২৪ অক্টোবর ২০২৫

মুঠোফোনের আসক্তি কমাচ্ছে শখের গিটার

ফাহিম আল সামাদ »

বর্তমান সময়ে স্মার্টফোন আমাদের জীবনের অত্যাবশ্যক অংশ হয়ে উঠেছে। তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অ্যাপস, গেমসসহ আরও অসংখ্য সুযোগ সুবিধা দেয়ার পাশাপাশি হাতের মুঠোফোনটি এখন একটি আসক্তির নামও। মুঠোফোন ব্যবহারের উপর নিয়ন্ত্রণ না থাকায় আচরণগত, মানসিক ও চিন্তাধারার নানাবিধ সমস্যার কথা এরই মধ্যে অনেক বিশেষজ্ঞই বলেছেন। এছাড়াও অতিরিক্ত মোবাইল আসক্তি ব্যক্তিগত সম্পর্কে ক্ষতির কারণ ও ব্যক্তির সৃজনশীল চিন্তায় বাঁধা প্রদান করার কথাও বলছেন গবেষকরা।

আর বর্তমান সময়ে এই আসক্তিতে জড়াচ্ছে শিশুরাও। বিটিআরসির ২০১৬ সালের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী ছেলেমেয়েদের প্রায় ৩.৫ শতাংশ নিয়মিত ইন্টারনেট ব্যবহার করে থাকে, যার বড় একটা অংশই যুক্ত থাকে নানা ধরনের সোশ্যাল মিডিয়া সাইটের সঙ্গে। এই বাড়তি আসক্তিতে দুশ্চিতায় ভুগছেন শিশুদের অভিভাবকরা।

সন্তানের মানসিক বিকাশ ও দক্ষতায় মোবাইল ফোনের আসক্তির প্রভাব কমাতে তাই অভিভাবকরা বেছে নিচ্ছেন শিল্প ও সংস্কৃতিকে। সন্তানকে তাই নাচ, গান, আবৃত্তি, নাটক শেখার ক্ষেত্রে আগ্রহী করে তুলছেন তারা কিংবা হাতে তুলে দিচ্ছেন কোনো বাদ্যযন্ত্র। সন্তান যাতে মোবাইল আসক্ত না হয়ে সৃজনশীল কাজে আগ্রহী হয় সে কথা মাথায় রেখেই অভিভাবকরা শিশুকে উদ্ধুত করছে শিল্প সংস্কৃতিতে।

চট্টগ্রাম নগরীর শিল্পকলা একাডেমি এলাকায় অবস্থিত মিউজিক্যাল শপ “স্ট্রিং’স” এ গিয়ে দেখা যায়, বিকেল হলেই সেখানে ভীড় করছে তরুণ কিংবা কিশোর বয়সের ছেলে-মেয়েরা। হাতে গিটার কিংবা ইউকুলেলে নিয়ে গানে কিংবা আড্ডায় মেতে উঠছেন তারা। এসময় তাদের ব্যবহৃত মুঠোফোনটি থাকছে তাদের ব্যাগে কিংবা দূরে। এসব তরুণ-কিশোরের অনেকের এখানে আসেন গিটার কিংবা ইউকুলেলে শিখতে। অনেকের সাথে তাদের অভিভাবককেও দেখা যায় সন্তানের পাশে বসে সন্তানকে উৎসাহ দিতে।

গিটার হাতে সুর তোলা কিশোর রূপমের সাথে কথা বলে জানা যায়, ২০২০ সালের লকডাউনে প্রথম গিটার হাতে তুলে নেয় সে। তার মা আগে থেকেই উচ্চাঙ্গ সংগীত চর্চা করতেন। সেখান থেকেই গানের প্রতি ভালোবাসা। বাবা-মায়ের উৎসাহে তিনি এখন গিটার শিখছেন এবং পাশাপাশি সংগীত চর্চাও করছেন। তার আগ্রহ পড়ালেখা এবং অন্যান্য কাজের পাশাপাশি বন্ধুদের নিয়ে একটি ব্যান্ড দল গঠন করা।

দোকানের এপাশ ওপাশ ঘুরে ইউকুলেলে দেখছে ৭ বছর বয়সী শিশু মালিহা। অনেক ঘুরে একটি কালো রঙের ইউকুলেলে বাবাকে দেখিয়ে দেয় সে। তার বাবা জানান, আজকাল শিশুদের প্রধান আসক্তি মোবাইল। মোবাইল হাতে নেওয়া ছাড়া খাওয়া-দাওয়াতেই অনীহা তাদের। আমার মেয়ের ক্ষেত্রেও বিষয়টি একই ছিল। একদিন মোবাইলে ইউকুলেলের ভিডিও দেখে বায়না ধরে তাকে ছোট গিটার কিনে দিতে হবে। মোবাইল আসক্তি থেকে দূরে রাখতে এবং নতুন কিছুর প্রতি আগ্রহ জন্মাতে এটি সাহায্য করবে ভেবে আমিও মেয়েকে নিয়ে বাসার পাশের এই দোকানে আসলাম ইউকুলেলে কিনতে।

স্ট্রিং’স মিউজিক্যাল শপের কর্নধার কাজল ভট্টাচার্য বাংলাধারাকে বলেন, ‌‘আমাদের ছোট বেলায় আমরা অবসর সময়ে খেলাধুলা করেছি, মাঠে গলা ছেড়ে গান করেছি। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে এখনের শিশু কিশোররা প্রযুক্তিতে এতটাই আসক্ত হয়ে গেছে যে জীবনে হাসি-খুশীর বয়সটুকুতে তারা আটকে আছে মোবাইল ফোনের ডিসপ্লেতে। বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র কিনতে কিংবা শিখতে আসা সন্তানদের অভিভাবকরা প্রায়ই বলেন সন্তান যাতে মোবাইল ফোনে আসক্ত না হয়— সেজন্যই তারা সন্তানদের শিল্পমনা করে তুলছেন।

তিনি আরও জানান, চট্টগ্রামে স্ট্রিং’স এর পাশাপাশি আরও বেশ কিছু মিউজিক্যাল শপ আছে। অবসর সময়ে এখন অনেক তরুণই এই শপগুলোতে এসে গানে কিংবা অন্যান্য সৃজনশীল বিষয়ে আলাপ করে। এছাড়াও এখানে প্রায়ই সংগীত জগতের অনেক পরিচিত মুখ আসেন। কিশোর-তরুণদের তারাও নানা রকম পরামর্শ দেন। এতে সৃজনশীল কাজে সকলের আগ্রহ যেমন বাড়ে তেমনি নানাবিধ মানুষের সাথে মিশে তাদের পরিচিত ও মানসিক বিকাশও হয়।

কেবল কিশোর কিংবা তরুণ বয়সীরা নয়, অনেক চাকরিজীবীরাও অবসর সময়ে জড়ো হচ্ছেন এসব মিউজিক শপে; হাতে তুলে নিচ্ছেন বাদ্যযন্ত্র। কখনও শুধু সুরের মূর্ছনায় হারাচ্ছেন আবার কখনও গলা ছেড়ে গাইছেন। আর গতানুগতিক জীবনের একটু অবসরে খুব আবেগে হারিয়ে যাচ্ছেন নিজেদের সুন্দর মুহূর্তগুলোতে।

আরও পড়ুন