোকন ঠাকুরের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয় এবং রবিবার গ্রেপ্তার হন তিনি। সোমবার জামিন পেয়েছেন টোকন।

টোকন বলেন, ‘আমার সিনেমা যেহেতু একটা পিরিয়ডিক্যাল সিনেমা ফলে সময় লাগছিল। মন্ত্রণালয় থেকে ১০ লাখ টাকা নিয়ে কাজ শুরু করলেও ছবিটির বাজেট কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। তো এত টাকা জোগাড় করা আবার পিরিয়ডিক্যাল ফিল্মের সময়টাকে ধারণ করার জন্যও আমার সময় লাগছিল। ছবিটির কাজ ইতিমধ্যেই প্রায় শেষ করে এনেছি। সর্বশেষ বিষয়টি আমি মন্ত্রণালয়কে ইনফর্মও করেছিলাম। কিন্তু প্রসেসিং করতে করতেই করোনা চলে এলো। এই সব কারণে সময়ক্ষেপণ হয়। কিন্তু আমি বুঝতে পারি নাই যে মন্ত্রণালয়ের মামলাও দ্রুত গতিতে চলছে। সে যাই হোক, এখন একটা সমাধানের পথে চলে এসেছি। আইনের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বাকি কাজটা শেষটা করে শিগগিরই জমা দেব।’

সরকারের চলচ্চিত্র অনুদান নীতিমালা অনুযায়ী, অনুদান পাওয়ার ৯ মাসের মধ্যে সিনেমা মুক্তি দেয়ার বাধ্যবাধকতা থাকলেও কোনো কোনো সিনেমা ৭/৮ বছরেও নির্মাণকাজ শেষ করতে পারেননি নির্মাতারা।

চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দিন ইউসুফ বলেন, “চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য অনুদান নিয়ে ঠিক সময়ে সিনেমার নির্মাণকাজ শেষ করতে না পারার জন্য অবশ্যই নির্মাতাকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। তবে এর জন্য নির্মাতাকে গ্রেপ্তার করার ঘটনাকে সমর্থন করি না।”

অনুদানের টাকার পরিমাণ কম থাকার কথা উল্লেখ করে নাসির উদ্দিন ইউসুফ বলেন, ‘টোকন ঠাকুর যখন অনুদান পেয়েছে, তখন টাকার পরিমাণ খুবই কম ছিল। ৩৫ লাখ টাকা ছিল। সেই টাকা দিয়ে পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমার নির্মাণকাজ শেষ করা আসলেই কঠিন। পরে টোকনকে নানা রকম স্ট্রাগল করতে হয়েছে। এখন অনুদানের টাকা বাড়িয়ে ৭৫ লাখ করা হয়েছে। এখন মনে করি অনুদানের টাকা দিয়ে সিনেমা নির্মাণ সম্ভব। ফলে মন্ত্রণালয়ের উচিত, অনুদান দেয়ার পাশাপাশি সিনেমা নির্মাণের বিষয়টিও জবাবদিহিতার আওতায় আনা, এর জন্য কঠোর হওয়া। কিন্তু গ্রেপ্তার করার বিষয়টি সমর্থন যোগ্য নয়। টোকন ঠাকুর তো পালিয়ে যায়নি। তাকে গ্রেপ্তারের বিষয়টি সমর্থন করি না। যত দূর জানি, সে সিনেমাটির নির্মাণকাজ শেষও করে ফেলেছে।”

২০১২-১৩ অর্থবছরে কাঁটা ছবির সঙ্গে অনুদান পাওয়া অন্য ছবিগুলোর মধ্যে একাত্তরের মা জননী, একাত্তরের ক্ষুদিরাম, মেঘমল্লার’ ও খাঁচা মুক্তি পেয়েছে। কিন্তু তারেক মাসুদের মৃত্যুর পর ‘কাগজের ফুল’ সিনেমাটির নির্মাণ আটকে যায়। পরে ছবিটির প্রযোজক ক্যাথরিন মাসুদ অনুদানের অর্থ মন্ত্রণালয়ে ফেরত দিতে চাইলে মন্ত্রণালয় থেকে তাকে সিনেমাটি শেষ করার জন্য অনুরোধ করা হয়। এ ছাড়া নার্গিস আক্তারের পরিচালনায় ‘যৈবতী কন্যার মন’ ছবির কাজ শেষ হলেও মুক্তি পায়নি।

১৯৭৬-৭৭ সাল থেকে বাংলাদেশ সরকার চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য অনুদানের প্রথা চালু করে। মাঝখানে বেশ কয়েক বছর বন্ধ থাকার পর ২০০৭-০৮ অর্থবছর থেকে নিয়মিত চলচ্চিত্রে অনুদান প্রদান করা হচ্ছে। বর্তমানে পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমার জন্য ৭৫ লাখ এবং স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনেমার জন্য ২০ টাকা অনুদান দেওয়া হচ্ছে।

১৯৭৬ সালে অনুদান পাওয়া বেবী ইসলামের মেহেরজান এখনো মুক্তি পায়নি। ২০০৭-০৮ অর্থবছরে এনামুল করিম নির্ঝর পরিচালিত ‘নমুনা’ সিনেমাটি মুক্তি পায়নি। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে জুনায়েদ হালিম পরিচালিত ‘স্বপ্ন ও দুঃস্বপ্নের গল্প’ সিনেমাটি মুক্তি পায়নি। ২০১০-১১ অর্থবছরে মির্জা সাখাওয়াৎ হোসেনের ধোকা, ফারুক হোসেনের কাকতাড়ুয়া মুক্তি পায়নি।

২০১১-১২ অর্থবছরে ‘নেকড়ে অরণ্য’ সিনেমার জন্য প্রথম কিস্তির টাকা গ্রহণ করার পরও ছবির কাজ শুরু করতে না পারায় মারুফ হাসান আরমানের বিরুদ্ধে মামলা করে তথ্য মন্ত্রণালয়। শিশুতোষ ছবি ‘একা একা’ জন্য অর্থ বরাদ্দ পেয়েছিলেন সৈয়দ সালাহউদ্দিন জাকী। ছবি নির্মাণ না করায় গুণী এই নির্মাতার বিরুদ্ধেও অর্থ আদায়ের জন্য মামলা করেছে তথ্য মন্ত্রণালয়। অন্যদিকে পাঁচ বছরেও মুক্তি পায়নি প্রশান্ত অধিকারী পরিচালিত ‘হাডসনের বন্ধুক’।

২০১৩-১৪ অর্থবছরে অনুদান পাওয়া ছবির মধ্যে ড্যানি সিডাক পরিচালিত ‘কাঁসার থালায় রুপালি চাঁদ’ মুক্তি পায়নি। ২০১৪-১৫ অর্থ বছরে নূরুল আলম আতিক পরিচালিত ‘লাল মোরগের ঝুঁটি’, এন রাশেদ চৌধুরী পরিচালিত ‘চন্দ্রাবতী কথা’, মাহমুদ দিদার পরিচালিত ‘বিউটি সার্কাস’ মুক্তি পায়নি। ২০১৫-১৬ অর্থ বছরে এস ডি রুবেল পরিচালিত ‘বৃদ্ধাশ্রম’, কামার আহমাদ সাইমনের ‘শঙ্খধ্বনি (শিকলবাহা)’ মুক্তি পায়নি।

২০১৬-১৭ অর্থবছরে ‘নোনাজলের কাব্য’, ‘রূপসা নদীর বাঁকে’, ‘আজব সুন্দর, ‘প্রিয় জন্মভূমি’ ‘দায়মুক্তি’ মুক্তি পায়নি। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ‘কালবেলা’, ‘আজব ছেলে’ ও ‘অবলম্বন’মুক্তি পায়নি। ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে কবরীর ‘এই তুমি সেই তুমি’ হোসেন মোবারক রুমীর ‘অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া’, হৃদি হকের ‘১৯৭১ সেই সব দিন’ ছবির শুটিং চলছে। মীর সাব্বির পরিচালিত ‘রাতজাগা ফুল’, শমী কায়সার পরিচালিত ‘স্বপ্ন মৃত্যু ভালোবাসা’ ও আকরাম খান পরিচালিত ‘নকশি কাঁথার জমিন’ সিনেমার শুটিং শুরু হবে বলে জানা গেছে।

বাংলাধারা/এফএস/ইরা 

আরও পড়ুন